চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার জ্যৈষ্ঠপুরা গ্রামের আজগর আলী। এক সময়ের প্রাণবন্ত এই তরুণ ১৯৯৩ সালে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ ছেড়ে জীবনের রঙিন স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে। পরিবারকে সুখে রাখার প্রত্যয়ে তার এই যাত্রা শুরু। কিন্তু তিন দশক পর আজ তিনি হাসপাতালের আইসিইউতে শুয়ে আছেন, মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে আক্রান্ত আজগর এখন একেবারেই একা। তার পাশে নেই তার প্রিয় কর্মস্থল, নেই মালিকপক্ষ। আজগরের জীবনসংগ্রাম শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। কর্মস্থল পরিবর্তনের সুবাদে ১৯৯৭ সালে দুবাইয়ের আল কাশ ইলেকট্রো-মেকানিক্যাল ওয়ার্কস কো. এলএলসিতে কাজ শুরু করেন। এরপরে কোম্পানির মালিকানার পরিবর্তন হয়, নাম পরিবর্তন করে করা হয় ‘পাওয়ার ম্যাক ইলেকট্রো ম্যাকানিক্যাল সার্ভিসেস এলএলসি’। কিন্তু আজগর থেকে যান সেখানেই। মালিক মোহাম্মদ আবুল কালাম এবং পরবর্তীতে তার ছেলে মোহাম্মদ সেলিম পারভেজ। এই দুই মালিকের অধীনে আজগর কাজ করে গেছেন দীর্ঘ ২৩ বছর। প্রায় তিন দশকের এই সময়ে কোম্পানির জন্য নিজেকে নিঃস্বার্থভাবে বিলিয়ে দিয়েছেন। কখনো অতিরিক্ত কাজ করেছেন, কখনো বাড়ি ফেরার টিকিটের টাকাও বাঁচিয়েছেন। কিন্তু এর বিনিময়ে কী পেয়েছেন? একটি বেতনবিহীন বছর, চরম অবহেলা, আর প্রতারণা। ২০২৪ সালের পুরো বছরে আজগর কোনো বেতন পাননি আজগর আলী। এতেই তার কোম্পানির কাছে পাওনা ৪২ হাজার দিরহাম। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৫ লাখ টাকা। চার সন্তানের বাবা আজগরকে প্রতিনিয়ত পড়তে হয়েছে সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধের শঙ্কায়। এই সময়ে বাড়ি থেকে আসা ফোনকলগুলোও তার জন্য হয়ে উঠেছিল একেকটা দুঃসস্বপ্ন। বেতন নিয়ে মালিক মোহাম্মদ সেলিম পারভেজের সঙ্গে বহুবার যোগাযোগ করেছিলেন আজগর। উত্তর ছিল প্রতিবারই এক রকম, ‘হবে, হয়ে যাবে।’ কিন্তু দিন পার হতে হতে সময় এমন একপর্যায়ে পৌঁছায়, যেখানে আজগরের লেবার কার্ডের মেয়াদ শেষ, ভিসাও নবায়ন করা হয়নি। ফলে অবৈধ শ্রমিক হয়ে পড়েন তিনি। যার কারণে প্রতিদিনের জরিমানা যোগ হতে থাকে তার নামে। ঘটনা এ পর্যন্ত হলেও ভালো হতো। অন্তত সাধারণ ক্ষমার সুযোগে ভিসা নবায়ন ও আইনি লড়াইয়ে কিছুটা হলেও অধিকার এবং বকেয়া আদায়ের সুযোগ পেতেন আজগর আলী। তবে পরিস্থিতি বদলে যায় ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪ তারিখ রাতে। রাতের খাবার খেয়ে আজগর ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন কিছু সময়ের জন্য। তারপর আর ঘরে ফেরা হয়নি তার। মাথায় হাত দিয়ে হঠাৎ চেতনা হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। স্থানীয়রা দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ধরা পড়ে, তিনি গুরুতর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন। পরের ৪৮ ঘণ্টায় তার জীবন সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। জরুরি অস্ত্রোপচার করা হয় তার মাথায়। পুরো মাথায় বিশেষ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বের করে আনা হয় ছড়িয়ে পড়া রক্ত। এরপর থেকে তাকে রাখা হয় আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে। কিন্তু এরমধ্যেও তার জন্য কোনো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়নি মালিকপক্ষ। কূলকিনারা না পেয়ে বিচারের আশায় বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল, দুবাইয়ের মাধ্যমে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ করেছে আজগর আলী বড় ভাই মোহাম্মদ আলী। আরব আমিরাতের লেবার কোর্টেও তিনি বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে আজগরের বড় ভাই মোহাম্মদ আলী রূপালী বাংলাদেশকে জানিয়েছেন, তারা একাধিকবার মালিক মোহাম্মদ আবুল কালাম এবং মোহাম্মদ সেলিম পারভেজের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু কেউ সাড়া দেননি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত মালিকদের কাছে সাহায্যের জন্য গিয়েছে, কিন্তু উত্তর একটাই ‘এ বিষয়ে আমরা কিছু করতে পারব না’। কখনো বা উত্তর এসেছে, ‘আমরা তাকে সব হিসাব বুঝিয়ে দিয়েছি। তার সঙ্গে আর কোনো লেনদেন নেই।’ মালিকপক্ষের এমন উত্তরের সত্যতা খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে আসে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। বিভিন্ন সময় পাওনা অর্থ চাইলে আজগরের হাতে দেওয়া হতো ব্যাংক চেক। যা ব্যাংকে হস্তান্তর না করার শর্তে নামকাওয়াস্তে কিছু অর্থ দেওয়া হতো তাকে।
অনুসন্ধানে রূপালী বাংলাদেশের হাতে আসা চেক এর তথ্যানুযায়ী, জনতা ব্যাংক, দুবাই শাখার অনুকূলে প্রথম মালিক মোহাম্মদ আবুল কালাম স্বাক্ষরিত দুইটি চেক যথাক্রমে ১২/০৫/২০১৮ তারিখে ৭ হাজার ২০৮ দিরহাম ও ৩০/১১/২০১৯তারিখে ৩ হাজার ৫০০ দিরহাম প্রদান করা হয়। কিন্তু চেক দুইটি থেকে কোনো অর্থ উত্তোলন করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে আবুধাবি কর্মাশিয়াল ব্যাংক (এডিসিবি), আল রি¹া রোড ব্রাঞ্চের অনুকূলে কোম্পানির বর্তমান মালিক মোহাম্মদ সেলিম পারভেজ স্বাক্ষরিত দুইটি চেক যথাক্রমে ১৬/১২/২০২০ তারিখে ৬ হাজার ৫০০ দিরহাম ও ১৬/০১/২০২১ তারিখে ৬ হাজার ৫০০ দিরহাম প্রদান করা হয়। এই দুইটি চেক থেকেও কোনো প্রকার অর্থ উত্তোলন করা সম্ভব হয়নি। কারণ হিসেবে জানা যায়, উক্ত ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোর লেনদেন চলমান নেই বলে ফিরিয়ে দেওয়া হয় বা ‘চেক বাউন্স’ হয়। উপরোন্ত মালিক সেলিম পারভেজের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ বিষয়ে জানানো হলে, তিনি বলেন, ‘আমাদের ‘পাওয়ার ম্যাক ইলেকট্রো-মেকানিক্যাল সার্ভিসেস এলএলসি’ লাইসেন্সটি কোর্টে স্যালেন্ডার করেছি। এই লাইসেন্স কিংবা লাইসেন্সের সঙ্গে আমি সম্পৃক্ত নই। তাই আমার কিছু করার নাই।’ পরবর্তীতে আমি তাদের কোম্পানির ব্যাপারে আরব আমিরাতের বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, ‘পাওয়ার ম্যাক ইলেকট্রো-মেকানিক্যাল সার্ভিসেস এলএলসি’ লাইসেন্সটি অদ্যাবধি বহাল রয়েছে এবং কোম্পানিটিতে একজন ভারতীয় নাগরিক, একজন পাকিস্তানি নাগরিকসহ ২১ জন শ্রমিক বিভিন্ন পদে কর্মরত রয়েছেন। বর্তমানে তাদের অফিস পরিবর্তন করে ‘গ্রিন পাওয়ারহোম টেকনিক্যাল সার্ভিস এলএলসি’ নামে কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল মোহাম্মদ সেলিম পারভজ। বর্তমানে ‘ফ্রিডম প্যাসিফিক জেনারেল ট্রেডিং এলএলসি’ নামে বীরদর্পে তাদের কার্যক্রম চালু রেখেছে। অথচ কোম্পানির একজন দক্ষ ও দীর্ঘ সেবাদানকারী কর্মীর কোনো খোঁজখবর না নিয়ে, হিসাব ও পাওনা বুঝিয়ে না দিয়ে মৃত্যু পথযাত্রী কর্মীর সঙ্গে মালিকপক্ষের এমন আচরণ চরম দুর্দশার মধ্যে আরও বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে আজগর আলী ও তার পরিবারকে।
আজগরের পরিবার জানায়, গত প্রায় দুই যুগের চাকরি জীবনে আজগর একদিনের জন্যও তার প্রাপ্য ছুটি বা ভাতা সঠিক সময়ে এবং নিয়মমাফিক পাননি। মালিকপক্ষের দেওয়া প্রতিশ্রুত চেকগুলো পর্যন্ত বাউন্স করেছে। যার কারণে তাদের পড়তে হয়েছে চরম আর্থিক সংকটে। সন্তানদের লেখাপড়া ও ভবিষ্যৎ চরম হুমকিতে পড়েছে। অথচ আজগর আলী এক সময় ভাবতেন, তার শ্রমে-ঘামে যে কোম্পানি দাঁড়িয়েছে, তারা হয়তো তার কষ্টের মূল্য দেবে। কিন্তু এখন তিনি জানেন, তার জীবনের পরিশ্রমের বিনিময়ে পেয়েছেন শুধুই প্রতারণা।
আজগর এখন দুবাইয়ের একটি হাসপাতালের আইসিইউতে শুয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। তার পরিবার দেশে অসহায়। তারা জানে না, আজগর যদি মারা যায়, তার দেহ দেশে ফেরানো যাবে কি না। তারা আশায় বুক বেঁধেছেন, কোম্পানির পক্ষ থেকে কেউ একজন এগিয়ে আসবে, আজগরের পাওনা বুঝিয়ে দেবে, তার চিকিৎসার খরচ দেবে। দিনশেষে আজগরের চার শিশুসন্তানের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়েও কেউ উদ্যোগী হবেন।
তবে এখানেই শেষ কথাটি রয়ে যায়। আজগরের এই গল্পটি একটি নির্দিষ্ট ঘটনা নয়, এটি প্রবাসী শ্রমিকদের একটি মর্মস্পর্শী চিত্র। এমন হাজারো আজগররা বেঁচে থেকেও যেন হারিয়ে ফেলেছেন জীবনের সব আশা। যারা পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য হাজার লাখ মাইল দূর পরবাসে থেকে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেন। অথচ অবহেলায় তাদের পরিণতি হয় এমনই নির্মম। এই ঘটনাটির প্রতিটি লাইন যেন আমাদের প্রশ্ন করে- ‘আমরা কি সাধারণ প্রবাসীদের অধিকার সুরক্ষা কিংবা তাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতার জন্য যা করণীয়, তা কী যথেষ্ট করছি?’
আপনার মতামত লিখুন :