ঢাকা সোমবার, ২০ জানুয়ারি, ২০২৫

মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারের হালহকিকত

এসএম শাফায়েত

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২০, ২০২৫, ০৩:৫৩ পিএম

মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারের হালহকিকত

ছবি: সংগৃহীত

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য প্রধান গন্তব্যস্থল হিসেবে পরিচিত। প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। জুলাই আন্দোলন তথা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতিত সরকারের সংকটাপন্ন আর্থিক অবস্থা ও রিজার্ভ সংকট কাটিয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পালে হাওয়া লাগিয়েছে প্রবাসীরা।

দেশের চরম আর্থিক সংকটে এনে দিয়েছে স্বস্তি। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যের বেশকিছু দেশে ভিসা নীতির পরিবর্তন এবং ভিসা বন্ধের কারণে শ্রমিক রপ্তানিতে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষত, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন এবং মালয়েশিয়ার পাশাপাশি সংযুক্ত আরব আমিরাতেও ভিসা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে, যা দেশের প্রবাসী শ্রমবাজারের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে।

বিশেষ করে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার হিসেবে পরিচিত সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) ভিসা প্রক্রিয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে কিছু জটিলতা দেখা দিয়েছে। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য ইউএই সরকার ভিসা প্রদানে কঠোরতা আরোপ করেছে। যদিও ঢাকায় ইউএই দূতাবাস এ খবর অস্বীকার করেছে এবং নিশ্চিত করেছে যে, বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ভিসা পুরোপুরি বন্ধ করা হয়নি। তবে ইউএই শ্রমবাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রবেশে যে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে, তার পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। চলমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, 
বাংলাদেশ থেকে পাঠানো শ্রমিকদের একটি অংশ ভিসার শর্ত লঙ্ঘন বা অবৈধভাবে সেখানে অবস্থান করায় ইউএই সরকারের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে বাংলাদেশিদের ভিসা প্রদানে কড়াকড়ি আরোপ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সেই সঙ্গে রয়েছে দক্ষতার অভাব।

ইউএই বাজারে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন এবং প্রশিক্ষিত শ্রমিকের বেশ চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে প্রেরিত অনেক শ্রমিক এই মানদণ্ড পূরণে ব্যর্থ হচ্ছেন। কেউ বা ভুয়া সনদ তৈরি করে ভিসা গ্রহণের সুযোগ নিয়েছেন। যেটি প্রমাণিত হওয়ায় এখন পুরোপুরিভাবেই ভিসা প্রদান বন্ধ রেখেছে দেশটি। সম্প্রতি দীর্ঘ চার মাসের সাধারণ ক্ষমার সুযোগ দিয়ে অবৈধ প্রবাসীদের বৈধ হবার সুযোগসহ বিনাদণ্ডে দেশে ফেরার সুযোগ দেয় দেশটির সরকার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক তথ্যে জানা যায়, আরব আমিরাতের সাধারণ ক্ষমার সুবিধা নিয়েছেন ৫০ হাজার বাংলাদেশি।

তবে তথ্য রয়েছে, সাধারণ ক্ষমার আগে অবৈধ বাংলাদেশি প্রবাসীর সংখ্যা ছিল লক্ষাধিক। সেখানে মাত্র ৫০ হাজার প্রবাসী এই সুযোগ নিয়ে থাকলেও এখনো অর্ধ লক্ষাধিক প্রবাসী অবৈধ অবস্থায় বসবাস করছেন দেশটিতে। পহেলা জানুয়ারি সাধারণ ক্ষমার মেয়াদ শেষ হলে কঠোর অভিযানে নামে দেশটির প্রশাসন। এরপর থেকেই প্রতিদিনই অসংখ্য অভিবাসীকে বিভিন্ন দণ্ডে দণ্ডিত করে দেশে পাঠানো হচ্ছে। বর্তমানে উচ্চশিক্ষিত, বৈধ প্রাতিষ্ঠানিক সনদধারীদের জন্য ভিসা ট্রান্সফার বা অভ্যন্তরীণ মালিক পরিবর্তনের সুযোগ রেখেছি দেশটি। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি নাগাদ ভিসা জটিলতা নিরসন হতে পারে বলে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে এমন আভাস দেন ঢাকায় নিযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসে বাংলাদেশে মোট রেমিট্যান্সের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। এই সময়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ৯৯ কোটি মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা মোট রেমিট্যান্সের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উৎস। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশ থেকেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে। সৌদি আরব, কুয়েত, ওমান, কাতার, বাহরাইন, লিবিয়া ও ইরান থেকে প্রবাসীরা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ দেশে পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রবাসী শ্রমিকদের বেশিরভাগই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অবস্থান করেন, এবং এই দেশগুলো থেকে আসা রেমিট্যান্স দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহে কিছুটা হ্রাস লক্ষ্য করা গেছে।

বিশেষ করে, সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্সের পরিমাণ কমে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যেখানে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিট্যান্সের পরিমাণ বেড়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে আসা রেমিট্যান্স বাংলাদেশের মোট রেমিট্যান্সের একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে, যা জুলাই আন্দোলন পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমর্থনে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

তবে ভিসা জটিলতা ও বন্ধের প্রভাবে কমতে পারে এই রেমিট্যান্স প্রবাহ। ভিসার কঠোর নীতির কারণে প্রবাসী শ্রমিকদের সংখ্যাও দিন দিন কমে যাচ্ছে, যার ফলে রেমিট্যান্স আয়ে বড় ধাক্কা লাগছে। সেই সঙ্গে প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক কর্মক্ষম ব্যক্তি বিদেশে যাওয়ার সুযোগ হারাচ্ছেন। দেশে বেকারত্বের হার দিন দিন বাড়ছে। বিদেশে যাওয়ার জন্য ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করা শ্রমিকরা ভিসা না পাওয়ায় আর্থিক সংকটে পড়ছেন।

এমন সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারকে ইউএই এবং অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনা বাড়াতে হবে। প্রশিক্ষিত শ্রমিক প্রেরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শ্রম বাজার পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করতে হবে। শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও ভাষাগত প্রশিক্ষণ দেওয়াও জরুরি। দক্ষ কর্মী সরবরাহ করলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশের চাহিদা বাড়বে। সেই সঙ্গে প্রয়োজন অবৈধ অভিবাসনরোধ। অবৈধ অভিবাসন বন্ধে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বৈধ চ্যানেল নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে নতুন শ্রমবাজার যেমন- পূর্ব ইউরোপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলোতে শ্রমিক রপ্তানির সুযোগ খুঁজতে হবে। সবকিছুর মূলে মধ্যস্থতাকারী বা ভিসা প্রক্রিয়ায় জড়িত দালালদের নিয়ন্ত্রণ করে শ্রমিকদের প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।

মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে ভিসা নীতির পরিবর্তন এবং ভিসা বন্ধ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাজারে নিয়ন্ত্রণের প্রভাব বাংলাদেশের জন্য আর্থ-সামাজিকভাবে গভীর। তবে সঠিক কৌশল গ্রহণ এবং সরকারী পদক্ষেপের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। দক্ষ শ্রমিক তৈরির পাশাপাশি কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়ন এবং অবৈধ অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাংলাদেশের শ্রমবাজারকে পুনরুজ্জীবিত করা যেতে পারে।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!