বাংলাদেশের শ্রমবাজারের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ। বর্তমানে প্রায় ১০ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি সেখানে কর্মরত, যারা দেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্সের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। বলা হয়, এটিই বিশে^র দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই শ্রমবাজার সংকুচিত হচ্ছে, বিশেষ করে ভিসা সমস্যার কারণে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাম্প্রতিক সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর নিয়ে প্রবাসীদের মধ্যে ব্যাপক প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল।
সঞ্চারিত আশা আরও বেড়ে যায় এই সফরের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়ার দিন বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলন থেকে। এই সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আজাদ মজুমদার জানান, এই সফরে প্রধান উপদেষ্টা আরব আমিরাতের রাষ্ট্র প্রধানদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। বাংলাদেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়সহ ভিসা জটিলতা নিরসন এবং শ্রম রপ্তানি নিয়ে আলোচনা হবে। এতেই প্রবাসী বাংলাদেশিরা আশান্বিত হন যে, তাদের দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধান হতে পারে। তবে সফর শেষে দেখা যায়, প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবতার তেমন কোনো মিল হয়নি। প্রবাসীরা কোনো সুস্পষ্ট সমাধান বা আশার আলো পাননি, যা তাদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করেছে। এসব নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা ও সফরের নানা দিক তুলে ধরার চেষ্টা করব এই লেখায়।
প্রধান উপদেষ্টার দুবাই সফর আর সবার মতো একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে আমার কাছেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে দুবাই এয়ারপোর্টে তাকে অভ্যর্থনা জানানোর মুহূর্তটুকুও মিস করতে চাইনি। গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে দুবাই পৌঁছুলে এয়ারপোর্টে তাকে অভ্যর্থনা জানান, দেশটির ক্রীড়ামন্ত্রী ড. আহমেদ বেলহোল আল ফালাসি। এ সময় ক্রীড়ামন্ত্রীর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথপোকথন হয় ড. ইউনূসের।
তবে সেখানে কোনো গণমাধ্যমকর্মীকে প্রবেশের অনুমতি না দেওয়ায় সরাসরি তেমন কিছু জানার সুযোগ হয়নি। পরবর্তীতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিবের বরাতে জানতে পারি, এয়ারপোর্টের আল মাজলিশ লাউঞ্জে এই আলোচনায় মূলত শুভেচ্ছা বিনিময় ও ওয়ার্ল্ড গভর্মেন্ট সামিট ২০২৫ সম্পর্কে ধারণা তুলে ধরেন আহমেদ বেলহোল। এ ছাড়া সেখানে মূলত ভবিষ্যতের অর্থনীতি, প্রযুক্তি, শিক্ষা, টেকসই উন্নয়ন এবং বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা হয়। আলোচনা হয় দুই দেশের মধ্যে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি নিয়ে মতবিনিময় করেন। তবে সফরে প্রবাসীদের প্রত্যাশিত ভিসা সমস্যা ও শ্রম রপ্তানি নিয়ে কোনো কার্যকর আলোচনা হয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়।
বিশেষ সাক্ষাৎকারমূলক সেশন ও আলোচনার মূল বিষয়বস্তু
ওয়ার্ল্ড গভর্মেন্ট সামিটের শেষ দিন দুপুরে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে বিশেষ সাক্ষাৎকারমূলক একটি পর্ব রাখা হয়। যেখানে সিএনএনের সাংবাদিক বেকি এন্ডারসনের মুখোমুখি হন প্রধান উপদেষ্টা। যে আলোচনায় মূলত ছাত্র আন্দোলনের কথা, বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, পতিত সরকারের ব্যাপক অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি ও বর্তমান পরিস্থিতি এবং জাতীয় নির্বাচনের ফিরিস্তি নিয়ে আলোচনা হয়।
তবে ১২ মিনিটের সেই আলোচনার মধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ডিসেম্বরে নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের হাতে দায়িত্বভার বুঝিয়ে দিয়ে নিজের কাজে ফিরে যেতে চাই। এই পয়েন্টটিই সবাই কোড করে আলোচনায় এনেছেন। গণমাধ্যমকর্মীদের কাছেও এই মুহূর্তে এটিই আলোচ্য বিষয় মনে হয়েছে। আর এখানেই প্রত্যাশিত আলোচনার সমাপ্তি ঘটেছে বলে মনে হয়েছে আমার। অবশ্য, প্রফেসর ইউনূসের ওই সেশন চলমান অবস্থায় অনুষ্ঠানস্থলে হাজির হন আরব আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী ও দুবাই শাসক শেখ মুহাম্মদ বিন রশিদ আল মাখতুম। যে কারণে নির্ধারিত সময়ের আরও কয়েক মিনিট বাকি থাকতেই মঞ্চ ছাড়তে হয় অতিথি ও উপস্থাপিকাকে। হয়তো শেষ মুহূর্তে কিংবা সাইড লাইনে কাক্সিক্ষত বিষয় সমূহ নিয়ে আলোচনা হতেও পারে বলে ভাবছিলাম।
রাতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব ও উপ প্রেস সচিবের এক সংবাদ সম্মেলনে জানতে পারি, এখনি এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। লাগতে পারে আরও সময়। আর যে আলোচনার কথা আমরা বলে আসছি, তা নিয়ে খুব কার্যকরী কোনো ফলাফল আসেনি এই সফরে। সাইড টেবিলের আলোচনায় বাংলাদেশে বিনিয়োগ, আমদানি রপ্তানি ও রাজনৈতিক সম্পর্কোন্নয়নই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে তার এই সফরে। সেই সঙ্গে ইলন মাস্কের সঙ্গে ফোনালাপের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে প্রচারের অনুরোধ জানানো হয়।
প্রবাসীদের প্রত্যাশা ও বাস্তবতা
বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে ভিসা জটিলতা, চাকরির নিরাপত্তাহীনতা এবং নতুন শ্রমিকদের জন্য সুযোগ সংকুচিত হওয়া অন্যতম। সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকার বর্তমানে দক্ষ কর্মীদের বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছে, ফলে অদক্ষ ও স্বল্প দক্ষ বাংলাদেশি শ্রমিকদের সুযোগ কমছে। সফরের আগে প্রবাসীরা আশা করেছিলেন যে, ভিসা জটিলতার সমাধান হবে, নতুন শ্রমবাজার উন্মুক্ত হবে, বাংলাদেশি শ্রমিকদের সুযোগ বাড়বে, নিরাপদ অভিবাসনের পথ সুগম হবে।
কিন্তু সফর শেষে দেখা গেছে, এসব বিষয়ে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। সফরের আগে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলোর বাস্তবায়ন না হওয়ায় প্রবাসীদের মধ্যে তীব্র হতাশা তৈরি হয়েছে। অনেকেই মনে করেন, শ্রমবাজার সম্প্রসারণে বাংলাদেশ সরকারের আরও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
সাধারণ প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে যেটা মনে হয়েছে, বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সমাধান আনতে বেশ কিছু কাজ করা জরুরি। এরমধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে ভিসা সংক্রান্ত নীতি শিথিলের চেষ্টা করা অন্যতম। দেশে-বিদেশে মিশনগুলোতে দক্ষতা উন্নয়ন প্রোগ্রাম চালু করা, যাতে শ্রমিকরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেন। শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধান করা। উভয় দেশের মধ্যে একটি শ্রমচুক্তি করা, যা বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সুযোগ তৈরি করবে।
সব মিলিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারণী দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলেও, প্রবাসী বাংলাদেশিরা তাদের প্রত্যাশিত সমাধান পাননি। সফর নিয়ে যে উচ্চাশা তৈরি হয়েছিল, তা বাস্তবায়িত হয়নি। বিশেষ করে, ভিসা সমস্যা ও শ্রম রপ্তানির ক্ষেত্রে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি না হওয়ায় প্রবাসীদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে। ভবিষ্যতে সরকারকে শুধু আনুষ্ঠানিক সফরে সীমাবদ্ধ না থেকে বাস্তবসম্মত ও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে প্রবাসী বাংলাদেশিরা তাদের ন্যায্য অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা পান।