ঢাকা সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪

প্রবাস প্রজন্ম; অতীত ও বর্তমান

মুহাম্মদ শাহ জাহান, আবুধাবী-ইউএই

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৫, ২০২৪, ০৪:২১ পিএম

প্রবাস প্রজন্ম; অতীত ও বর্তমান

ছবি: সংগৃহীত

বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে আছে বাংলাদেশি প্রবাসী কর্মজীবীরা। বর্তমানে বিশ্বের ১৭৬টি দেশে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখের মতো প্রবাসী বাংলাদেশি কর্মী জীবিকার প্রয়োজনে কর্মরত আছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রবাসীর সংখ্যা। বাংলাদেশিরা কর্মক্ষেত্রে মেধা, যোগ্যতা ও দক্ষতার ছাপ রেখে চলেছেন। তাদের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত রেমিট্যান্স (বৈদেশিক মুদ্রা) দেশের উন্নয়ন তথা অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখছে। সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স যোদ্ধারা রয়েছেন সৌদি আরবে। যার অধিকাংশই মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশজুড়ে। শুধু পরিবার ছাড়া আগে নারী কর্মীদের প্রবাসে যাওয়ার রেওয়াজ ছিল না। বিগত এক দশকে নারী কর্মীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। প্রবাসী আয়ের সঙ্গে দেশ হচ্ছে রেমিট্যান্স নির্ভর। সরকারি ঋণের ডলার পরিশোধের একমাত্র মাধ্যম রেমিট্যান্স। তাই প্রবাসীদের আগের তুলনায় এখন বিভিন্ন সরকারি সুযোগ-সুবিধাও দিয়ে থাকে। বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রেরণে বাড়তি প্রণোদনাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে সরকার। পাশাপাশি বিদেশ যাত্রায় প্রয়োজনীয় সুবিধা, পেনশন স্ক্রিম, বিএমইটি কার্ডসহ বিদেশ যেতে উৎসাহিত করা হয় সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে। যার মূল উদ্দেশ্য ‘রেমিট্যান্স’। এসব প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের কারণে যেমন নিজ পরিবারে সচ্ছলতা ফিরছে, তেমনি দেশের অর্থনীতির চাকা সচল হচ্ছে প্রতিনিয়ত। মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করেছে আর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে আর্থিক সচ্ছলতা ফিরিয়েছেন রেমিট্যান্স যোদ্ধারা। এ কথা আজ নতুন প্রজন্মের কাছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট।

দেশে চাকরি প্রার্থীর সংখ্যা বা বেকারত্ব উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। বিপরীতে কর্মসংস্থানের অভাবে যুব সমাজের অধিকাংশ নোংরা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াচ্ছে। কারণ নতুন প্রজন্ম জানছে, ‘আমার দেশে এখন আর শুধু মেধা দিয়ে কাজ চলে না’। রাজনৈতিক দলের কর্মী বা নেতা পরিচয়ে যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা যায়, তা পড়াশোনা দিয়ে হয় না। তাই রাজনৈতিক পরিচয়ে চাকরির সন্ধানে তারা। সব অনৈতিক কর্মকাণ্ড হালাল করার নিমিত্ত ক্ষমতাসীন দলে ভিড়ে বেকার যুবক। খুব কমসংখ্যক যুবক পড়ালেখা শেষ করে প্রাইভেট সেক্টরে কর্মরত। বলাবাহুল্য, সরকারি বা আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন কোটা পদ্ধতি বা দলীয়ভাবে নিয়োগ চলে। যারা  এ কোটার বাহিরে, তারা উপার্জনের জন্য প্রবাস জীবন যাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। জমি বিক্রি বা বন্ধক রেখে জীবনের মায়া ত্যাগ করে পাড়ি জমান বিদেশের উদ্দেশ্যে। যাদের বৈধ চ্যানেলে যাওয়ার সামর্থ্য থাকে না, তারা সাগর পথে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে পাচারকারীর হাত ধরে পাড়ি জমান। কেউ পৌঁছে গন্তব্যে, আবার কারও সলিলসমাধি হয় মাঝ-সাগরে। তার পরিবারে চলে শোকের মাতম। মুক্তিপণ দিয়ে কাজের জন্য ছাড়া পাওয়া প্রবাসকর্মীর রোমহর্ষক করুণ কাহিনি শুনলে যে কেউ শিউরে ওঠে। প্রবাসকর্মী দীর্ঘকাল বিদেশে খেটে যা কামাই করবে, তার চেয়েও বেশি রুজি করে পাচারকারী দালাল চক্র। এই গেল দক্ষিণ এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়াগামী যুবকদের কাহিনি। যে সব দেশের নাগরিকরা সবচেয়ে বেশি অভিবাসী হচ্ছে, সেই বৈশ্বিক তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। এ বছরের প্রথম তিন মাসে ইউরোপে পাড়ি জমাতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে যারা ডুবে যারা মারা গেছে, তাদের ১২ ভাগই বাংলাদেশি। প্রতি বছর অবৈধভাবে ইউরোপ প্রবেশ করতে গিয়ে সারাবিশ্বের অনেক অভিবাসন প্রত্যাশীর সলিল সমাধি ঘটে ভূমধ্যসাগরে। যারা বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে জলসীমা অতিক্রম করে কূলে ভিড়ে, তাদেরও কষ্টে দিন কাটে। ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগে অনেক দিন। অবৈধ চ্যানেলে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে বিদেশ যাত্রার প্রধান কারণ কর্মসংস্থানের অভাবে বেকার জীবন এবং অতিরিক্ত অভিবাসন ব্যয়, যা সাধ্যের বাইরে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটানের নাগরিকদের অভিবাসন ব্যয় কম হওয়ায় এবং দক্ষ জনশক্তি রপ্তানিতে সহজেই মধ্যপ্রাচ্যের শ্রম বাজারে অনেকটা আধিপত্য বিস্তার ঘটছে তাদের।

কম খরচে বিদেশ যাওয়ার মতো গন্তব্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত তথা দুবাই। বাংলাদেশ হতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকারি প্রক্রিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি ১৯৭৬ সাল থেকে শুরু হলেও ষাটের দশকের শুরুতে আমিরাতে আসেন অনেকে। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে করাচি হয়ে তৎকালীন পানির জাহাজ ‘সখিনা আরব’ দিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামের অসংখ্য পরিবার চলে আসেন দুবাই। প্রথম বসতি স্থাপন করেন দুবাইয়ের কার্টনে (বর্তমানে মানামা)। বড় বড় কার্টন ও ফ্লাই বোর্ড দিয়ে তৈরি ঘরের নামেই এই এলাকার নাম কার্টন। সবার পাকিস্তানি পাসপোর্ট। দেশ স্বাধীনের পরে বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহের ঘোষণা দেয় ইরাক হয়ে আসা বাংলাদেশি প্রতিনিধি। আবুধাবির খেজুরতলায় বট গাছের নিছে প্রথম হাতের লেখা পাসপোর্ট দেওয়া শুরু হয়। ক্রমাগত বাড়তে থাকে প্রবাসীর সংখ্যা। বর্তমানে এক মিলিয়নের অধিক প্রবাসী আমিরাতের প্রত্যেক প্রদেশে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশায় কর্মরত আছেন। বর্তমানে বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালাল চক্রের নানা অনিয়মে এখন ভিসা জটিলতায় আমিরাত প্রবাসীরা। ভ্রমণ ভিসায়ও প্রয়োগ করা হয়েছে কঠোরতা। দক্ষ জনশক্তি ছাড়া আমিরাতে ভিসা পাওয়া মুশকিল। তাই নতুন প্রজন্মকে উচ্চ শিক্ষার পাশাপাশি দক্ষতা অর্জনে মনোনিবেশ করতে হবে। অন্যথায় আমিরাতেও ভিসা পাওয়া দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।

 

 

আরবি/ আরএফ

Link copied!