দুবাই বলতে অনেকে ভাবেন বুর্জ খলিফার মতো উঁচু উঁচু ভবন আর ঝাঁচকচকে হোটেল, মোটেল আর শপিংমলের দেশ। যেখানে আছে নামিদামি ব্র্যান্ডের গাড়ি আর দৃষ্টিনন্দন বাড়ি। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম বাণিজ্যিক নগরী দুবাই মূলত সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাতটি প্রদেশের একটি। কাল্পনিক সৌন্দর্যের বাস্তব রূপায়ন আর কৃত্রিম শহরটি আজও তাদের পুরোনো ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরে দেশ বিদেশের পর্যটক-ভ্রমণকারীদের সামনে। দুবাইয়ে কৃত্রিম ফুলের বাগান ‘মিরাক্কেল গার্ডেন’ যেমন আপনাকে বিশাল ফুলের রাজ্যে বিলিন করে দেবে, ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ এ প্রবেশের পর যেমন পাবেন মুহূর্তে এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। এর বাইরেও দুবাই ভ্রমণে আপনাকে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা দেবে ডেজার্ট সাফারি। চলুন আজকে আপনাদের কংক্রিট আর থাই গ্লাসের শহর ছেড়ে কিছুটা দূরে নিয়ে যায়। গন্তব্য আরব আমিরাতের কোনও এক মরু প্রান্তর। এই মরুভূমি আপনাকে স্থানীয় জীবনধারা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে। সেসঙ্গে দেশটির পুরোনো ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে এক সুতোঁয় গেঁথে দেবে। এই ডেজার্ট সাফারি সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষণ; যা দর্শকদের দুবাইয়ের বিশাল এবং সুন্দর মরুভূমির খুব কাছ থেকে অভিজ্ঞতা অন্বেষণ করার সুযোগ দেয়।
শহর থেকে একটু বাহিরে গেলেই চোখের আড়াল হতে থাকে সুউচ্চ দালানগুলো। গাড়ির জানালার দু’পাশ দিয়ে মুহূর্তে হারিয়ে যায় শহুরে দৃশ্যপট। ৩০ মিনিটের মতো পথ পাড়ি দিলেই রাস্তার দু’পাশে দিগন্ত জোড়া বালুকাবেলা। অনেকটা আঁকা-বাকা রাস্তা। যেমনটা এখানকার রাজপথে তেমন একটা দেখা যায় না। দুবাইয়ের মরুভূমি না দেখলে যেন মনে হবে দুবাই ভ্রমণ করা হয়নি। বিশেষ করে, আরবের দেশগুলোকে মরুভূমির দেশ বলে আখ্যায়িত করা হয়। তাই দুবাই বা সংযুক্ত আরব আমিরাতে এসে মরুভূমি না দেখলে আফসোস থেকেই যাবে।
এমনিতে মরুভূমির কথা মনে হলে ছোটবেলা থেকে একটা ছবিই স্মরণ হতে পারে, অ্যরাবিয়ান নাইটসের সেই আলিফ লায়লার কথা। ভোগ-বিলাসের সে জীবনের কথা। ওমান সীমান্তের কাছে বা এর আশেপাশে রয়েছে মরু এলাকা। দুবাই শহর থেকে প্রায় ৮০-১০০ কিলোমিটারের বেশি দূরে অবস্থিত ডেজার্ট সাফারি। প্রাইভেট গাড়ি, বাস অথবা ট্যাক্সি করে যেতে হবে ওখানে। সড়কের পাশে আপনার আনা গাড়ি পার্ক করার পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ল্যান্ড ক্রুজার দিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে মরুভূমির ভিতরে ক্যাম্পের পাশে। সাফারিটি সাধারণত একটি ফোর হুইলার গাড়িতে রোমাঞ্চকর ডুন ব্যাশিং রাইড দিয়ে শুরু হয়; যেখানে দর্শকরা বালির টিলায় ওপরে এবং নীচে গাড়ি চালানোর অ্যাড্রেনালিন রাশ অনুভব করতে পারে। গাড়িতে ওঠার শুরু থেকে প্রায় ৩ থেকে ৪ মিনিট চড়ার মধ্যেই অনুভূত হবে এক অসাধারণ রোমাঞ্চ। মরুভূমির উপর দিয়ে উঁচু উঁচু বালুর টিলা বেয়ে গাড়ি চড়াটা যে কত আনন্দের তা সরেজমিন না গেলে বুঝার উপায় নেই। গাড়ি একবার বালির পাহাড়ে উঠে তো আবার নিচে। মনে হবে এই বুঝি উল্টে যাবে গাড়ি। এতোদিন যারা হলিউডের সিনেমায় দেখেছেন, সে অভিজ্ঞতাটা এখানে আসলে বোঝা যাবে। মরুভূমি পেরিয়ে উঁচু থেকে নিচুতে ছুটতে থাকা গাড়িগুলো যেন বালির সঙ্গে যুদ্ধ করছে। এই যে গাড়ি কাত হয়ে যাওয়া কিংবা প্রায় উল্টে যাওয়া এটিই এই ডেসার্ট সাফারির সেরা রোমাঞ্চকর অনুভূতি। এখানে যারা গাড়ি চালান, তাদের প্রত্যেকের রয়েছে ডেজার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স। মনে মনে ভয় ঢুকে যাবে তাদের ড্রাইভিংয়ে। কিন্তু নিরাপদ থাকবেন আপনি। কারণ পুরো গাড়িটি বিশেষ নিরাপত্তা কৌশলে সাজানো। নিশ্চিত থাকতে হবে সিট বেল্টের ব্যবস্থা। তবে হ্যাঁ, হার্টে সমস্যা থাকলে এই রাইডে যাওয়ার ব্যাপারে কিছুটা বিধি-নিষেধও আছে! টানটান উত্তেজনার মধ্য দিয়ে শেষ হওয়া এই ড্রাইভের পরই রয়েছে আরও অনেক রাইড। এরমধ্যে চার চাকার স্কুটি বাইক, উঠ ও ঘোড়ার পিঠে চড়া, ঈগল পাখি হাতে-মাথায় নিয়ে ছবি তোলা অন্যতম।
সব শেষে ক্লান্ত শরীরে দর্শকরা একটি ঐতিহ্যবাহী বেদুঈন-স্টাইল ক্যাম্প সাইট উপভোগ করতে পারেন। যেখানে তারা ঐতিহ্যবাহী আরব আতিথেয়তা পেয়ে থাকে। এছাড়াও উটের পিঠে চড়া, মেহেদি পেইন্টিং এবং শিশা ধূমপানের মতো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড উপভোগ করতে পারেন। এখানে যাওয়ার পূর্বে নিশ্চিত হতে হবে যে, স্থানীয় গাইডসহ সাফারি করছেন যা আপনাকে সুরক্ষা এবং বিভিন্ন অজানাকে জানতে সাহায্য করবে।
মরুভূমি সাফারি আপনাকে অনেক অভিজ্ঞতা দেবে। পর্যটকদের জন্য এই সাফারি সাধারণত সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত চলে। সন্ধ্যার পর একটি নির্দিষ্ট জায়গা ঘিরে সাফারি শুরু হয় আরব্য সংস্কৃতিতে। যেখানে বসে কিছু সময় নিজেকে আরব শেখ ভাবতে পারেন নিজেকে। আপনার সামনে নানা ধরনের পানীয় নিয়ে হাজির হবে স্থানীয়রা। মরুর বালুর মধ্যে বিশেষ ধরনের আসনে বসে পড়ন্ত বিকেলের অসাধারণ দৃশ্য অবলোকন করতে পারবেন এখানেই। মরু প্রান্তরে সূর্যাস্তের সঙ্গে আরব্য রজনীতে আবিষ্কার করবেন নিজেকে।
শুরুতেই আলোর নাচনে ছড়াল মুগ্ধতা। অনেকটা আমাদের সার্কাসের সেই রিং মাস্টারের মতো চলল ক্যারিশমা। তবে এখানে প্রযুক্তির সহায়তাটাও থাকল। আলোর ঝর্ণাধারায় বেলি ড্যান্সে মাতায়োরা হয়ে উঠবেন সবাই। মুগ্ধতা ছড়ানো পরিবেশনা। এই নাচের কাছে বলিউডের যেকোন মাপের পরিবেশনাই নস্যি। আরবের এই শিল্পীরা দশকের পর দশক পরিশ্রম করে নিজেকে তৈরি করেছেন। তাদের পরিবেশনা শিল্পের মাত্রায় উঁচুতে তো থাকবেই। এতো শত না ভেবে উপভোগ করবেন আরব্য রজনীর উপাখ্যান। এরই মাঝে খাবারও চলে আসবে আপনার সামনে। বুফেতে যার যা ইচ্ছা ও যতো খুশি খাওয়ার সুযোগ। রয়েছে আরবি, চাইনিজ, টার্কিশ, স্প্যানিশসহ প্রায় অর্ধশত পদের খাবার। খাবার শেষ হতেই ছোট্ট বিরতি। তারপর ফের পরিবেশন। এভাবেই রাত গভীর হবে। এবার ফিরতে হবে। তবে ফেরার পথে আর সেই শিহরণ জাগানো ভয়ঙ্কর পথে নয়। স্থানীয় গাড়ি চালকদের চেনা পথে আপনাকে আরামদায়ক ভ্রমণ করিয়ে ফিরিয়ে দিয়ে আসবে গন্তব্যে।
আপনার মতামত লিখুন :