ঘুরতে কে না ভালবাসে। দেশে অনেক জায়গায় বেড়ানোর সুযোগ হয়; অনেকেই ভ্রমনের জন্য বেছে নেন বিদেশকে। সাধ্যের ভেতর অনেকের প্রথম পছন্দ ইউরোপ। সেখানকার শীতল আবহাওয়া আর সবুজ শ্যামল পরিচ্ছন্ন পরিবেশের কারণে। কিন্তু সাধ থাকলে ও সাধ্য তো সবার সমান নয়। আমি আজ সাধ্যের ভেতর এমন একটা দেশের কথা বলছি যেখানে ইউরোপ ভ্রমণের পূর্ণ অনুভূতি পাওয়া যাবে। আমি বলছি মধ্যপ্রাচ্যের মরুময় দেশ ওমানের একটি বিশেষ অঞ্চলের কথা; নাম সালালাহ। জুন- জুলাই আগস্ট মাসে যখন আরব দেশগুলোর মানুষ ৪৫/৫০ ডিগ্রির তাপমাত্রায় হাঁসফাঁস করতে থাকে তখন ওমানের এই প্রদেশের তাপমাত্রা থাকে মাত্র ২২ ডিগ্রির নিচে।
আমিসহ তিনবন্ধু সাংবাদিক জাহাঙ্গীর কবীর বাপ্পী, ব্যাংক ব্যবস্থাপক জাফর ভূঁইয়া সিদ্ধান্ত নিলাম আবুধাবী থেকে সরাসরি গাড়ি চালিয়ে সালালায় যাব। ওমান-ইয়েমেন সীমান্তবর্তী শহর সালালাহ এর পথে ছুটছি। টানা ৫শ` কিলোমিটার গাড়ী চালিয়ে ড্রাইভিং সিট থেকে নামলাম; পথ বাকি আরো ১ হাজার ১৬ কিলোমিটার। শুনতে সহজ হলে ও টানা ড্রাইভ করা অতটা সহজ নয়।এ পথের যেন কেবল শুরুই আছে শেষ নেই। ইয়েমেনের হাজরামাউত থেকে শুরু হয়ে এই "রুব আলখালি" মরুভূমি গোটা ওমানের বুক চিরে আমিরাত হয়ে সৌদি আরবে গিয়ে মিশেছে। আয়তনে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম এই মরুভূমির পথে আমরা মুসাফির। প্রচন্ড গরম আর পাহাড়ি আঁকাবাঁকা সীমিত গাড়ির গতির রাস্তা; এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে কখনো মসজিদে নামাজ শেষে সামান্য বিশ্রাম করেছি, চা খাওয়ার ছলে রেস্তোরায় বসে ঝিমিয়েছি, অবশেষে গভীর রাতে সালালাহ এর প্রবেশ পথে আসতেই প্রকৃতির অদ্ভুত খেলা প্রত্যক্ষ করলাম।আবহাওয়া সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেল। যদি ও গাড়ির তাপমাত্রার মিটার একটু একটু করে কমছিল ,কিন্তু এই অলৌকিক পরিবর্তন প্রত্যাশার বাইরে ছিল। পুলিশ গাড়ি থামিয়ে ডাবল এন্টিগেটর ও ফগ লাইট জ্বালিয়ে ২০ কিলোমিটার গতিতে সামনে যাওয়ার নির্দেশনা দিলেন। ঘন ও গভীর কুয়াশায় আমরা দশহাত দুরের বস্তু ও দেখতে পাচ্ছিনা, দুটো বিষয় মনে পড়লো (১)বছর খানেক আগে এক্সপোতে নিউজিল্যান্ডের এক্সিবিউশনে গিয়েছিলাম। তাদের দেশের আবহাওয়ার বাস্তবতা বুঝাতে তুষার হিম কুয়াশায় ঢাকা পথ বেয়ে আমাদের উপরে নিয়ে যাচ্ছিল। সেদিন ভাবছিলাম এই আবহাওয়া শুধু ইউরোপেই সম্ভব। অথচ আজ তা মরুদেশ ওমান সীমান্তে নিজেই স্বাক্ষী হলাম। গত ২৪ ঘন্টা সফরের কষ্ট মুহূর্তে বিলীন হয়ে গেলো।(২) গত ১০ ঘন্টা আগে একই দেশের মাস্কাট শহরে ৪১ ডিগ্রি তাপে গাড়ির এসি বিকল হবার দশা। সেই একই দেশে কি বিপরীত ও বৈচিত্র্যপুর্ণ আবহাওয়া। কল্পনা করতে যায় এই মরুভূমির দেশের একটি শহরের প্রবেশ পথ আপনাকে স্বাগত জানাবে হিম শীতল কুয়াশা আর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি । হোটেলে উঠে দীর্ঘ সফরের ক্লান্তি কাটাতে পরের দিনের পরিকল্পনা প্রস্তুত করে শুয়ে পড়লাম।
পরের দিনটা জিয়ারত করে কাটালাম। জু`মা পড়েই সালাম পেশ করতে গেলাম নবী আইয়ুব আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাজারে। প্রায় তিন কিলোমিটার পাহাড়ের খাড়া রাস্তা মাড়িয়ে চূড়ার উপর নবীর মাজার। আল্লাহর পরীক্ষা স্বরুপ তাঁর সমস্ত শরীরে দুরারোগ্য রোগে পচন ধরেছিল আর তিনি নির্জন পাহাড়ের চুড়ায় কেবল আল্লাহর প্রশংসায় মগ্ন ছিলেন।অবশেষে আল্লাহর নির্দেশে যে কুয়ার পানিতে গোসল করে তিনি দুরারোগ্য রোগ থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন, সেই কুয়া আজও বিদ্যমান। পাহাড়ের গাঁ বেয়ে আজও নামছে রহমতের পানি, মানুষ সেই পানিতে অজু এবং গোসল করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে।সুউচ্চ পাহড়ের চূড়ার একটি স্টলে বিকালের চা পান করছিলাম, আমরা তখন মেঘের উপরে। মেঘের ঠান্ডা পানির ঝাপটা আমাদের ভিজিয়ে দিচ্ছিল বার বার। এবার আমাদের যাত্রা এক আশেকে নবী হযরত ওয়েজ কুরনি (র) মাজারে। পাহাড়ঘেরা এক নির্জন উপত্যকায় এই নবী প্রেমিকের কবরে সালাম দিয়ে রওয়ানা হলাম সমুদ্র উপকূল ’রসুদে’। যেখানে আল্লাহর আদেশে নবী ইউনুস (আঃ) কে মাছ তার নিজের পেট থেকে বাইরে বের করে দিয়েছিল। উত্তাল সমুদ্রকূলের এই নিদর্শন দেখা শেষে স্ব-দলবলে রওনা হলাম নবী ইমরান ( আ:) এর মাজারে। সালালাহ সিটি সেন্টারের কাছেই মাজারটি অবস্থিত । হযরত ইমরান (আ:) ছিলেন হযরত মরিয়ম (আ:) এর পিতা এবং হযরত ঈসা (আ:) এর মাতামহ। তাঁর মাজারটি ১০৮ ফুট দীর্ঘ। ইসলাম ধর্মাবলম্বী ছাড়াও খ্রীস্ট ধর্মের ও অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের সমাগম দেখা গেল।
পরদিন আমাদের গন্তব্য পাহাড়ী ঝরণা ওয়াদী আল দারাবাত। শহর থেকে প্রায় ৬৪ কিলোমিটার দূরে এই অপরুপ প্রাকৃতিক পাহাড়ি ঝর্ণা না দেখলে সালালাহ সফর পূর্ণ হবে না। দীর্ঘপথ এমন পরিচ্ছন্ন এবং সাজানো গোছানো, মনে হবে ইউরোপের কোন রাস্তায় চলছি। এখানে প্রতিদিন রিমঝিম বৃষ্টি নামে, ফলে সবুজ শহরের পাশাপাশি পাহাড় ও সবুজের সমারোহ। পাহাড় বেয়ে প্রাকৃতিক ঝরণা নেমে তৈরী হয়েছে বড় স্বচ্ছ জলাধার। স্থানীয় ভাষায় তারা এটাকে বলে ওয়াদী। সেখানে সৌখিন ভ্রমণ পিপাসুরা ছোট ছোট নৌকা চালিয়ে, সাঁতার কেটে প্রশান্তি পায়। পাহাড়ে চিরসবুজ গাছপালার ঘন বনে দেখা মেলে হরিণ সহ নানা রকম প্রাণীর। এখানে দেখা মিলবে প্রায় ৩০ প্রজাতির পাখি। আইন আতুম,তাউ আতুর,আইন আল রজত সহ আরো বেশ কয়েকটি নয়নাভিরাম পাহাড়ী ঝরণা আছে সালালায়।
সারি সারি নারিকেল ও কলার বাগান দেখে মনে হলো আরেকটি বাংলাদেশ। ইয়েমেন সীমান্তবর্তী ভূস্বর্গ সালালায় এই খারিফ বা বর্ষা ঋতুতে সাগরপাড়ের দারিস -এ বাংলাদেশি ফল ব্যবসায়ীরা কয়েকশ ফলের দোকান খুলে বসে জাঁকিয়ে ফলমূলের ব্যবসা করছেন । যেখানে নানা ধরণের আম,জাম,লিচু, কাঁঠাল,আনার,পেঁপে,কলা,কচি ডাব,আনারস,আতা,তরমুজ, বাঙ্গি,কমলা,পেয়ারা,কাঠবাদাম সহ আরও অনেক কিছু পাওয়া যায়।মজার বিষয় হলো -চাপা কলা, সবরি কলা, সাগর কলাসহ যত ফল এখানে পাওয়া যাচ্ছে তার বেশীর ভাগই কিন্তু বাংলাদেশিদের শ্রমে-ঘামে উৎপন্ন এবং বাংলাদেশীদের দোকানে বিকিকিনি হচ্ছে। হাজার কিলোমিটার দূরে মরু বালুকাবেলার দেশে একটি বাংলাদেশ খুঁজে পেয়ে, মরুর বুকে সবুজ ফোটানো দেশের মানুষদের সাথে সুখ দুঃখের আলাপনে তোমাদের মন ও পুলকিত হবে।
যাদুঘরের প্রতি আমার যাদুময়ী দুর্বলতা। এক সময় ইয়েমেন ভাগে থাকা সালালাহ যাদুঘরে কি আছে আমার তা জানা ছিল না। কিন্তু চৌম্বক টান ছিল যাদুঘরে যাওয়ার। রাতে হোটেলের প্রশস্ত বৈঠকঘরে আয়েশি মেজাজে বসে আগামী কালের ছক আঁকলাম। প্রথমে যাব যাদুঘরে, বন্ধুরা এক কথায় সায় দিলেন। যে কথা সেই কাজ, আমাদের ছোট গাড়িটিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন সালালাহ বিদ্যুৎ সেক্টরের অন্যতম প্রধান প্রকৌশলী আজাদ সাহেবের বিলাসী পাজেরো;যিনি বিদেশে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। কিন্তু সুঠাম অস্ত্রধারী পুলিশ সটান পথরোধ করে জানিয়ে দিল আজ ছুটি, তাই বন্ধ আজ ইতিহাসের কারাগারটি। আমার চেহারায় ঘাম জমে উঠলো। কিন্তু বেচারা একেবারে নিরাশ করলেন না। তিনি জানালেন "বেলা তিনটার পর বিশেষ ব্যবস্থায় পরিদর্শন করা যাবে যাদুঘর"। আমাদের দিনের পরিকল্পনা কিছুটা কাটছাট করে যাদুঘর দেখার সিদ্ধান্তে স্থির থাকলাম এবং যথা সময়ে হাজির হলাম। শান্ত স্বচ্ছ পানির লেকের পাশে চমৎকার স্থাপত্য নিদর্শনের সৌন্দর্যমন্ডিত এই যাদুঘর ভবনটি। হঠাৎ চোখ আটকে গেল কাঁচের বাক্সের চমৎকার সুদৃশ্য স্ট্যান্ডের উপর রাখা একটি চিঠির দিকে। নিচে রাসুল (সঃ) ব্যবহৃত সেই মোহরের ছাপ, সেই সোনালী আভা, শরীরে শীতলতা অনুভব করলাম। স্বয়ং আল্লাহর রাসুল (সঃ) এই চিঠির প্রেরক, বাহক ছিলেন তাঁর প্রিয় সাহাবী আমর ইবনুল আস আর তিনি চিঠিটি পৌঁছে দিয়েছিলেন ওমানের তৎকালীন যৌথ শাসক দুই ভাই যাইফর এবং অবদ’র কাছে। এই চিঠিটি ওমানের মানুষকে ইসলামের সন্ধান দিয়েছিল।
একটি লোবান (লোবান গাছ থেকে দুনিয়ার সেরা সুগন্ধি উৎপাদন হয়) গাছের চারপাশ ঘিরে চমৎকার ভবনে মুলত দুটো প্রধান হল-মেরিটাইম হল এবং অপরটি হিস্ট্রি হল। মেরিটাইম হল এ প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকে নৌকার উদ্ভব, ক্রমবিকাশ থেকে আধুনিক মেরিন শিল্প পর্যন্ত তুলে ধরা হয়েছে। এটি বাত্তিল, বুম, সাম্বুক, গঞ্জার মতো ওমানি নৌকাগুলির সুন্দর কারুকাজ করা কাঠের মডেলগুলি দিয়ে সাজানো হয়েছে। এছাড়াও নেভিগেশনাল যন্ত্র এবং অন্যান্য অনুরূপ জিনিস দেখা যাবে এই হলে।
হিস্টোরী হলে ৮ম শতাব্দীতে পাঠানো রাসুল (সঃ) চিঠি ছাড়াও রয়েছে হাতে লেখা পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি, অন্যান্য কবিতা এবং ভাষাগত পাণ্ডুলিপি। এছাড়া হলটিতে ওমানের বিভিন্ন মসজিদ ও সমাধির মডেল রয়েছে। নবী আইয়ুবের সমাধি, নবী হুদ এবং নবী সালেহ এবং সুলতান কাবুস গ্র্যান্ড মসজিদের মডেল দেখা যাবে হলটিতে।
সালালাহতে পাঁচটা সি বীচ রয়েছে, একটার চেয়ে আরেকটার সৌন্দর্যের কমতি নেই। আমরা যেহেতু সাগর দেশেই থাকি তাই কেবল মুগছেল বীচ-ই আমাদের গন্তব্য। এত চমৎকার বীচ আমি এখনো দেখিনি। ধবধবে সাদা বালিতে নীল জলরাশি। সেখানে পিকনিক এবং সমুদ্র ড্রাইভ করার জন্য চমৎকার জায়গা। এখানে সারি সারি ঘর বুকিং নিয়ে পারিবারিক ভোজন সেরে নিতে পারবে অনায়াসে।
সালালাহ সফরে সুলতান কাবুস মসজিদ না দেখলে অবশ্যই আক্ষেপ থাকবে। বিস্তৃত জমিনের উপর নয়নাভিরাম মসজিদ দেখলেই তোমাদের চোখ শীতল হবে। হাতে বোনা কার্পেট এবং দেয়ালের জটিল নিদর্শন সহ, সুলতান কাবুস মসজিদের বিস্তৃত নকশা দর্শনার্থীদের মোহিত করে।সুলতান কাবুস মসজিদ, সালালার বৃহত্তম মসজিদ এবং ২০০৯ সালে সমাপ্ত, একটি বিশাল স্ফটিক ঝাড়বাতি এবং সূক্ষ্ম রং, হাতে বোনা কার্পেট, বিস্তৃত প্রাচীরের নিদর্শন, আকর্ষণীয় মাঠ এবং সাদা-ও-সোনা-অলঙ্কৃত গম্বুজ এবং মিনার সহ একটি চমৎকার ডিজাইন করা পুরুষ এবং মহিলাদের জন্য পৃথক নামাজের কক্ষ রয়েছে।
কিভাবে যাওয়া যায়: বাংলাদেশ থেকে টুরিস্ট ভিসা পাওয়া যায়।বাংলাদেশে ওমানের দূতাবাস রয়েছে। তবে বোয়েসেল অনুমোদিত এজেন্সি সমূহ ওমানে ভিজিট ভিসার ব্যবস্থা করে। তাছাড়া অনলাইনে আবেদন করে ও সংগ্রহ করা যায় ওমানের ভিজিট ভিসা। সালালাহ শহরে আন্তজার্তিক বিমান বন্দর আছে। চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি সাপ্তাহিক দুইটা ফ্লাইট আছে। এছাড়া ঢাকা থেকে রাজধানী মাস্কট আসার পর, মাস্কট থেকে অভ্যন্তরীণ বিমানে সালালাহ য্ওায়া যায় ।এছাড়া যারা মধ্যপ্রাচ্যের দেশে অবস্থান করছেন তারা সড়ক পথে বা বিমানযোগে সরাসরি ঐতিহ্যসমৃদ্ধ শহর সালালাহ যাওয়া যায়।
আপনার মতামত লিখুন :