মিশরে আজ তৃতীয় দিন। আমাদের আজকের পরিকল্পনায় শেষ বিকেলে নীলনদে নৌবিহার আর বাকি দিনভর অপরিকল্পিতভাবে পুরো শহর টই টই করে ঘোরাঘুরি। কারণ পুরো কায়রো শহর আসলে একটা জীবন্ত জাদুঘর। কিছু কিছু এলাকায় অনেক পুরাতন দালান কোঠা চোখে পড়ে। পুরোনো শহরের দালান কোঠা দেখে মনে হবে যেন হয়রত নূহ আলাইহিস সালামের যুগে বন্যায় তলিয়ে যাওয়ার পর এসব স্থাপনার ওপর আর রঙ্গের প্রলেপ পড়েনি। শহরের রাস্তা ধরে চলা গাধা বা ঘোড়ার গাড়ি দেখে মনটা ইতিহাসের গলিতে ঢুকে পড়ে। প্রাগৈতিহাসিক একটি মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়ে নীল নদের উদ্দেশে রওনা হলাম। ট্যাক্সি চালককে ‘নহর নীল’ বললেই হলো; পৌঁছে দেবে নীলনদের কিনারায়। তাছাড়া শহরের যে কোনো প্রান্ত থেকে মেট্রোরেলে চলে আসতে পারেন।
মিশরকে বলা হয় নীলনদের দান। মূলত প্রাগৈতিহাসিক ভাবে নীলনদকে ঘিরেই মিশরীয় সভ্যতার শুরু। ঐতিহাসিক নীলনদের দুই কূলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আধুনিক কায়রো নগরী। এখানে মনোমুগ্ধকর সুউচ্চ দালান, কারুকার্য খচিত অসংখ্য মিনার, পিরামিড, ফারাওদের বিশাল মূর্তি, অসংখ্য সুদীর্ঘ ফ্লাইওভার আর প্রশস্ত রাস্তা যে কোনো পর্যটকের দৃষ্টি আর্কষণ করবেই। পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নীল নদের দুই তীরে বিলাসবহুল ফাইভ স্টার ও থ্রি-স্টার মানের হোটেল, বিনোদন কেন্দ্র, ক্লাব, পার্ক ইত্যাদি নির্মাণ করা হয়েছে। নবী মুহাম্মদ (সা.) মিরাজে গিয়ে জান্নাতে দুটি প্রবহমান নদী দেখতে পান। ফেরেশতা জিব্রাইলের কাছে নবী (সা.) জানতে চাইলে তিনি বলেন, এর একটির নাম ‘নহর নীল’ অপরটি ‘ফোরাত‘ (ইরাকের)। কোরআনুল কারিমে নীল নদের একাধিক ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে; তাই এটাকে জান্নাতি নদীও বলা যায়।
আমরা যখন নীল নদের পাড়ে পৌঁছুলাম, তখন উৎসব উৎসব অবস্থা। বিকেল থেকেই এই উৎসবের আমেজ শুরু হয়, চলে গভীর রাত অবধি। প্রথম দেখায় মনে হবে যেন, মেলার আয়োজন চলছে। রাস্তার দুপাশে নানা জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা, ঢাকার ফুটপথে যেমন বসে। স্থানীয় ফল, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, স্যুভেনির, স্ট্রিটফুড থেকে অভিজাত রেস্টুরেন্ট—সবই গড়ে উঠেছে অপরূপ সুন্দর এই নীল নদের তীরে। মূলত কায়রো শহরের নীলনদকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট। নৌকায় ভ্রমণের জন্য কিছু লোক উচ্চশব্দে চিৎকার করছে। নানা রকম প্যাকেজ অফার করছে। এখানে বলে রাখা ভালো, কায়রোর প্রত্যেকটি টুরিস্ট পয়েন্টে ব্রোকার বা দালালের দৌরাত্ম্য ব্যাপক। দরদাম ঠিক করে না নিলে নিশ্চিত ধোঁকায় পড়বেন। বাহারি রঙের আলোয় আলোকিত নৌকায় বসে বিখ্যাত ব্যালে ড্যান্সের আসর। চলে ভোর অবধি। তাছাড়া অংশ নিতে পারেন ডিনার পার্টি, ঘণ্টাচুক্তি যৌথ ভ্রমণ অথবা নিজেদের মতো করে ভাড়া নেওয়া যায় নৌকা। এক ঘণ্টার জন্য দুই’শ মিশরীয় পাউন্ডে মস্তবড় একটি ইঞ্জিন চালিত নৌকা ভাড়া করলাম।
নীল নদের বুকে ট্রাফিক জ্যামের মতো যান্ত্রিক নৌকার ভিড় লেগে থাকে। চৌকস নাবিক হাই ভলিউমে আরবি গান চালিয়ে দুরন্ত গতিতে নৌকা নিয়ে এগোচ্ছে। আমরা অনুরোধ করলাম, নীল নদের গহীনে কিছুটা নির্জন এলাকায় নৌকা স্থির রাখার জন্য। ঈগলের চোখের মতো স্বচ্ছ নীল নদের পানিতে হাত ডুবিয়ে ইতিহাস ছুঁয়ে দেখার পুলক অনুভব করলাম। নীল নদের বুকে বসে ভাবতে লাগলাম, ঢাকার বুড়িগঙ্গা কিংবা খুলনার রূপসা নদীকে যদি আমরা পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তুলতে পারতাম। এই আক্ষেপ ও নীলনদকে ছেড়ে যাওয়ার বিরহ-বেদনা নিয়ে কূলে ফিরে এলাম। তীরে বসে আমরা সতেজ ‘ত্বীন ফল’ খেলাম। ভীষণ সুস্বাদু এই কুরআনিক ফল খেয়ে তৃপ্তি বোধ করলাম।
আপনার মতামত লিখুন :