মিসর ভ্রমণে আজ আমাদের দ্বিতীয় দিন। সবে ভোর ভেঙে দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছ। ক্রিং ক্রিং শব্দে ইন্টারকমে রিং হচ্ছে। বন্ধু লুৎফর ছাড়া আর কে হবে? ঢুলু ঢুলু চোখে রিসিভার কানে ধরলাম। ওপার থেকে লুৎফরের কণ্ঠ ভেসে এলো।
-গুড মর্নিং ফরহাদ। রাতে ঘুম কেমন হলো?
আমি বললাম, বেশ ভালো। তুমি এত সকালে কেন ঘুমের পিছে পড়লে?
-তোমার জন্য সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে দেখ। আরে দেখ দেখ। ঘুরতে এসে এতো ঘুমালে চলবে?
কানে রিসিভার রেখেই জানালার ভারী ভেলভেটের পর্দা সরিয়ে আমার চক্ষু ছানাবড়া। আনন্দের আতিশয্যে ‘ওয়াও’ বলে চিৎকার করে উঠলাম। হোটেলের অনতিদূরেই সারি বাঁধা পিরামিড যেন আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। লুৎফর বলল, আমি ফোন রাখছি। জাস্ট দশমিনিট পর আমাদের ব্যুফে ব্রেকফাস্ট ওপেন হবে। রুফটপে বসে নাশতার সঙ্গে সঙ্গে উপভোগ করব পিরামিডের সৌন্দর্য।
আমিও রিসিভারটি নামিয়ে দ্রুত প্রস্তুত হয়ে রুফটপে চলে এলাম। পুরু নীলকাচে মোড়ানো হোটেলের রুফটপে ব্যুফে ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা, যাতে অতিথিরা এখানে বসে পিরামিডের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। সকালে মিষ্টি রোদ পিরামিডের ওপর পড়ে তার প্রতিফলিত আলো যেন গোটা এলাকায় বিচ্ছুরিত হচ্ছে। হোটেলের সারি সারি সাজানো বুফে খাবার আর মুখে উঠছে না। কত দ্রুত নিচে গিয়ে পিরামিড ছুঁয়ে দেখব তার জন্য আর তর সইছে না।
সংক্ষেপে নাশতা সেরে রুমে গিয়ে তৈরি হলাম। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট সংগ্রহ করে দুস্তরের নিরাপত্তা গেট পার হয়ে পিরামিডের পথে পা বাড়ালাম। পিরামিড এলাকায় প্রবেশ মূল্য ২০০ ইজিপশিয়ান পাউন্ড এবং গ্রেট পিরামিডের ভেতরে প্রবেশের জন্য গুনতে হবে আরও চার’শ ইজিপশিয়ান পাউন্ড। অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এবং এপ্রিল-সেপ্টেম্বরের মাসে প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
কিছুটা নিচু ভূমি থেকে ক্রমে উপরের দিকে উঠে গেছে পিরামিড এলাকা। চত্বরে প্রবেশের পর প্রথম আমাদের চোখ আটকে গেল গ্রেট স্ফিংস ভাস্কর্যের উপর। এটি খাফ্রার পিরামিডের বাইরের দিকে পূর্বদিকে মুখ করে আছে। গ্রিক ও মিসরীয় সভ্যতায় স্ফিংসের বর্ণনা পাওয়া যায়। গ্রিসে স্ফিংসকে নরকের প্রহরী মানা হলেও মিশরে একে উপকারী দেবতা মনে করা হতো। ’
এর শরীরের পেছনের অংশ সিংহের মতো, পিঠে পাখির মতো বড় ডানা এবং মুখমণ্ডল সাধারণত মানুষের মুখ সদৃশ। এক কথায় গ্রেট স্ফিংস হল- সিংহের শরীরে মানুষের মাথা সংবলিত পাথরের বিশাল এক ভাস্কর্য। গ্রেট স্ফিংসের সবচেয়ে বড় আশ্চর্য হলো এর বিশাল আকার। দৈর্ঘ্যে ৭৩.৫ মিটার (২৪১ ফুট), প্রস্থে ৬ মিটার (২০ ফুট) এবং উচ্চতায় ২০.২২ মিটার (৬৬.৩৪ ফুট)। এর পায়ের থাবাগুলো ১৫ মিটার (৫০ ফুট) দীর্ঘ; মাথার দৈর্ঘ্য ১০ মিটার (৩০ ফুট) আর ৪ মিটার প্রশস্ত। অবাক করার বিষয় হল বৃহৎ এই ভাস্কর্যটি একটিমাত্র বিশালাকৃতির চুনাপাথরের খণ্ড খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে যার ওজন আনুমানিক ৩০ হাজার কেজি থেকে ৭০ হাজার কেজি। ছোট কোনো দ্বিতীয় খণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করা হয়নি। এ কারণে গ্রেট স্ফিংসের ভাস্কর্যটিই পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মনোলিথিক ভাস্কর্য। মনুমেন্টাল ভাষ্কর্যের মধ্যে এটিই সবচেয়ে প্রাচীন। প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরাতন গ্রেট স্ফিংস ভাস্কর্যটি আমরা ২০২৪ সালে যেভাবে দেখছি গবেষকদের মতে এটি শতভাগ অবিকৃত নেই। কালের পরিবর্তনে স্ফিংসের মূল আকৃতির কিছু পরিবর্তন হয়েছে। স্ফিংসের ১ মিটার লম্বা নাকটি আজ আর নেই; কথিত আছে নেপোলিয়নের সৈন্যরা গ্রেট স্ফিংসকে নিশানা বানিয়ে কামানের গোলা ছুড়েছিল। ফারাও এর প্রতিমূর্তি স্বরূপ গ্রেট স্ফিংসের দাঁড়ি ও ছিল; কিন্তু বহুদিন আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সেসব। গুটানো অবস্থায় একটি লেজও আছে এই স্ফিংসের। অনেকে মনে করেন, স্ফিংসের মুখাবয়ব রাজা খুফুর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। যা হোক মূল গেট থেকে স্ফিংস হয়ে পিরামিড পর্যন্ত পায়ে হেঁটে যাওয়া কিছুটা কষ্টকর বটে। তবে উটে বা ঘোড়ায় চড়েও যাওয়া যায়। অবশ্যই আগে থেকে দরদাম করে নিয়ে চড়তে হবে। স্ফিংস পার হয়ে পিরামিডের পথ ধরলাম। হাতে বিস্তর সময়, তাই ঘোড়ায় না চড়িয়া ‘মর্দ হাঁটিয়া চলিল’। হাঁটতে হাঁটতে গভীর নস্টালজিয়ায় ডুবে গেলাম। পিরামিড পৃথিবীর প্রাচীন সপ্তম আশ্চর্যের একটি।
ভাবছি পাঁচ হাজার বছর পূর্বের তৎকালীন প্রচণ্ড প্রতাপশালী ক্ষমতাবান, বিদ্বান, শৌর্ষ বীর্যবান আধুনিক মানুষেরা যে পথ ধরে হাঁটতেন পাঁচ হাজার বছর পর আমি এক বাঙালি সন্তান সেই পথের ধুলো মেখে হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে আমরা গ্রেট পিরামিডের কাছাকাছি চলে এসেছি। মনে হয় দিগন্ত জোড়া স্থাপত্য। গ্রেট পিরামিডের উচ্চতা চুড়াসহ প্রায় ৪৮১ ফুট যা ৪২ তলা ভবনের সমান। এটি প্রায় ৫ হাজার বর্গমিটার জায়গাজুড়ে আছে। অর্থাৎ অন্তত ৬টি বড় ফুটবল মাঠের জায়গার সমান। এটি তৈরি করতে ৪০ হাজার শ্রমিকের টানা ২৭ বছর সময় লেগেছিল। ধারণা করা হয়, চতুর্থ রাজ বংশের দ্বিতীয় রাজা খুফুর সমাধি এটি। ফারাও রাজাদের সকলকে ফেরাউন বলা হত। প্রত্যেক ফেরাউন তার আগের ফেরাউনের চেয়ে সেরা পিরামিড তৈরি করতে চাইতো। তাদের বিশ্বাস ছিল ফেরাউনদের মৃত্যুর পর মৃতদের রাজা হিসেবে তাদের অভিষেক ঘটবে। তাদের মতে পিরামিড ছিল ফেরাউনদের পুনঃজন্মের প্রবেশদ্বার। তারা বিশ্বাস করত মৃত্যুর পর যতদিন তাদের দেহ সংরক্ষণ করা যাবে ততদিন তারা স্বর্গে বাস করবে। তাই অমরত্বের আশায় একজন মানুষের সমাধির জন্য এই বিশাল আয়োজন। ৪ হাজার ৭০০ বছর ধরে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে এই পিরামিড যা ১৯ শতক (আইফেল টাওয়ার তৈরির পূর্ব) পর্যন্ত মানুষের তৈরি উচ্চতম স্থাপত্য হিসেবে ধরা হতো। পিরামিডের স্থায়িত্ব সম্পর্কে একটি আরবি প্রবাদ আছে ‘মানুষ সময়কে ভয় পায়, আর সময় বা মহাকাল ভয় পায় পিরামিডকে’। পিরামিডের দেশে ভ্রমণের প্রথম পর্ব শেষ হচ্ছে এখানেই। দ্বিতীয় পর্বে থাকবে প্রথম মিরামিড তৈরির প্রকৌশল ও স্থাপত্য ইতিহাসসহ বিষদ ভ্রমণ বর্ণনা।
পর্ব-১
আপনার মতামত লিখুন :