প্রবাসীদের বিমান টিকিট নিয়ে চাই কার্যকরী পদক্ষেপ

শাফায়েত উল্লাহ

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২৫, ০১:৫৪ পিএম

প্রবাসীদের বিমান টিকিট নিয়ে চাই কার্যকরী পদক্ষেপ

ছবি: সংগৃহীত

দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি প্রবাসীরা। তারা বছরের পর বছর পরিবার-পরিজন ছেড়ে পরদেশে কঠোর পরিশ্রম করেন, অথচ যখন দেশে ফেরার প্রয়োজন পড়ে, তখনই বাধার দেয়াল হয়ে দাঁড়ায় বিমান টিকিটের আকাশছোঁয়া মূল্য! সাম্প্রতিক সময়ে বিমান টিকিটের দাম এমন উচ্চতায় পৌঁছেছে যে, প্রবাসীদের অনেকেই স্বপ্ন দেখলেও দেশে ফেরা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে, নতুন কর্মসংস্থানের আশায় বিদেশ পাড়ি দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া অনেক কর্মীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।

বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরগামী যাত্রীদের জন্য টিকিটের মূল্য কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে হাজারো প্রবাসী দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। অনেকেই বাধ্য হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল বিকল্প পথে দেশে ফেরার চেষ্টা করছেন, যা ভবিষ্যতে আরও বড় সংকটের কারণ হতে পারে। এই প্রতিবেদনে বিশ্লেষণ করা হয়েছে টিকিটের মূল্যবৃদ্ধির কারণ, প্রবাসীদের প্রতিক্রিয়া এবং সম্ভাব্য সমাধান।

বিশেষজ্ঞদের মতে, টিকিটের এই মূল্যবৃদ্ধির পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ কাজ করছে। তার মধ্যে রয়েছে: বর্ধিত কর ও শুল্ক, ডলার সংকট, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, সিন্ডিকেটের কারসাজি ও মৌসুমী প্রভাব।  জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটের বিমান টিকিটের ওপর আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি করেছে। ফলে আন্তর্জাতিক রুটে শুল্ক ৫০০ টাকা থেকে বেয়ে ১,০০০ টাকা করা হয়েছে, যা যাত্রীদের ব্যয় বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

অপরদিকে ডলার সংকটের কারণে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলো তাদের মুনাফা বাংলাদেশ থেকে স্থানান্তর করতে পারছে না। ফলে তারা টিকিট বিক্রি সীমিত করে দিয়েছে, যা সরাসরি মূল্যবৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রয়েছে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব। জেট ফুয়েলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে এয়ারলাইন্সগুলোর পরিচালন ব্যয় বেড়েছে, যার প্রভাব পড়েছে টিকিটের দামে। সবকিছুর মূলে অসাধু টিকিট সিন্ডিকেটের রাজসিক ঘোড়ার লাগাম তো আজও টানা গেল না। অভিযোগ রয়েছে, কিছু এয়ারলাইনস ও ট্রাভেল এজেন্সির সমন্বিত সিন্ডিকেট কৃত্রিম সংকট তৈরি করে টিকিটের দাম বাড়াচ্ছে।

অনেক ট্রাভেল এজেন্সি নির্দিষ্ট সংযোগের মাধ্যমে টিকিট বুকিং করছে এবং সাধারণ যাত্রীদের জন্য টিকিট পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। মৌসুমী চাপকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা লুটতে আর প্রবাসীদের পকেট কাটনে মুনশিয়ান তারাই। ঈদ, ছুটির মৌসুম এবং শিক্ষা কার্যক্রমের পরিবর্তনের কারণে বছরের শেষ ও শুরুর সময়ে যাত্রীদের চাপ অনেক বেশি থাকে, যার ফলে এয়ারলাইনসগুলো সুযোগ নিয়ে অতিরিক্ত মূল্য আদায় করছে।

প্রবাসীদের প্রতিক্রিয়া

বিমান ভাড়ার চরম মূল্যবৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন প্রবাসী শ্রমিকরা। অনেকেই দেশে ছুটি কাটাতে চাইলেও উচ্চমূল্যের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। আবার নতুন চাকরির জন্য যারা বিদেশ যেতে প্রস্তুত, তারাও এই বাড়তি খরচের চাপে পড়েছেন। সৌদি আরবের রিয়াদ প্রবাসী রায়হান উদ্দীনের সঙ্গে কথা হয় এসব নিয়েই। তিনি বলেন, প্রতিবছর রমজান ও ঈদের সময় দেশে যাওয়ার ইচ্ছে থাকে, কিন্তু এবার টিকিটের দাম এত বেশি যে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আগের তুলনায় টিকিটের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইপ্রবাসী আনিস উদ্দীন বলেন, আমি গত ছয় বছর ধরে দেশে যাইনি। এবার যাওয়ার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু টিকিটের দাম শুনে সিদ্ধান্ত বদলাতে হলো।

অনেকে এই পরিস্থিতিতে অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ উপায়ে ভ্রমণের কথা ভাবছেন, যা তাদের জন্য আরও বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে। বিমান টিকিটের মূল্যবৃদ্ধি শুধু তাদের ব্যক্তিগত সমস্যাই নয়, বরং পরিবারের সদস্যদের জন্যও এক দুঃসহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে নিম্নআয়ের প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য এটি আরও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে।
প্রবাসীদের এই দুর্দশার কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহও প্রভাবিত হতে পারে বলে অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন। যদি প্রবাসী কর্মীরা বারবার এই ভোগান্তির শিকার হন, তবে তারা বিকল্প ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবেন। অনেক প্রবাসী এখন মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ হয়ে বিকল্প পথে দেশে ফেরার চেষ্টা করছেন, যা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল।

সরকারের উদ্যোগ ও সুপারিশ

সরকার ইতোমধ্যে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে: সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর কার্যক্রম মনিটরিং করা, বিমান সংস্থাগুলোর টিকিট মূল্য নির্ধারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠন, ডলার সংকট নিরসনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিশেষ ফান্ড গঠন করার চিন্তাভাবনা করছে, যাতে প্রবাসীদের জন্য বিশেষ ছাড় বা ভর্তুকি দেওয়া যায়, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রবাসীদের জন্য বিশেষ ছাড়ের টিকিট বরাদ্দের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এয়ারলাইনস ও ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর ওপর আরও কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। পাশাপাশি, সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গেও আলোচনা করে বিমান ভাড়ার বিষয়ে সমাধান খুঁজতে হবে। সর্বোপরি প্রবাসী শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। তাদের স্বার্থ রক্ষা করা সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। বিমান টিকিটের এই মূল্যবৃদ্ধি শুধু তাদের ভোগান্তিই বাড়াচ্ছে না, বরং দেশের বৈদেশিক আয়ের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে। তাই টিকিটের দাম নিয়ন্ত্রণে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য বিমান ভাড়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা নিশ্চিত করতে হলে সরকারের আরও কার্যকর নীতি গ্রহণ করতে হবে।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!