দুবাইয়ের অন্যতম শ্রমঘন অঞ্চল বা শ্রমিকদের বসবাস আল কুজে। কোনো এক সন্ধ্যায় এক চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছি কয়েকজন সহকর্মী ও বন্ধুদের সঙ্গে; তারাও প্রবাসী। মাঝারি বয়সের চেক শার্ট আর লুঙ্গি পরিহিত একজন এসে বসলেন পাশের টেবিলে। এক কাপ চা আর একটি রুটি অর্ডার দিয়ে ফোনে কথা বলা শুরু করলেন বিশেষ কারও সঙ্গে।
কয়েক মিনিট কথা বলতেই বেশ রেগে গেলেন লোকটি। ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা ব্যক্তির উদ্দেশ্যে খুব কড়া আর বিদ্রূপের ভাষায় উত্তর ছুড়ছিলেন তিনি। সেসব কথা এই খোলা কলমে লেখা বা প্রচার করার মতো সাহস আমার নেই। তবে তার কয়েকটি কথার শুদ্ধাচ্চরণ ছিল অনেকটা এ রকম- ‘এই অমুকের জন্য দেশ ছাড়লাম। দেশেও যেতে পারি না ৮-১০ বছর। এখন আমার পরিবারকেও ছাড়লো না।’ কান্না জড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘একদিন সময় আসবে। এ দেশ, দেশের মানুষ আর প্রকৃতিই তাদের বিচার করবে।’ বুঝতে বাকি রইলো না যে, মানুষটি চরমভাবে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বা নির্যাতনের শিকার। এরইমধ্যে তার চা-রুটি চলে এলো। আমিও মনোযোগী হলাম আড্ডায়। ঘটনাটি কয়েক বছর আগের।
সেদিন অফিস শেষে ড্রাইভ করে বাসায় ফিরছি। ড্যাশ বোর্ডে মোবাইল স্ট্যান্ডে লাগানো ফোন স্ক্রিনে একটা নিউজ ভেসে এলো। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক ৯ মন্ত্রীসহ ১৩ জনের বিচারকার্য শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। অথচ এই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সৃষ্টি করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে নিজেদের রাজনৈতিক খায়েশ মিটিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। আসামিদের মধ্যে রয়েছেন খোদ এই ট্রাইব্যুনাল গঠনের মূল পরামর্শকদের কয়েকজন। হঠাৎ আনমনে আলকুজে চায়ের দোকানে দেখা সেই লোকটির কথা মনে পড়লো।
তার কথা মনে হতেই কানে ভেসে এলো তার ক্ষোভ জড়ানো সেই কথাগুলো। কান্না জড়িত কণ্ঠে সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘একদিন সময় আসবে। এ দেশ, দেশের মানুষ আর প্রকৃতিই তাদের বিচার করবে।’ কথাগুলো কেমন যেন এই ঘটনার সঙ্গে হুবহু মিলে গেল। এমন হাজারো প্রবাসীর ক্ষোভ থেকেই যেন শুরু হয়েছিল বিক্ষোভ। আন্দোলিত ছাত্র জনতার রক্তে অর্জিত হয় ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’। বিগত ১৬ বছরের আওয়ামী শাসনামলে রাজনৈতিক হামলা, মামলা ও নির্যাতনের শিকার প্রবাসীদের একটি বিশাল অংশ এবার দেশে ফিরে যাচ্ছেন। কেউ কেউ স্বৈরাচার সরকার পতনের আনন্দ উদযাপন করে ফিরে আসছেন কর্মস্থলে। কেউ আবারও স্থায়ী হচ্ছেন নিজ দেশে। তবে দেশে ফেরার যে হিড়িক পড়ে গেছে সেটা বুঝতে পেরেছিলাম ৫ আগস্টেই। ওই সময় আমি দেশে ছিলাম। বিশেষ কারণে কয়েকদিন এয়ারপোর্টে যেতে হয়েছে। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে এই সময়টাতে যেন এয়ারপোর্টে প্রবাসীদের ফেরার চাপ বেশি ছিল। কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলো, জিজ্ঞেস করলাম কতদিন পর দেশে আসলেন, সঙ্গে তেমন কোনো মাল-সামান দেখছি না, কতদিনের ছুটিতে আসলেন? এই ধরনের কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানতে পারলাম- ‘দেশ স্বাধীন হইছে, তাই আর বিদেশে থাইক্কা কী করমু।’ কেউ বললেন, ‘দেশে ফিরতে পারছি এই অনেক। বেঁচে থাকলে বহু মাল-সামান আনতে পারব ভাই।’
কেউ বললেন, ‘কোনোদিন কল্পনাও করতে পারিনি এভাবে মুক্ত বাতাসে দেশে ফিরতে পারব। মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে অনেক টাকা খরচ করে পৈত্রিক প্রাণটা নিয়ে বিদেশে পালায় ছিলাম ভাই।’ বুঝলাম রাজনৈকি কারণে দেশ ছাড়া প্রবাসীদের গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ স্বৈরাচার পতনের খবরে দেশে ফিরছেন।
আপনার মতামত লিখুন :