প্রবাসের প্রথম প্রহর আমার মাস্কটেই কেটেছিল। ওমান এয়ারের একটি ফ্লাইটে প্রথম দুবাইয়ে আসি। নিয়মানুসারে মাস্কটে যাত্রাবিরতি (ট্রানজিট) ছিল। সে দফায় বাইরের ওমান দেখার সুযোগ হয়নি। দ্বিতীয়বার গত জুনে একটি বাজেট এয়ারের ফ্লাইটে কম টাকায় ওমানের রাজধানী মাস্কটে এসেছিলাম, কিন্তু সেবারও নিজের গাড়ি না থাকায় ঘুরে দেখার তৃপ্তি মেটেনি। নিয়ত করেছিলাম এবার গাড়ি নিয়েই আসব। যেই কথা সেই কাজ, ঠিক ৬ মাস পরে নিজের গাড়িতে রাতভর ড্রাইভ করে মাস্কটে পৌঁছানোর পরিকল্পনা নিয়ে আল্লাহর নামে বের হলাম। এবারের সফরসঙ্গী সিনিয়র সাংবাদিক দোস্ত জাহাঙ্গীর কবীর বাপ্পী, ছোট ভাই মাইন উদ্দিন আর আগেই মাস্কটে অপেক্ষমাণ ৫২ টিভির সম্পাদক বন্ধুবর লুৎফুর রহমান।
ওমানে পেট্রোলের দাম কিছুটা কম, সেখানে গিয়ে তেলের টাঙ্কি পূর্ণ করার আশায় সীমিত পেট্রোল নিয়ে ওমানের পথে রওনা হলাম, রাত তখন প্রায় ১১টা। আবুধাবি থেকে আল আইনের ‘খতম আল-সেকালা’ বর্ডার দিয়ে ওমানে ঢুকব। তবে বিষয়টা এতটা সহজ কিছু না। গাড়ি স্ক্যান, ইন্স্যুরেন্স ফি, নিজেদের ভিসা, সবকিছু চুকিয়ে যখন ভিসা জুটলো, ঘড়ির কাঁটা তখন ১টা ছুঁই ছুঁই। অতঃপর ওমানের অপরিচিত রাস্তায় ছুটতে শুরু করলাম; গন্তব্য রাজধানী মাস্কটের ‘রুই’ এলাকা।
গোল বাঁধলো গাড়ির ফুয়েল নিয়ে। তখনো ১৩২ কিলোমিটার চলার মতো রসদ আছে; পাড়ি দিতে হবে আরও সাড়ে ৩’শ কিলোমিটার পথ। নিশ্চয় পাম্প পেয়ে যাব। পেয়েও গেলাম ওমানের একটা পেট্রোল পাম্প। কিন্তু বিধি বাম, সব ঠিক আছে কেবল কোনো মানুষ নেই, মানে রাত ১২টার পর বন্ধ। পরবর্তী ৫০ কিলোমিটারের ভেতর পাম্প পেয়ে গেলেই বাঁচি; কিন্তু আমাদের ধারণা অধরাই রইল। গভীর অন্ধকার রাত, কোথাও সড়ক বাতির বালাই নেই। বেশ কিছুক্ষণ পরপর পাশ দিয়ে হোস্ করে এক একটা গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে বুলেটের গতিতে। আমার দুই সঙ্গী তখন গভীর ঘুমে। গাড়ির কিলোমিটার নামছে। মিটারের কাঁটা কমছে ৩০, ২৫, ২০, ১৫ মানে ১৫ কিলোমিটার পর থেমে যাবে গাড়ির চাকা। কিন্তু পেট্রোল স্টেশনের কোনো নিশানা পাওয়া গেল না।
ড্রাইভিং সিটে আমি রীতিমতো ঘামছি, ঘড়ির কাঁটা তখন রাত ৩টার ঘরে। সড়কবাতিহীন অন্ধকার ওমানের নির্জন রাস্তা। মনের জোরে আরও দশ কিলোমিটার চালিয়ে সড়কের পাশেই থামিয়ে দিলাম গাড়ি। তখন অনুভব করলাম পেট্রোলহীন গাড়ি, আমরা তিনজন মানুষ, কতই না অসহায়। কাউকে চিনি না, পাম্প কতদূরে জানি না, মোবাইলে এদেশের সিম নেই, পুলিশের জরুরি সেবা নম্বরও অজানা। এটা বাংলাদেশ কিংবা আরব আমিরাত না; তৃতীয় একটি দেশে অন্ধকারে অসহায় আমরা তিনজন মানুষ। আল্লাহকে ভরসা করে হাইওয়েতে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বাপ্পী ভাই, মাইন ও আমি রাস্তায় নেমে মোবাইলের আলো জ¦ালিয়ে সাহায্যের আশায় অন্য গাড়ির দৃষ্টিকাড়ার চেষ্টা করছি। এই নির্জন পথে কে দাঁড়াবে কার জন্য? সহযোগিতার সদিচ্ছা ক’জনেরই বা থাকে? অপরিচিত রাস্তায় আমরা অসহায় ও হতাশ হয়ে পড়লাম। হঠাৎ দেখলাম দ্রুত পাশ কাটিয়ে যাওয়া একটি বিএমডব্লিউ ব্র্যান্ডের নতুন গাড়ি প্রায় এক কিলোমিটার দূরে গিয়ে থামল। অতঃপর গাড়ি ঘুরিয়ে উল্টোপথে ঝুঁকি নিয়ে আমাদের কাছে এসে সমস্যা জানতে চাইল গাল্ফ অ্যারাবিয়ান ভদ্রলোকটি। খেয়াল করলাম গাড়িতে তার পরিবারও বসা। আমাদের অসহায়ত্বের কথা তাকে জানালাম। লোকটি জানতে চাইল আমাদের গাড়ি আর কতটুকু চলতে পারবে? বললাম কিলো পাঁচেকের বেশি নয়। গুগলের অলিগলি খুঁজে তিনি জানালেন, ডাবল সিগন্যাল দিয়ে, উল্টোপথে গিয়ে, একটি ওভারব্রিজ পার হয়ে গ্রামের মতো একটি এলাকায় পেট্রোল পাম্প আছে। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে গাড়ি ঘুরাতেই পুলিশ এসে হাজির। এ যেন ‘পড়বি পড় মালীর ঘাড়ে’র অবস্থা। কেন উল্টোপথে রথ চালাচ্ছি আমরা? আমি ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে আরবিতে পুলিশকে কনভিন্স করতে চেষ্টা করলাম, কাজও হলো। আমাদের পথ দেখিয়ে কোনো সমস্যা হলে তাকে কল করতে বলে তিনি চলে গেলেন। কতক্ষণ পরেই গাড়ির দম ফুরাবে, সেটা ভাবনায় না এনে গাড়ি ওভারব্রিজে তুলে গ্রামের পথে ছুটলাম; পেয়েও গেলাম কাক্সিক্ষত সেই ফুয়েল স্টেশন। কিন্তু কোথায় লোকজন? খেয়াল করলাম শীতে জ্যাকেট জড়িয়ে জড়সড় হয়ে ঘুমুচ্ছে পেট্রোল পাম্পকর্মী, এক বাংলাদেশি যুবক। ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে সে আমাদের দেখে এগিয়ে এলো। তেলের পাইপলাইন গাড়িতে জুড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও আত্মায় যেন ফিরে এলো প্রাণ। ফজরের নামাজ পড়ে চলতে লাগলাম রাজধানীর পথে।
আপনার মতামত লিখুন :