বাংলাদেশের কৃতি সন্তান ড. রেজা খান। একজন প্রকৃতিপ্রেমী ও প্রাণীবিদ। বয়স আশির কোটায়। তবুও মনটা যেন চিরতরুণ আর দূরন্ত। প্রতিদিন যার সকাল হয় পূর্ব দিগন্তে আলো উঁকি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে। ব্যক্তিগত ক্যামেরা হাতে ভোরের স্নিগ্ধ বাতাসে ছুটে যান মরুর বুকে তৈরি কৃত্রিম বনে। যেখানে বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে কেটে গেছে তার দীর্ঘ সময়। চাকরি থেকে অবসর। তবে প্রকৃতি যেন আজও তাকে আকড়ে রেখেছে পরম মায়ায়। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন তিনি। যেখানে চাকরি করে চাইলেই পারতেন একটা বর্ণাঢ্য জীবন কাটিয়ে দিতে। কিন্তু পশুপাখির প্রতি অগাধ প্রেম তাকে টেনে নিয়ে যায় ধুসর মরুপ্রান্তরে। শুরুটা চিড়িয়াখানার গণ্ডিতে হলেও দ্যুতি ছড়িয়েছেন গোটা আরব আমিরাত জুড়ে। পশুপাখি নিয়ে গবেষণায় কাটিয়েছেন জীবনের ৪০টি বছর। মূলত একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে আরব আমিরাতের চিড়িয়াখানার ব্যবস্থাপক পদে চাকরি পেয়ে তিনি আলোচনায় আসেন। কাজ করেন টানা ৩৫ বছর। এ সময় রেজা খান অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছেন, পেয়েছেন পদোন্নতি। সান্নিধ্য পেয়েছেন আরব শাসক ও তাদের পরিবারের। সেই অভিজ্ঞতা থেকে পরিকল্পনা দেন দুবাই সাফারি পার্ক নির্মাণের। যা এখন দেশটির অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র বা ভ্রমণ গন্তব্য।
ভারতের বিখ্যাত পক্ষীবিদ ও প্রকৃতিপ্রেমী, দ্য গ্রেট বার্ডম্যান অব ইন্ডিয়া, সালিম মঈজুদ্দীন আবদুল আলীর সঙ্গে পাখি নিয়ে গবেষণার কাজ করেছেন রেজা খান। এরপর ১৯৮৩ সালে ডক্টর খান যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন, তখন সেলিম আলীর কাছ থেকে তিনি একটি বার্তা পান, ‘পেট্রোডলার তোমাকে ডাকছে’ (পেট্রোডলার বলতে তেল সমৃদ্ধ দেশগুলোর আয়কে বোঝায়, যেমন- সংযুক্ত আরব আমিরাত)। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে আরব আমিরাতের আল আইন চিড়িয়াখানায় পাখি বিশেষজ্ঞের দায়িত্বে নিযুক্ত হন তিনি। এরপর ১৯৮৯ সালের পহেলা জুন যোগদান করেন দুবাই চিড়িয়াখানায়। ২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর বন্ধ হয়ে যাওয়া এই চিড়িয়াখানাটি দুবাই পৌরসভার অধীনে পরিচালিত হতো। যেখানে তিনি বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করতেন। দুই বছর পর হন চিড়িয়াখানার প্রধান। ২০০৯ সাল পর্যন্ত এ পদে বহাল ছিলেন তিনি। এরপর হন প্রধান বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ। বর্তমানে রেজা খান দুবাই সাফারি পার্কের প্রধান বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন। ১৯৯৩ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত এ নিয়ে মহাপরিকল্পনা হয়। বিশ্বের বড় প্রাণীগুলো একসঙ্গে দেখানোর পরিকল্পনা করে এগিয়ে নেওয়া হয় সাফারি পার্কের কাজ। জায়গা বরাদ্দ হয় ২০১২ সালে। দুবাইয়ের শাসক শেখ মুহাম্মদ বিন রাশিদ আল মাকতুম ১৫ কোটি দিরহাম ব্যয়ে দুবাই মিউনিসিপ্যালিটিকে প্রাথমিক কাজ এগিয়ে নেওয়ার নির্দেশনা দেন। সাফারি পার্কে অ্যারাবিয়ান, আফ্রিকান ও এশিয়ান ভিলেজ আছে। সেখানে উন্মুক্ত প্রাণীদের দেখতে ঘুরতে হবে গাড়িতে করে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত এ সাফারি পার্কের উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞও ছিলেন রেজা খান। গ্রিস, মালয়েশিয়ান ও বাংলাদেশের তিনজন মিলে এই প্রকল্পের ডিজাইন তৈরি করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী তৈরি করেন মানুষের তৈরি বন-বাগান। বিশেষ করে যেই মহাদেশের বন্যপ্রাণী যেখানে রাখা হবে ঠিক সেখানে সেই দেশের গাছপালা রোপন করা হয়। ছোট গাছের পাশাপাশি পরিণত ও বড় গাছও রোপণ করা হয় এই পার্কে। বড় গাছগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কিনে আনা হয়। আবার নানা কারণে দেশটির সড়কের পাশে থাকা বড় গাছগুলো তুলে ফেলা হলে সেগুলোও এই সাফারিতে এনে পুনরোপণ করা হয়। এমন তিন’শটি ঘাফ গাছ লাগানো হয়েছে এই পার্কে। যা দেখলে অনেকটা জঙ্গলের মতোই মনে হবে। এ ছাড়া তিনি স্লোর এনার্জি, রিসাইকেল ও কম্পোজ সার তৈরি করারও পরিকল্পনা দেন। চিড়িয়াখানা ও বন্যপ্রাণী ছাড়াও নগরে ব্যবহৃত পানি ও অর্গানিক বর্জ্যকে সারে পরিণত করার বিষয়েও তার অংশগ্রহণ রয়েছে।
ড. রেজা খান জানান, আমিরাতে দীর্ঘদিন কর্মরত থাকলেও কোনো চিড়িয়াখানার জন্য খুব বেশি বন্যপ্রাণী কিনতে হয়নি তার। তবে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে পশু-পাখি বিনিময় করেছেন তিনি। আল আইন চিড়িয়াখানা তার হাত ধরে যেমন উন্নতি হয়েছে তেমনি দুবাই চিড়িয়াখানায় পূর্ণ ক্ষমতা পাবার পর তিনি এর ব্যাপ্তি ঘটান। রেজা খান জানান, দীর্ঘ কর্মজীবনে তাঁকে চিড়িয়াখানার জন্য খুব বেশি বন্যপ্রাণী কিনতে হয়নি। তিনি বলেন, ‘দুবাই চিড়িয়াখানায় প্রায় ১৮শ বন্যপ্রাণী ছিল। প্রায় সবগুলো প্রাণী মানুষের দেওয়া। বাকিগুলো প্রজনন করে বংশবৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়া পুলিশ, মিলিটারি বা কাস্টমের হাতে ধরা পড়া বা বাজেয়াপ্রাপ্ত প্রাণীগুলো দুবাই চিড়িয়াখানায় নিয়ে আসা হতো। ২০১০ সালে শারজাহ জু হওয়া পর্যন্ত দুবাই চিড়িয়াখানা ছিল একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেখানে ধরা পড়া প্রাণীদের নিয়ে আসা হতো। সেভাবে দুবাই চিড়িয়াখানায় গরিলা ও শিম্পাঞ্জি আসে।’ তিনি জানান, ৩৫ বছরের কর্মজীবনে দুবাই চিড়িয়াখানার জন্য মাত্র তিনটি বিড়াল কেনা হয়েছে। যার জন্য খরচ হয়েছে মাত্র ৩ হাজার দিরহাম। কারাকাম নামের এই বিড়ালগুলো আরব দেশে পাওয়া যায়। সৌদি আরবের বেদুইনদের হাতে ধরা পড়া এই তিনটি বিড়াল সেসময় ১ হাজার ৫০০ দিরহাম মূল্যে কেনা হয়। দুবাই মিউনিসিপ্যালিটির অনুমতি ক্রমে সেসময় আরো ১ হাজার ৫০০ দিরহাম ভাড়া খরচ করে সৌদি আরব থেকে সেগুলো দুবাই নিয়ে আসা হয়।
অভিজ্ঞতা বর্ণনা: ১৯৯০ সালে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের পরে কুয়েত চিড়িয়াখানা ধ্বংস হয়ে গেলে দুবাই চিড়িয়াখানা থেকে বাঘ, সিংহ, হরিণ, বানর, শিম্পাঞ্জি, সাপ, কুমিরসহ বিনামূল্যে ৬৩টি বন্যপ্রাণী পাঠান তারা। দুটি মিলিটারি বিমান বোঝাই করে কুয়েতের জন্য এসব পশু-পাখি পাঠানো হয়। দুবাই সরকার এসব পশু-পাখির জন্য খাঁচা তৈরি ও বিমান পর্যন্ত নিয়ে যাবার খরচ দিয়েছিল। বাকি খরচ বহন করে কুয়েত সরকার। ১৯৯৩-৯৪ সালের দিকে এসব পশু-পাখি নিয়ে কুয়েত চিড়িয়াখানা পুনরায় চালু করা হয়।
১৮৮৮ সালের দিকে ৩শটি কোবরা মেরে ফেলার আরেকটি বিপজ্জনক অভিজ্ঞতাও বর্ণনা করেন এই গবেষক। ড. রেজা খান বলেন, ‘সেসময় বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান দুবাইতে একটি সাপ প্রদর্শনী করার প্রস্তুতি নেয়। দুবাই ট্রেড সেন্টারের হলে বড় বড় জায়গায় সাপ ছেড়ে দেয় হয়। পত্রিকার বরাতে জানানো হয় ৩শটি কোবরা আসবে এই প্রদর্শনীতে। তখন আমি এর ঝুঁকি নিয়ে পাঠক মতামত কলামে স্থানীয় খালিজ টাইমস পত্রিকায় লিখি- এই সাপের বিষ নামানো ওষুধ না থাকলে কাউকে সাপে কামড় দিলে তাকে বাঁচানো যাবে না। পরে ওই লেখা দেখে নিরাপত্তা ঝুঁকি চিন্তা করে দুবাই মিউনিসিপ্যালিটি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। চার ডোজ প্রতিশেধক নিয়ে এসে তারপর এটি চালু করে। যদিও পরবর্তীতে দুবাই চিড়িয়াখানায় ওই তিনশটি সাপ মেরে ফেলা হয়।’
পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে স্থানীয় সাধারণ অধিবাসী, সংবাদমাধ্যম কিংবা চিড়িয়াখানা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে ড. রেজা খান হয়ে উঠেন নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি। বন্যপ্রাণী শনাক্ত করা ও তাদের সম্পর্কে জানতেও অনেকে ছুটে আসতেন তার কাছে। ব্যক্তিগত ক্যামেরা সঙ্গে থাকায় তার তোলা দুর্লভ বন্যপ্রাণীর অনেক ছবি স্থান পায় স্থানীয় গণমাধ্যমে। লিখেন বন্যপ্রাণীর জীবনচিত্র নিয়ে নানা গবেষণাপত্র। প্রাণী বিশেষজ্ঞ ড. রেজা খান উদ্ভিত ও বন বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগে ওয়াইল্ডলাইফ বায়োলজি সিলেবাসে ‘বন্যপ্রাণীর প্রাকৃতিক পরিবেশ’ বিষয়টি সংযোজন করেন। তার লেখা বাংলাদেশের বন্যপ্রাণীর তিনখণ্ড প্রকাশ করে বাংলা একাডেমি। চিড়িয়াখানার ব্যবস্থাপনা, বাংলাদেশের সাপ, বন্যপ্রাণী সম্পর্কে মানুষের ভ্রান্তধারণা কাটাতে বই লিখেন তিনি। এছাড়া ‘স্থলভাগের বৃহত্তর প্রাণী হাতি’, ‘পাখিবিশারদ সালিম আলী’, ‘বাংলাদেশের সাপ’, ‘ বাংলাদেশের বানর-নরবানর’, ‘আমাদের পাখির রাজ্য’ বইগুলো প্রকাশ করেন। সবমিলিয়ে দেশে বাংলা ভাষায় ১৫টি ও ইংরেজি ভাষায় ১০টি এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে ইংরেজিতে ৪টি বই প্রকাশ হয় তার। যেগুলো পরে আরবি ভাষায়ও অনুবাদ করা হয়। এ ছাড়া দেশ বিদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় পশু-পাখি নিলে লেখালেখি করেন তিনি।
রেজা খানের সংক্ষিপ্ত জীবনী: ড. রেজা খান ১৯৪৫ সালের ১৭ নভেম্বর ঢাকা জেলার বালিয়া গ্রামের বড়বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। গণমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে রেজা খান বলেন, ‘আমি পকেটে মাত্র ৫০ ডলার নিয়ে এসেছিলাম এবং তাও আত্মীয়ের কাছ থেকে ধার করা। ১৯৮৪ সালের এপ্রিল মাসে যখন প্রথম বেতন পাই, তখন আমার পাসপোর্টে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভিসার ছাপ পড়ে। তখনকার দিনে এরকমই দেরি হতো’। এক মাস পর, স্ত্রী ও তিন সন্তান তার কাছে আসে। বড় ছেলে তখন সিক্সথ গ্রেডে, মেয়ে ফার্স্ট গ্রেডে ভর্তি হয় এবং সবচেয়ে ছোট ছেলের বয়স ছিল তিন বছর। পরিবারটির বাসভবন ছিল চিড়িয়াখানার মধ্যেই।
স্থানীয় প্রভাবশালী গণমাধ্যম গাল্ফ নিউজকে রেজা খান বলেন, “আমার বাচ্চাদের শিক্ষকরা জিজ্ঞাসা করতেন, ‘তোমরা কোথায় থাকো?’ বাচ্চারা উত্তর দিতো, ‘আমরা চিড়িয়াখানায় থাকি।’ শিক্ষকরা খুবই রেগে যেতেন এবং আমাদের কল করে বলতেন, ‘আপনার বাচ্চারা আমাদের সঙ্গে বাজে জোকস করার চেষ্টা করছে।’ আমাদের ব্যাখ্যা করতে হতো, আমরা আসলেই চিড়িয়াখানার ভেতরে থাকি। এই একই জিনিস আবারও ঘটেছিল যখন আমরা দুবাই চিড়িয়াখানায় চলে আসলাম এবং তা আমরা উপভোগ করেছিলাম।”
স্মৃতির পাতা থেকে ড. খান বলেন, “আমি সব প্রাণীদের ভালোবাসতাম। কিন্তু দুটো গরিলা ছিল আমার হৃদয়ের খুব কাছের। তাদেরকে দুবাই বিমানবন্দর থেকে জব্দ করা হয়েছিল। একটি ১৯৯৭ ও অন্যটি ২০০০ সালে। এরপর তাদের দুবাই চিড়িয়াখানায় নিয়ে আসা হয়। গরিলাগুলোকে আমরা আমাদের জানালার কাছে রেখেছিলাম। আমার পরিবার তাদের যত্ন নিতো। বাচ্চারা বাড়ির দোলনায় তাদের সঙ্গে খেলা করত। প্রতিদিন সকালে চায়ের মগ নিয়ে আমি তাদের সঙ্গে চা শেয়ার করতে চলে যেতাম। ‘গরিলাস ইন দি মিস্ট’ সিনেমার নাম অনুসারে বড় পুরুষ গরিলাটির নাম রেখেছিলাম ‘ডিজিট’। মেয়েটির নাম ডায়ানা, সে এখনো আমাকে খুব ভালোভাবে চিনতে পারে।” ড. রেজা খানের তিন সন্তান এখন দুবাইতে প্রতিষ্ঠিত। খানের মতে, সংযুক্ত আরব আমিরাতে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কাটিয়েছেন তিনি। সৃষ্টিকর্তা যতদিন সুস্থ রাখবেন, বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদের খোঁজ করতে প্রকৃতির কাছে যাবেন- এমনটাই প্রত্যাশা প্রবীণ এ বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞের।
আপনার মতামত লিখুন :