প্রবাসে বসবাস করা যেমন নতুন নতুন অভিজ্ঞতার দরজা খুলে দেয়, তেমনি কিছু কঠিন চ্যালেঞ্জ আর অপরিসীম কষ্টের সঙ্গী হয়। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই শহরটি স্বপ্নের মতো সুন্দর, আধুনিক স্থাপত্য, আলোকসজ্জা আর কর্মব্যস্ততায় ভরা। কিন্তু প্রিয়জনদের থেকে দূরে থাকা কষ্টের কোনো তুলনা হয় না।
প্রথমেই বলতে চাই, প্রবাসজীবন যেমন চ্যালেঞ্জিং, তেমনি অনেক ত্যাগ স্বীকারের নামও বটে। কাজের জন্য এখানে আসার পর থেকে অনুভব করেছি, আমাদের দেশের মাটি, বাতাস, মানুষ, সংস্কৃতি, সবকিছু কতটা গুরুত্বপূর্ণ। দুবাইয়ের জীবনযাত্রা দেখতে আকর্ষণীয় হলেও, এর ভেতরের বাস্তবতা কেবল প্রবাসীরাই বুঝতে পারে। প্রবাসে বসবাসের প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল এখানকার জীবনযাত্রার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কাজে যাওয়া, সারাদিন পরিশ্রম করে বাড়ি ফেরার যেন একঘেয়েমির চক্র। নতুন জায়গায় পরিচিত কারো অভাব সবসময় অনুভব হয়।
পরিবারের সবাইকে ছেড়ে আসার কষ্টটা মন থেকে কাটে না। বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজনদের ছেড়ে আসার পর প্রতি মুহূর্তে তাদের মিস করা। বিশেষ করে, বন্ধুদের সঙ্গে কাটানো দিনগুলোর কথা মনে পড়লে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। বন্ধুদের সঙ্গে কাটানো সেই সময়গুলো, যেগুলোতে একসঙ্গে হৈচৈ করা, ঘোরাঘুরি করা, গল্প করা এ সবই এখন স্মৃতি।
আমাদের দেশের বিভিন্ন উৎসব সকল প্রবাসীর খুব প্রিয়। কিন্তু প্রবাসে এসব উৎসবগুলো কেবল স্মৃতির পাতায় রয়ে গেছে। বাংলাদেশের সংস্কৃতি আর বিভিন্ন উৎসবগুলো প্রবাসে বসে মিস করার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। প্রতি বছর বিজয়মেলা, পহেলা বৈশাখের আনন্দ, শীতের দিনে বিভিন্ন ধরনের পিঠা খাওয়া এসব মধুর স্মৃতিগুলো মনে পড়লে চোখে পানি আসে। আমাদের সংস্কৃতিকে খুব মিস করি। শীতকালে ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট আর বর্ষাকালে ফুটবলের ম্যাচগুলো, যেগুলোতে আমরা মিলে চেঁচামেচি করতাম, সেগুলো কতটা বিশেষ ছিল, তা এখানে এসে আরও ভালো বুঝতে পারি।
ঈদের দিনের কথা আলাদা করে বলতেই হবে। ঈদগাহে একসঙ্গে নামাজ পড়া, তারপর বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি, আত্মীয়দের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া এই আনন্দগুলোকে এখন অনেক বেশি মিস করি। ঈদের আনন্দ এখন আর তেমন অনুভূত হয় না। সেই সময়গুলো কতটা মূল্যবান ছিল, সেটা এখন বুঝি।
তবে, প্রবাস জীবনের কিছু ভালো দিকও আছে। দুবাই একটি আন্তর্জাতিক শহর, যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ বসবাস করে। তাদের সঙ্গে মিশে নতুন কিছু শেখার সুযোগ হয়। বিভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়া, তাদের কাজের ধরন, চিন্তাভাবনা সবকিছুই আমার দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করেছে। এখানকার কাজের পরিবেশ অনেক পেশাদার, এবং এখানে থেকে আমি ধৈর্য, সময় ব্যবস্থাপনা এবং আত্মনির্ভরশীলতার অনেক কিছু শিখেছি। দুবাইতে বিভিন্ন উন্নত সুযোগ-সুবিধা আছে, যা অনেক মানুষের জন্য স্বপ্ন। এখানে আধুনিক প্রযুক্তি, বিশ্বমানের যোগাযোগ ব্যবস্থা, এবং কর্মক্ষেত্রের বৈচিত্র্য মানুষকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। আমি এটাও বুঝেছি যে, এখানে কঠোর পরিশ্রম করলে তার সঠিক প্রতিদান পাওয়া যায়।
তবে, দিনশেষে, মনে হয় নিজের দেশের মাটির চেয়ে ভালো আর কিছুই নেই। বছরের একবার যদি দেশের মাটিতে ফিরে যেতে পারি, সেই দিনগুলোর জন্য সারা বছর অপেক্ষা করি। সবার সঙ্গে সময় কাটানো, পুরোনো দিনের স্মৃতিগুলো ঝালাই করা এই সবকিছুই আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মুহূর্ত।
আপনার মতামত লিখুন :