সৌদি আরব ও বাহরাইনের মধ্যে সংযোগের প্রতীক কিং ফাহদ কসওয়ে ২০২৪ সালে যাত্রী চলাচলের এক নতুন রেকর্ড গড়েছে। ১৯৮৬ সালে উদ্বোধনের পর থেকে এই সেতু দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক ও পর্যটনের ক্ষেত্রে এক অমূল্য সংযোগ হিসেবে কাজ করছে। ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু বছরের পর বছর ধরে শুধু ভ্রমণের মাধ্যম নয়, বরং দুই দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বন্ধন মজবুত করার এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
সেতুর দৈর্ঘ্য ও নির্মাণ শৈলী
কিং ফাহদ কসওয়ের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২৫ কিলোমিটার, যার মধ্যে ১৪ কিলোমিটার সৌদি আরবের অংশে এবং ১১ কিলোমিটার বাহরাইনের অংশে অবস্থিত। সেতুটি সৌদি আরবের খোবর শহরকে বাহরাইনের আল-জাসরা শহরের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। নির্মাণে প্রায় ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হয়েছিল, যা সম্পূর্ণভাবে সৌদি আরবের তৎকালীন বাদশা ফাহাদ বিন আব্দুল আজিজ আল সৌদ বহন করেছিলেন।নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৮১ সালে এবং শেষ হয় ১৯৮৬ সালে।
সেতুটি নির্মাণে আধুনিক প্রযুক্তি ও নকশা ব্যবহার করা হয়েছে, যা আরব উপসাগরের ওপর দিয়ে একটি স্থিতিশীল ও নিরাপদ সংযোগ স্থাপন করেছে। সেতুর মাঝামাঝি স্থানে একটি চেকপয়েন্ট রয়েছে, যেখানে দুই দেশের ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এ ছাড়া, সেতুর মাঝখানে আধুনিক রেস্তোরাঁ এবং পর্যবেক্ষণ ডেক রয়েছে, যেখানে ভ্রমণকারীরা থেমে সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন।
২০২৪ সালের রেকর্ড যাত্রী চলাচল
২০২৪ সালে কিং ফাহদ কসওয়ে দিয়ে ৩৩ মিলিয়নেরও বেশি যাত্রী পারাপার করেছেন, যা এই সেতুর ইতিহাসে সর্বোচ্চ বার্ষিক যাত্রী চলাচল। এই সংখ্যা শুধু সেতুর জনপ্রিয়তাই প্রমাণ করে না, বরং সৌদি আরব ও বাহরাইনের মধ্যে বাড়তে থাকা যাতায়াতের গুরুত্বও স্পষ্ট করে। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালীন ছুটি এবং ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার সময় এই সেতু দিয়ে ব্যাপক ভিড় দেখা যায়।
উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়া: দ্রুত ও সহজ পারাপারের নতুন দিগন্ত
যাত্রীদের অভিজ্ঞতা আরও মসৃণ ও আরামদায়ক করতে কিং ফাহদ কসওয়ে কর্তৃপক্ষ নানা ডিজিটাল সেবা চালু করেছে। ২০২০ সালে চালু হওয়া ই-পেমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে গাড়ি, ট্রাক ও মোটরসাইকেলের চালকরা নগদ অর্থ ছাড়াই ডিজিটাল পদ্ধতিতে টোল পরিশোধ করতে পারছেন। এর ফলে টোল বুথে সময় অপচয় হচ্ছে না এবং যাত্রীরা খুব দ্রুত পারাপার করতে পারছেন।
২০২৪ সালে চালু হওয়া ঊ-ঔঊঝজ অ্যাপ প্রযুক্তিগত অগ্রগতির আরেকটি উদাহরণ। এই অ্যাপের মাধ্যমে প্রিপেমেন্ট সিস্টেমের ব্যবহার ৫৫% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে টোল গেটে পার হতে যেখানে গড়ে ১৫ সেকেন্ড সময় লাগত, সেখানে এখন সময় নেমে এসেছে মাত্র ৩ সেকেন্ডে। এই প্রযুক্তির ফলে সেতু পারাপার এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি দ্রুত ও সুবিধাজনক হয়েছে।
এ ছাড়া সেতুর বিভিন্ন গেটে স্বয়ংক্রিয় ট্রানজিট সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে, যা ব্যবহারকারীদের কর্মীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ছাড়াই পারাপারের সুযোগ করে দিচ্ছে। ফলে ট্রাফিক জ্যাম কমছে এবং পারাপার প্রক্রিয়া আরও মসৃণ হচ্ছে।
অর্থনৈতিক ও পর্যটনে ইতিবাচক প্রভাব
কিং ফাহদ কসওয়ে শুধু যাত্রী চলাচলের জন্যই নয়, দুই দেশের অর্থনীতির জন্যও এক গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো। এই সেতুর মাধ্যমে সহজে ও দ্রুত পণ্য পরিবহন সম্ভব হচ্ছে, যা সৌদি আরব ও বাহরাইনের লজিস্টিক সেক্টরকে আরও গতিশীল করেছে। একইসঙ্গে পর্যটন শিল্পেও এই সেতুর ভূমিকা অপরিসীম।
প্রতিবছর সৌদি পর্যটকদের একটি বড় অংশ বাহরাইনে ভ্রমণের জন্য এই সেতু ব্যবহার করেন। বিশেষ করে সপ্তাহান্তে ও ছুটির দিনে বাহরাইনের শপিং মল, সমুদ্র সৈকত ও বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে সৌদি পর্যটকদের উপস্থিতি দেখা যায়। এই সেতু দুই দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশে বড় অবদান রাখছে।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন
কিং ফাহদ কসওয়ে কর্তৃপক্ষ সেতুটির সেবার মান আরও উন্নত করতে একাধিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ডিজিটাল সেবার পরিধি আরও বাড়ানো, আধুনিক অবকাঠামো উন্নয়ন এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে যাত্রীদের অভিজ্ঞতা আরও সহজ ও আরামদায়ক করার চেষ্টা চলছে।
নতুন নতুন প্রযুক্তি সংযোজনের মাধ্যমে ভবিষ্যতে সেতু পারাপারের সময় আরও কমিয়ে আনা এবং ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।