ঢাকা বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

যেখানে পাহাড় ও পারাবার মিলেমিশে একাকার

ফরহাদ হুসাইন
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৫, ০২:৫২ পিএম
ছবি: সংগৃহীত

কাজের চাপে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে হাঁপিয়ে উঠছিলাম। তা ছাড়া করোনায় গৃহবন্দি হয়ে, বিধি-নিষেধের বেড়াজালে বাইরে ঘুরতে বের হয়নি বহুদিন। মহামারি শেষে বিধি-নিষেধ যখন উঠে গেছে তখনই অফিসে একটা ছোট্ট ছুটির নোটিশ পাওয়াটা ঈদের চাঁদ দেখার মতোই আনন্দের। গতকাল এক ছোট ভাই ফোন করে তার ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্তির সুসংবাদ জানিয়েছিল। আবুধাবিতে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়াটা সোনার হরিণ বটে।

তাকে মুঠোফোনে বললাম, লাইসেন্স তো পেলে এবার আমাদের কাছে পরীক্ষা দাও। চলো ঘুরে আসি খোরফাক্কান। ছোট ভাইটি ও যেন ভ্রমণের জন্য মুখিয়েই ছিল, প্রস্তাবে সোৎসাহে রাজি হলো। অফিস ছুটি, বন্ধুর গাড়ি আর সাপোর্টিভ ড্রাইভার প্রাপ্তির এই সুযোগ হাতছাড়া করাটা ‘হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলা’ হবে। সুতরাং কোনোরকম পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই ছোট ভাইকে নিয়ে রওনা দিলাম আমিরাতের সাগর আর পাহাড়ের শহর খোরফাক্কানের উদ্দেশ্যে।
খোরফাক্কান ওমান উপসাগরের একটি শহর, যা প্রশাসনিকভাবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু ভৌগোলিকভাবে ফুজাইরাহ সংলগ্ন।

রাজধানী আবুধাবি থেকে প্রায় ২৬৩ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এবং দুবাই থেকে প্রায় ১২৯ কিলোমিটার উত্তরে খোরফাক্কান শহরের অবস্থান। আকাশের বুকে হেলান দিয়ে পাহাড় কীভাবে ঘুমায় কিংবা মরুর সঙ্গে সমুদ্রের সখ্য গড়ার সত্যতার সাক্ষাৎ পেতে আপনাকে আসতে হবে এখানে। গভীর প্রাকৃতিক সমুদ্রবন্দর, বৈচিত্র্যময় হাজার পর্বতমালা, নয়নাভিরাম জলপ্রপাত, ধ্বংসপ্রাপ্ত পর্তুগিজ দুর্গ, প্রাকৃতিক লেক, প্রত্নতাত্ত্বিক প্রাচীন গোরস্থান, পাথরের দ্বীপ, পাহাড় কেটে বানানো সুদৃশ্য টানেল এবং মূলত: বাংলাদেশিদের দখলে থাকা ফ্রাইডে মার্কেট শহরটিকে অনন্য  উচ্চতায় এনে দিয়েছে।
খুব ভোরে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। নবীন ড্রাইভার ভাইটি দেড়শ’ কিলোমিটার চালিয়ে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে রণে ভঙ্গ দিল, ফলে নিজেকেই বসে পড়তে হলো ড্রাইভিং সিটে।

রাজধানী শহর আবুধাবি থেকে শারজাহ হয়ে এমিরেটস রোড ধরে নির্দেশনা বোর্ডের ১৪০ কিমি দীর্ঘ শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ সড়ক ধরে আমরা এগিয়ে গেলাম খোরফাক্কান বাইপাস সড়কের দিকে। শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ সড়কটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী সড়ক, বৈশ্বিক মানদণ্ডে প্রথম সারিতে। এই সড়কের সঙ্গে রাজধানীর আল আইন সড়কের অন্তঃসংযোগের মাঝে গড়ে উঠেছে বিখ্যাত দুবাই সিলিকন ওয়াসিস। এই এলাকাটি অত্যন্ত নিরাপদ, অসংখ্য অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত। যে কারণে দুবাই সিলিকন ওয়াসিস গোল্ডেন পাসপোর্টধারীদের বসবাসের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান হয়ে উঠেছে।

শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ সড়কের দুপাশে আছে আরবীয়দের পশু পালনের খামার। আরবীয়দের বহু পুরাতন ঐতিহাসিক পেশা পশুপালন। আগের দিনে আরব বেদুইনরা বিভিন্ন পশু চারণভূমিতে ঘুরে ঘুরে পশুপালন করত। আরব শেখদের হাতে পেট্রোডলারের আধিপত্য আসায় এখন তাদের যাযাবর জীবনের অবসান ঘটেছে এবং খামারগুলোতে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। ফলে পশু পালন খামারগুললো আধুনিক-স্থায়ী রূপ লাভ করেছে। শারজাহ সরকার ছয় বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে তৈরি করেছে পাহাড়ি পথের এই মসৃণ রাস্তা। এই বাইপাস সড়কটি দুবাই থেকে খোরফাক্কানের দূরত্ব অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। ভ্রমণপিপাসুরা ৯০ মিনিটের দীর্ঘ রাস্তা এখন পাড়ি দিতে পারেন মাত্র ৪৫ মিনিটে।

রাস্তার দু’ধারে সারি সারি খাড়া গম্ভীর কালো পাথরের পাহাড় মনে হবে আকাশটাকে আড়ালে রেখে আপনাকে এক রহস্যময় নগরীতে নিয়ে  যাচ্ছে। পাহাড়ের ঘনত্বের কারণে এখানে শব্দের প্রতিধ্বনি হয়, গাড়ির শব্দ পুনরায় গাড়িতে ফিরে আসে এমনকি প্রথম বিমান ভ্রমণের মতো কানে বায়ুচাপ অনুভব হয়।
পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম  ‘আলহাজর’ পর্বতমালার মাঝ দিয়ে এই রাস্তাটি সম্প্রসারিত হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানের প্রায় সাতশ’ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কঠিন শিলার পর্বতশ্রেণি। এই পর্বতশ্রেণির ভেতর দিয়ে মানুষের যাতায়াত উপযোগী রাস্তা করতে কত কসরত, কত প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হয়েছে।

ভারী যানবাহনমুক্ত নিরিবিলি এই রাস্তায় আপনি দারুণ রোমাঞ্চকর অনুভূতি পাবেন যখন আপনার গাড়ি গভীর পাহাড়ের ভেতর দীর্ঘ সুড়ঙ্গপথ পাড়ি দেবে। আরব আমিরাতের দীর্ঘতম পাঁচটি স্থলভিত্তিক টানেল এখানে। পরপর পাঁচটি স্থল টানেলের বুকের ভেতর দিয়ে আপনি শহরে প্রবেশ করবেন। শহরের প্রবেশ পথের ধারে ‘আল রুফসা’ লেক আপনার দৃষ্টিকে শীতল করে তুলবে। চারদিকে সুউচ্চ পাথুরে পাহাড়ের খাদে মনোমুগ্ধকর নীল জলরাশি আপনার মনকে উদ্বেলিত করে তুলবে।

গাড়ির জানালা খুলতেই লেকের স্বচ্ছ নীলজল আমাদের চোখে পড়ল।  মন চঞ্চল হয়ে উঠল, নীল জলের ঢেউ দেখে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হলো।
পার্কিং লট এ গাড়ি রেখে এখানে যন্ত্রচালিত বোটে নিয়ে আমরা ছুটলাম পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে। ছোট্ট নৌকা নিয়ে ও আপনি ঘুরতে পারেন সৌন্দর্য উপভোগের জন্য লেকের সুউচ্চ পাড়ে। সেখানে আছে নিরিবিলি বসে সূর্য স্নানের ব্যবস্থা। গাছপালায় ঘেরা গভীর সবুজে মন জুড়িয়ে নেওয়া এবং পাহাড় ও সবুজের মাঝে মিশে যাওয়া আমাদের স্মৃতি রক্ষার জন্য তুলে নিলাম চমৎকার লোকেশনের কিছু ছবি।লেক ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না কিছুতেই, কিন্তু সমুদ্রের টানে, লেক ছাড়তেই হলো। সৈকতের দিকে পা বাড়ালাম আমরা।

হাতে আপনার অফুরন্ত সময় থাকলে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্তের দৃশ্যও দেখতে পারেন এই লেকের পাড়ে।
খোরফাক্কান সৈকত নিঃসন্দেহে আরব আমিরাতের সবচেয়ে সুন্দর সমুদ্রসৈকত। গাড়ি থেকে নেমে সৈকতে পা রাখতেই মনটা অন্যরকম অনুভূতিতে ভরে গেল। পৃথিবীর দুটি জিনিস বিশালতায় ভরা; আসমান আর সমুদ্র। আসমান ছোঁয়া না গেলেও সাগরের বিশালতা ছোঁয়া যায়। আমার হঠাৎ মনে হলো এত সৌন্দর্যময় সৈকত আমি আর দেখিনি। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত আমাদের কক্সবাজার কিন্তু সৈকতে যত্রতত্র পিলিথিন আর ড্রিংকসের ক্যান পড়ে আছে। কোথাও বা ফটোগ্রাফার, ঘোড় সাওয়ারি কিংবা অন্য রাইডিং এর উৎপাতে আপনার বিরক্তি চলে আসবে। কিন্তু আবুধাবির সৈকত যেমন- পরিচ্ছন্ন তেমনি ভ্রমণপিপাসুদের চলাচলের জন্য নির্বিঘ্ন।

মনে হয় এর চেয়ে সৌন্দর্য হয়তো স্বর্গেই দেখা সম্ভব। তিন দিকে ঘেরা অসীম উচ্চ পর্বতমালা যেন আকাশে আয়েশে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে আর সামনে অসীম সাগরের নীলিমা। সেই ছায়া সাগরে পড়ে মোহময় আবছায়া তৈরি করেছে। নির্মল ও পরিচ্ছন্ন সৈকতের আকাশে তুলতুলে নরম শুভ্র মেঘ যেন ওপর থেকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। জানতে চাইছে- আমার ছায়া নেবে? আবার উড়তে উড়তে দূরের পথে পাড়ি দিচ্ছে। আহ্! একেই বুঝি সৌন্দর্য বলে।

সৈকতে আছড়ে পড়া ঢেউ মনকে অস্থির করে তুলল। নগ্ন পায়ে নেমে পড়লাম নীল জলে। ঝাঁপাঝাঁপি আর দুষ্টুমিতে মেতে উঠলাম আমরা কিছুক্ষণ। সৈকতে টহলরত টুরিস্ট পুলিশ এসে হুইসেল বাজানো শুরু করল। ভড়কে গেলাম ভয়ে, না জানি কি আইন অমান্য করলাম। পরে বুঝলাম কিছু ভারতীয় সাঁতারের পোশাক ছাড়াই নেমে পড়েছে পাশে। নিয়ম ভাঙার দিক থেকে ভারতীয়রা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাঙালিদের চেয়েও একধাপ এগিয়ে।

সৌন্দর্যে ভরপুর এই সৈকতে সুবিধা আছে বই পড়ার, বারবিকিউ পার্টি কিংবা জগিং করার; আছে ক্রুজ প্যারাসেইলিং অথবা সার্ফিং করার সুযোগ। এখানে থেকে মাত্র ২০ দিরহাম দিয়ে স্পিড বোটে ঘুরে আসতে পারেন নিকটবর্তী ‘শার্ক আইল্যান্ড’ থেকে। কিন্তু এদের কেউ আপনাকে জোড়াজুড়ি করবে না, হাত ধরে টানাটানি করবে না রাইডিং এর জন্য।

উপসাগরটি আসলে সাগরের গভীর থেকে গজিয়ে ওঠা হাজার পর্বতমালার একটি শৃঙ্গ। নানা প্রজাতির মাছ, কচ্ছপ ও হাঙ্গরের অভয়াশ্রম এই সৈকত এলাকা। সৈকতের সন্নিকটে কৃত্রিম জলপ্রপাতটি আলাদা আনন্দের খোরাক জোগায়। খোরফাক্কানের অন্যতম আকর্ষণ ফ্রাইডে মার্কেট। এই মার্কেটে পাওয়া যায় নানা রকম তাজা ফল, মাটির তৈরি পাত্র এবং নানা রকমের কার্পেট বিশেষ। নাম ফ্রাইডে মার্কেট হলেও আসলে সপ্তাহের সব দিনই খোলা থাকে দোকানগুলো। মজার বিষয় হচ্ছে, এখানে বাংলাদেশের মতো জিনিস দরদাম করে কিনতে হয়। কারণ বাংলাদেশিদের দ্বারা পরিচালিত এখানকার দোকানিরা এটা উপভোগ করেন।

পাথুরে পাহাড়ে চড়া, নয়াভিরাম জলপ্রপাত, ধ্বংসপ্রাপ্ত পর্তুগিজ দুর্গ, প্রাকৃতিক লেক, প্রত্নতাত্ত্বিক প্রাচীন গোরস্থান, কালা পাথরের দ্বীপ, স্থল টানেল কোনটা রেখে কোনটা দেখি করে করে সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতেই সময় শেষ হয়ে গেল। এ পর্যটন নগরীতে দিন শেষ হয়ে যায়, কিন্তু প্রাপ্তির পিপাসা নিবারণ হয় না। ভ্রমণপিপাসুদের প্রকৃতি এখানে হাতছানি দেয় তার সান্নিধ্য নেওয়ার জন্য।