বিস্তীর্ণ মরুপ্রান্তরে ধূসর বালুকনার মাঝে কী-ই বা এমন থাকতে পারে? উত্তাল সাগরে মাছ ধরে জীবিকাই কী একমাত্র অবলম্বন? ৭০-এর দশকে মধ্যপ্রাচ্যের একটি ছোট্ট দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দিকে তাকালে এমনটিই যারা ভাবতেন, তারা তখনো স্বপ্নবাজ রাষ্ট্রনায়ক শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদকে ঠিক চিনতে পারেননি। মরুর বালুকনায় যিনি আজকের দুবাইয়ের চকচকে অট্টালিকা দেখেছিলেন, সাগরে ভেসে রাতের আকাশে নিজেদের মেলে ধরার স্বপ্নে বিভোর হয়েছিলেন।
যে স্বপ্ন আর স্বপ্ন নেই। সবই বাস্তবতা। সংযুক্ত আরব আমিরাত ক্রমবর্ধমান উন্নতির সঙ্গে উচ্চাভিলাষী মহাকাশ কর্মসূচির অংশ হিসেবে এমবিজেড স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে আরও একটি মাইলফলক স্থাপন করেছে। চলতি মাসের ১৪ জানুয়ারি স্যাটেলাইটটি মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়। পরদিন সকালেই অরবিটে সিগনাল পাঠানো শুরু করে এমবিজেড। বলা হচ্ছে দেশটির মহাকাশ গবেষণার উন্নয়নে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। পুরোপুরি আমিরাতি ইঞ্জিনিয়ারদের দ্বারা ডিজাইন ও নির্মিত এই স্যাটেলাইটটি শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের নামে নামকরণ করা হয়েছে। ২০১৮ সালে খলিফাস্যাটের সফল উৎক্ষেপণের পর, এটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের দ্বিতীয় সম্পূর্ণ দেশীয় স্বতান্ত্রিক স্যাটেলাইট।
এমবিজেড স্যাটেলাইটটি আধুনিক প্রযুক্তির চূড়ান্ত উদাহরণ হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। পূর্ববর্তী স্যাটেলাইটগুলোর তুলনায় দ্বিগুণ উন্নত মানের ছবি ধারণে সক্ষম এমবিজেড। স্যাটেলাইটটি পৃথিবীর নির্দিষ্ট স্থানের ছবি তুলতে পারে এবং এর রেজ্যুলেশন এতটাই উচ্চমানের যে এটি ক্ষুদ্রতম বৈশিষ্ট্যগুলোও শনাক্ত করতে পারবে। এমবিজেড স্যাটেলাইটে ডেটা ডাউনলিংকের গতি তিনগুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা একে আগের স্যাটেলাইটগুলোর তুলনায় আরও কার্যকর করে তুলেছে।
এটি দ্রুত তথ্য প্রেরণ নিশ্চিত করবে, যা জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণে অত্যন্ত সহায়ক। স্যাটেলাইটটি অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় চিত্র বিশ্লেষণ প্রযুক্তি দ্বারা সজ্জিত। এটি ২৪ ঘণ্টা বিভিন্ন স্থানের ছবি তুলতে এবং সেগুলো বিশ্লেষণ করতে সক্ষম।
এমবিজেড স্যাটেলাইটের কার্যকারিতা অনেক বিস্তৃত। এটি শুধুমাত্র একটি বৈজ্ঞানিক প্রকল্প নয়, বরং পরিবেশ, অর্থনীতি এবং নিরাপত্তার জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে।
পরিবেশ পর্যবেক্ষণ
স্যাটেলাইটটি জলবায়ু পরিবর্তন, বায়ুদূষণ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য ব্যবহৃত হবে। এটি মহাসাগর, মরুভূমি এবং বনভূমির পরিবেশগত পরিবর্তন পর্যবেক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন বন্যা, ভূমিকম্প বা ঝড়ের আগাম সতর্কতা দেওয়া এবং দুর্যোগ পরবর্তী পুনর্বাসন পরিকল্পনা তৈরিতে স্যাটেলাইটটি সাহায্য করবে।
শহুরে অবকাঠামো ব্যবস্থাপনা
শহরের মানচিত্র তৈরি, রাস্তা নির্মাণ এবং অবকাঠামো পরিকল্পনার জন্য এটি ব্যবহৃত হবে।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
এমবিজেড স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আরব আমিরাত আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে অংশীদারিত্ব আরও জোরদার করবে। স্যাটেলাইটটি মহাকাশ গবেষণায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের উচ্চাভিলাষকে চিত্রিত করে। ২০১৯ সালে আমিরাতি নভোচারী হাজ্জা আল মানসুরির আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে যাত্রার পর দেশটি মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে আরও সাহসী উদ্যোগ নিয়েছে। এমবিজেড স্যাটেলাইটের উৎক্ষেপণ সেই ধারাবাহিকতার একটি অংশ। সংযুক্ত আরব আমিরাতের ‘ভিশন ২০৩০’ পরিকল্পনার মধ্যে মহাকাশ গবেষণাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
এই স্যাটেলাইট দেশটির মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। এমবিজেড স্যাটেলাইটটি আরব আমিরাতকে আন্তর্জাতিক মহাকাশ গবেষণা ও বাণিজ্যিক স্যাটেলাইট প্রযুক্তির অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে পরিণত করবে। পাশাপাশি সংযুক্ত আরব আমিরাতের জন্য শুধু একটি প্রযুক্তিগত মাইলফলক নয়, বরং একটি বৈশ্বিক উদাহরণ। এটি কেবল দেশের জন্য উন্নয়ন নয়, বরং মহাকাশ গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। দেশটির উচ্চাভিলাষী মহাকাশ কর্মসূচির মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হবে।
আপনার মতামত লিখুন :