বাংলাদেশ থেকে দুবাই। তারপর ইউরোপ। আছে উন্নত জীবনের নিশ্চয়তা, সেই সঙ্গে অনেক টাকা। উচ্চাভিলাষী এমন জীবন-যাপনের আশায় স্বপ্নের দেশ ইউরোপে যেতে বাংলাদেশ থেকে অবৈধপথে পাড়ি জমাচ্ছে শত শত তরুণ। তাদের মধ্যে কেউ কেউ যাত্রাপথে সাগর বা জঙ্গলে মারা যাচ্ছে। তাদের অনেকের খবর পায় না পরিবারের কেউ। এক কথায় স্বপ্নের দেশ ইউরোপে যাত্রাপথে স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে অসংখ্য তরুণের। অবৈধপথে যাওয়ার সময় কতজন মারা যাচ্ছে তার সঠিক হিসাবও কারও কাছে নেই। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রতিনিয়ত বাংলাদেশি তরুণদের মৃত্যুর খবর প্রচার হলেও কার সন্তান মারা গেছে-অনেক সময় সে পরিচয় নিশ্চিত হতে পারে না পরিবার। দীর্ঘদিন খোঁজ না পেয়ে পরিবারের সদস্যরা সেই তরুণের আশা ছেড়ে দেন। আর এসবের প্রাথমিক গন্তব্য দুবাই তথা সংযুক্ত আরব আমিরাত।
চুয়াডাঙ্গার মোহাম্মদ ওয়ালিদ ও জাহিদ হাসান। দুই মাসের ভ্রমণ ভিসায় আসেন সংযুক্ত আরব আমিরাত। ভিসা টিকিট পেতে দালালকে দিতে হয় মাথাপিছু চার লাখ টাকা। কথা ছিল দুবাই পৌঁছানোর পর দ্রুত ‘ওয়ার্ক পারমিট’ বা কাজের ভিসা করে দেওয়া হবে। দালালের বক্তব্য অনুযায়ী, হাই প্রোফেশন বা উচ্চপদের এ ভিসায় ভালো বেতনে চাকরিও দেওয়া হবে। তাতে দ্রুতই মিলবে ইউরোপের যেকোনো দেশের ভিসা। অথচ দুবাই পৌঁছানোর পর আর খোঁজ রাখে না, তথাকথিত দালাল চক্র। কথা বললেই টাকা চান মোটা অঙ্কের। দিতে না পারলে বলেন, ইউরোপ যাওয়ার স্বপ্ন শেষ এখানেই!
আমরা তাকে অন্তত ভিসাটা করে দিতে বলি। যাতে এ দেশে আমরা অবৈধ না হয়ে পড়ি। দালালরা আমাদের কোনো কথায় গুরুত্ব দেয়নি। একপর্যায়ে আমাদের ভিজিট ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে এলে আবারও একটি ভিজিট ভিসা ইস্যু করে দেওয়া হয়। অথচ কথা ছিল ‘ওয়ার্ক পারমিট’ করে কাজ দেওয়া হবে। তারপর ইউরোপের ভিসা প্রসেসিং করা হবে। তিন থেকে চার মাসের মধ্যে সরাসরি ভিসা নিয়ে ইউরোপ চলে যেতে পারব। কিন্তু এখন আমাদের যে অবস্থা, তাতে নিজ দেশে ফেরাই অনিশ্চিত। বলছিলেন ভুক্তভোগী প্রবাসী মোহাম্মদ ওয়ালিদ।
ওদিকে মাসখানেক ধরে খবর পাওয়া যাচ্ছে না জাহিদ হাসানের। শোনা যাচ্ছে, আরব আমিরাত থেকে সাগরপথে ইরান পাড়ি দিয়ে তুরস্ক হয়ে বর্তমানে গ্রিসে অবস্থান করছেন তিনি। দুবাই থাকাকালীন কোনো কাগজপত্র বা বৈধ ভিসার ব্যবস্থা করতে না পারলেও একপ্রকার জীবনের ঝুঁকি নিয়েই ছুটেছেন ইউরোপের দিকে। কথা হয় তার সঙ্গে। জানা যায় আরব সাগর পাড়ি দিয়ে ইরান পৌঁছতে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। এরপর সেখান থেকে সড়কপথে তুরস্কের ইস্তাম্বুল। ইস্তাম্বুল থেকে রাতের আঁধারে স্পিডবোটে চড়ে সাড়ে তিন ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর সাগরপথ পাড়ি দিয়ে স্থানীয় পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রবেশ করেন গ্রিসে। এরপর থেকে সেখানেই লুকোচুরি করে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে তার। এখন জাহিদের মুখে কিছু কথা শোনার আগে পরিচিত হতে হবে ‘গেম’ নামক একটি শব্দের সঙ্গে। ‘গেম’ হচ্ছে উন্নত দেশে অভিবাসন প্রার্থীদের ভাগ্য ও জীবনের মধ্যকার একটি জীবনমরণ খেলার ‘কোড ওয়ার্ড’। এ প্রক্রিয়াতে সাগর, মরুভূমি ও ভয়ঙ্কর জঙ্গল পাড়ি দিতে হয় একেকজন অভিবাসীকে। তাতেও দালাল চক্রকে কয়েক ধাপে দিতে হয় ৮-১০ লাখ টাকা পর্যন্ত। আর পুরো প্রক্রিয়াটিতে সরাসরি ও নেপথ্যে কাজ করে একাধিক মাফিয়া চক্র। এ প্রসঙ্গে জাহিদ বলেন, ‘আমরা ৩০ জন একসঙ্গে দুবাই থেকে বের হয়েছিলাম। এরপর তুরস্ক পর্যন্ত একসঙ্গেই ছিলাম। ইস্তাম্বুল থেকে গ্রিসের উদ্দেশে স্পিডবোটে ‘গেম’ শেষ হওয়ার পর মাত্র ১২ জনকে সঙ্গে পেয়েছি। বাকিদের কোনো খবর জানি না। হয়তো তারা সাগরে পড়ে গেছে বা পুলিশের হাতে ধরা খেয়েছে।’
চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি মাদারীপুরের রাজৈর ও মুকসুদপুরের কয়েকজন যুবক ইতালির উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হন। প্রথমে তারা বিমানযোগে লিবিয়া, পরে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি লিবিয়া থেকে দালালদের মাধ্যমে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ইতালির উদ্দেশে রওয়ানা দেয়। মাঝপথে তিউনিসিয়ার ভূমধ্যসাগরে ইঞ্জিন ফেটে আগুন ধরে ডুবে যায় নৌকাটি। এতে রাজৈরের কোদালিয়ার সজীব কাজী, পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের মামুন শেখ, সেনদিয়ার সজল বৈরাগী, কদমবাড়ির নয়ন বিশ্বাস ও কেশরদিয়া গ্রামের কাওসারসহ গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের রিফাদ, রাসেল ও আপনের মৃত্যু হয়।
ওই নৌকাডুবিতে মারা যাওয়া ৮ বাংলাদেশির মধ্যে ৫ জনই ছিল মাদারীপুরের। মৃত্যুর ৭৮ দিন পর গত ৩ মে শুক্রবার বিকেলে তাদের লাশ পৌঁছায় স্বজনদের কাছে। এমন খবর প্রায়ই দেখা যায় গণমাধ্যমগুলোয়। অথচ ইউরোপমুখে অভিবাসীদের ছুটে চলা আর থামে না। বরং ক্রমেই বাড়ছে স্বপ্নের ইউরোপ যাত্রার বিভীষিকাময় গল্প।
ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি পৌঁছানোর আশায় অনেক বাংলাদেশি বিভিন্ন উপায়ে লিবিয়াতে যান। অনেককে আটক করে মানব পাচারকারীরা মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা করে। অনেকে বন্দি হন লিবিয়ান বাহিনীর হাতে।
এমন আটক ও বিপদে পড়াদের দেশে প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তার অংশ হিসেবে গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন ফ্লাইটে ১ হাজার ২৪৫ জনকে ফেরত আনা হয়েছে বলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। এই সংখ্যা ২০২২ সালের সারা বছরের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি। আইওএমর স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসন কর্মসূচির অধীনে সে বছর ফেরত এসেছিলেন ১ হাজার ১০২ জন। আর ২০২১ সালে এসেছেন ৮১৫ জন।
আইওএমের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, উত্তর আফ্রিকার এই দেশটিতে আসা বাংলাদেশিদের এক-তৃতীয়াংশ তুরস্ক থেকে প্রবেশ করেছেন। এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিসর হয়ে এসেছেন অনেকে। এ জন্য মাথাপিছু ৪ হাজার ১৩৬ ডলার বা প্রায় ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত তারা খরচ করেছেন তারা।
লিবিয়ায় আসা এসব অভিবাসীর মূল লক্ষ্য থাকে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইতালি পৌঁছানো। আইওএমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে লিবিয়া থেকে সমুদ্রপথে ইতালিগামীদের ১৪ শতাংশের বেশি ছিল বাংলাদেশি, যা দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ। দেশটি থেকে ভূমধ্যসাগর পার হতে গিয়ে অনেকে মারা যান। অনেককে সমুদ্র থেকে বাধা দিয়ে ফিরিয়ে আনে লিবিয়ার উপকূলরক্ষী বাহিনী। ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৪৪৮ জন, যা দেশটিতে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের ২০ শতাংশ প্রায়। সে বছর বিভিন্ন আটককেন্দ্রে বন্দি ছিলেন ২ হাজারের বেশি বাংলাদেশি।
বিভিন্ন গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী মানব পাচারের শিকার হয়ে লিবিয়ায় আসা অভিবাসীরা অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হন। বিভিন্ন সময়ে মানব পাচারকারীরা তাদের আটক করে নির্যাতন করার পাশাপাশি দেশে থাকা পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা করে। এ ছাড়া, দেশটির বিভিন্ন আটককেন্দ্রেও অমানবিক পরিবেশে তাদের থাকতে হয়।
লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৮ জানুয়ারি ত্রিপোলির তারিক মাতার ডিটেনশন সেন্টারে আটক ১৩১ জনকে ফেরানো হয়। ২১ ডিসেম্বর লিবিয়ার পূর্বাঞ্চল থেকে ফিরেছেন আরও ১৪০ জন। তাদের মধ্যে ২৭ জন বেনগাজির গানফুদা ডিটেনশন সেন্টারে আটক ছিলেন। ১৪ ডিসেম্বর ফেরত আসা ১৩৬ জনের মধ্যে ৩৩ জন এই আটক কেন্দ্রটিতে ছিলেন। বেনগাজিতে আটক আরও ১৪৫ জনকে একটি ফ্লাইটে ফেরত পাঠানো হয়েছে ৫ ডিসেম্বর। এ ছাড়া নভেম্বরের ২৭ ও ৩০ তারিখে দুইটি ফ্লাইটে ত্রিপোলিতে বন্দি থাকা ২৫৩ জন ফেরত এসেছেন।
আপনার মতামত লিখুন :