ঢাকা শনিবার, ০৫ অক্টোবর, ২০২৪

ভূতুড়ে গ্রাম আল মাদাম

এসএম শাফায়েত, ইউএই ব্যুরো

প্রকাশিত: অক্টোবর ২, ২০২৪, ০৪:৫৫ পিএম

ভূতুড়ে গ্রাম আল মাদাম

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

পশ্চিমে সূর্য নামলে বাড়ির আঙিনায় মাদুর বিছিয়ে বসতেন বৃদ্ধরা। নলাযুক্ত ফুলদানি সদৃশ একটি যন্ত্র বা শিশায় ফুঁক ফুঁক করে ধূমপান করতেন বসে বসে। শিশুরা খেলাধুলায় মেতে থাকত। নারীরা গৃহস্থালি কাজ আর রান্নার কাজে ব্যস্ত সময় পার করতেন। যে গ্রামের অধিকাংশ মানুষ দিনভর সমুদ্রে মৎস্য শিকার আর উট চরানোর কাজ শেষে ক্লান্ত শরীরে ফিরতেন ঘরে। এমন একটি গ্রাম রাতারাতি জনশূন্য। ব্যাপারটি কী আসলেই স্বাভাবিক মনে হবে? নিশ্চয়ই না। তবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের মরুবেষ্টিত এক গ্রামে ঘটেছে এমনি ঘটনা। গ্রামটির অবস্থান আরব আমিরাতের অন্যতম প্রদেশ শারজার অভ্যন্তরে, নাম ‘আল মাদাম’। এখানে এখনো দৃশ্যমান পুরোনো ঘরবাড়ি। তবে বালুর ঝড়ের তোড়ে ঢেকে গেছে বাড়িগুলোর জানালা ও উঠান। পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে গ্রামটির বাসিন্দাদের ব্যবহৃত আসবাবপত্র।
দুবাই থেকে এক ঘণ্টারও কম দূরত্বে অবস্থিত শারজার সীমান্তবর্তী আল মাদামের এই গ্রামটি অনেকদিন ধরেই পরিত্যক্ত। গ্রামটিতে রয়েছে দুটি সারিতে অবস্থিত বেশ কিছু ঘরবাড়ি ও চমৎকার নকশার মসজিদ।
ঘরবাড়িগুলোর খোলা দরজা ও অধিবাসীদের ফেলে যাওয়া ব্যক্তিগত জিনিস দেখে ধারণা করা হয়, অধিবাসীরা তাড়াহুড়োর মধ্যে গ্রাম ত্যাগ করেছিলেন। এ কারণে আল মাদাম অনেকের কাছেই ‘ভূতের গ্রাম’ হিসেবে পরিচিত। অধিবাসীরা কোনো অতিপ্রাকৃতিক শক্তির কারণে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেছেন, এমন গল্পও প্রচলিত রয়েছে। বর্তমানে গ্রামটি রহস্যপ্রিয় ভ্রমণার্থীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে।
দুবাইয়ের প্রবাসী নাগরিকদের পছন্দের জায়গা আল মাদাম। রেডিট ফোরামগুলোতে গ্রামটিতে ভ্রমণের ব্যাপারে বিভিন্ন নির্দেশনা পাওয়া যায়। ইউটিউবাররা আল মাদামে তাদের ভ্রমণের বিভিন্ন খুঁটিনাটি নিয়ে ভিডিও বানাচ্ছেন।
দর্শনার্থীরা বলেন, ‘ভ্রমণের জন্য ‘ভূতের গ্রাম’ এখনও খুব বেশি পরিচিত গন্তব্যস্থল নয়। তবে দিন-দিন অভিযাত্রীদের পছন্দের জায়গা হয়ে উঠছে এটি।’
ব্রিটিশ ট্রাভেল ব্লগার ভ্যানেসা বল গিয়েছিলেন এই গ্রামে। রোমাঞ্চের সন্ধানে ভূতের গ্রামে গিয়ে মায়ায় পড়েছিলেন মোজাইক করা বাড়ি আর নান্দনিক একটি মসজিদ। নিজের অভিজ্ঞতা ও অনুভুতি প্রকাশ করে তিনি  বলেন, ‘এই গ্রামটির বেশিরভাগ বাড়ির দরজা খোলা। অনেক বাড়ির দরজা নেই। কিছু বাড়িতে অনেক সুন্দর মোজাইকের নকশা করা। ভূ-দৃশ্যের নকশা করা আছে একটি বাড়ির দেয়ালে। গ্রামটির অন্যতম আকর্ষণ হল, এটি ঘুরে বেড়ানোর জন্য অনেক খোলামেলা। এখানে অনেক লুকান রহস্যও খুঁজে পেতে পারেন অভিযাত্রীরা।’ 
এই ব্রিটিশ অভিযাত্রী আশা করেন, ‘গ্রামটির এই গুপ্তভাব ও অস্পষ্টতা বজায় থাকতে হবে। জনসমাগম হলে জায়গাটি তার সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলবে। বর্তমানে খুব সহজেই গাড়ি চালিয়ে বাড়িগুলোর পাশ দিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায়।’
দিন দিন জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেলেও, ভ্রমণের জন্য অর্থ নির্ধারণ বা জায়গাটিতে প্রবেশের সীমাবদ্ধতা নির্ধারণ করে দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই স্থানীয় প্রশাসনের।
শারজাহ ট্যুরিজমের এক মুখপাত্র জানান, আল মাদামকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার কোন পরিকল্পনা নেই, তবে ভ্রমণের অনুমতি রয়েছে।
স্থানীয় অধিবাসীদের গ্রামটি ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য না থাকায় অতিপ্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবের গুজব ছড়িয়েছে। আশেপাশের গ্রামে লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে, ‘উম্মে দুয়াইস’ নামের অপশক্তির জিনের কারণে গ্রামবাসি আল মাদাম গ্রামটি ত্যাগ করেন।
২০১৮ সালে শারজাহ আর্ট ফাউন্ডেশন (এসএএফ) গ্রামটির ইতিহাস খুঁজে বের করার চেষ্টা করে।  এসএএফ সিএনএনের সঙ্গে স্থানীয় এলাকাগুলোর অনেকের সাক্ষাৎকার নেয়। একজন সাক্ষাৎকারদাতা জানান, তিনি আল মাদামে বিয়ে করেছিলেন। এসব তথ্য থেকে ধারণা করা হয়, ১৯৭০-এর দশকের মধ্যভাগে গ্রামটিতে বসতি গড়ে ওঠে। আরও জানা যায়, অনেক গ্রামবাসিই প্রচণ্ড বালু ঝড়ের কারণে গ্রাম ছেড়ে চলে যান।
কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির স্থাপত্যবিদ্যার অধ্যাপক ইয়াসের এলসহেস্থওয়ে এ বিষয়ে আরেকটি ব্যাখ্যা দেন। ১৯৬০ সালের পর তেলের খনি আবিষ্কারের পর ও আধুনিকীকরণের অংশ হিসেবে যাযাবর জাতি বেদুইনদের জন্য সরকার আধুনিক গৃহব্যবস্থার পরিকল্পনা করে। বেদুইনদের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর বদলে বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ ও সুবিধার অঞ্চল গড়ে তোলা হয়। এই শা’বি হাউজিংয়েরই উদাহরণ আল মাদাম।
এই পরিকল্পনার অনেক বসতিই এত দ্রুত বানানো হয়েছিল, সব অবকাঠামো উপযুক্তভাবে বানানো হয়নি। শারজাহ আর্ট ফাউন্ডেশনের নেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, আল মাদামে বিদ্যুতের সংকট ছিল। এসব কারণেও বেদুইনরা এই বসতি ত্যাগ করতে পারেন।
ইয়াসের আরও বলেন, ‘আমাদের অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, অনেক পরিবার নতুন বসতিতে আসার পর দীর্ঘদিন বিদ্যুৎ ও পানির অভাবে দিন কাটান। এ ধরনের ঘটনায় অবকাঠামোগত ত্রুটি দেখা যায়, ফলে অনেকেই থাকতে এসে এই বসতি ছেড়ে চলে যান শেষ পর্যন্ত।’

রহস্য ও রোমাঞ্চপ্রিয় অভিযাত্রীদের কাছে এই গ্রামটির রহস্য ভ্রমণের মূল উপজীব্য। তবে সেই ধোঁয়াশা রহস্যের কূলকিনারা হয়নি আজও। হয়ত কোনদিন উন্মোচিত হবে সব রহস্য। নয়তো এভাবেই বালুর গহীনে লুকায়িত থাকবে গোটা গ্রামসহ তার হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস। কিম্বা কোন অভিযাত্রিক দল খুঁজে বের করবে রহস্যের স্মৃতিকথা।
 

আরবি/ আরএফ

Link copied!