বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে কালের অবগাহনে ডুব দিয়ে কুয়াশার আলপনা আঁকতে আঁকতে ঘটে শীতের আগমন। শীত যেন আসে এক বিধবা নারীর বেশে। শ্বেত শুভ্র কুয়াশা যেন তার পূর্ণ বসন। তবে শুধু বাংলায় নয়, আরব দেশেও আসে শীত। কুয়াশায় ঢেকে যায় চারদিক। কমে আসে দৃষ্টির সীমানা। আরব দেশের ‘মরু’র নাম শুনলেই মনে হয় ‘মরা’ কোনো জায়গা। তবে ক্রমাগত আবহাওয়া ও ভৌগোলিক গতিপ্রকৃতির পরিবর্তনের কারণে এই মরুর বুকেও এখন জন্মেছে গাছপালা, উড়ে বেড়ায় মুক্ত পাখিরা। যেন সত্যিই সঞ্চারিত হয়েছে প্রাণ। কোথাও শুষ্ক বালু ঢেকে যাচ্ছে বরফের চাঁদরে। এই শীতে রূপ লাবণ্যের পাশে রিক্ত প্রকৃতিকে আমরা নতুন করে আবিষ্কার করি। এক অদ্ভুত আচ্ছন্নতা ঘিরে রাখে প্রকৃতিকে। দিনের সূর্য ঢেলে দিয়ে যায় মায়াবী রোদ। আকাশে ছন্নছাড়া নীল মেঘের ভেলা। এই আবহাওয়া বলে দিচ্ছে শীত এসেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো সাধারণ দুই ঋতুর হয়ে থাকে; শীত ও গ্রীষ্ম। গ্রীষ্মকালজুড়ে তীব্র গরম অনুভূত হয় যেমন, তেমনি শীতকাল এলেই ঠান্ডা আবহাওয়া কাঁপিয়ে দেয় জনজীবন। সাধারণত শীতের এই আবহাওয়া বিরাজ করে দুই মাস। সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, ওমান ও মিশরসহ মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশে এ বছর ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে শীতের আমেজ। থাকতে পারে ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত। বছরের শেষান্তে এক দুইবার বৃষ্টির দেখা মিললেও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অতি বৃষ্টি, বন্যা ও তুষারপাতের মতো ঘটনার স্বাক্ষী হচ্ছে আরব দেশগুলো।
পিঠা মেলা
বিশ্বের যে প্রান্তেই বাংলাদেশিদের বসবাস, সেখানে বাঙালিপনা থাকবে না; তাই কী হয়! তাই শীত এলেই মনে পড়ে যায় পিঠাপুলির কথা। সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে বসেছে শীতকালিন পিঠা মেলা। স্টলে স্টলে চলছে গরম গরম পিঠা ভাজা। ঝাল শুঁটকি, ধনিয়া পাতা-সরিষা ভর্তার সঙ্গে চিতই পিঠা, কুসুমপুলি, দুধ চিতই, মালপোয়া, মুগপাকন, তেল পাকন, দুধ পুলি, ভাপা পিঠা, নকশি পিঠা, খেজুর পিঠা, পাটিসাপটাসহ বাহারি নামের সব পিঠা দেখতে আর স্বাদ নিতে স্টলগুলোতে ভিড় জমিয়েছে প্রবাসী পিঠাপ্রেমীরা। এ ছাড়াও ফুচকার সঙ্গে টক, ঝালমুড়ি, দইচিড়া, চটপটি, বিরিয়ানিসহ বাহারি স্বাদের নজরকাড়া সব পিঠাপুলি আর মিষ্টান্নের স্বাদ নিতে চাইলে আপনাকে যেতে হবে দুবাইয়ের আল মুতিনায়। মুতিনার এই খেজুর বাগানের পাশেই বিশাল জায়গা নিয়ে চলছে মৌসুমী পিঠা উৎসব। শুধু এখানেই নয়, দুবাই, শারজাহ, আজমানসহ প্রায় সব প্রদেশের বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকায় রয়েছে বিশেষ বাজার। আর এসব বাজারের একাংশে দেখা পাবেন পিঠাপ্রেমীদের। শীতজুড়ে এ আমেজ যেন জানান দেয় ভিন্ন রকম আবেশ। খেজুরের রস, পাটালি গুড়, কোঁচড় ভর্তি মুড়ি-মুড়কি, পিঠা-পায়েস, খড়-পাতার আগুনে শরীর গরম করা, গমের খেতে পাখি তাড়ানোর মতো স্মৃতিময় সময়গুলো এই বিদেশবিভূঁইয়ে উপভোগ করা না গেলেও বদ্ধ ঘরে লেপ-কম্বলের উত্তাপ, কুয়াশাঢাকা ভোরে ও সন্ধ্যায় আনন্দ-কষ্টের মিশেল নিয়ে প্রবাস জীবনেও শীতকাল উপস্থিত হয়।
নাইট মার্কেট
শীতের সময় আরব আমিরাতের বিভিন্ন জনবহুল জায়গাতে রকমারি পণ্যে ও বাহারি সব খাবারের রাত্রীকালীন বিশেষ বাজার বা মেলা বসে। রংবেরঙের আলোকসজ্জার সঙ্গে দৃষ্টিনন্দন করে সাজানো হয় এসব বাজার। স্থানীয়দের কাছে বাজারগুলো ‘নাইট মার্কেট’ হিসেবে পরিচিত। যেখানে পাওয়া যায় বাহারি রঙের পোশাক, নানা পদের খাবার থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক্স, সাজসজ্জা আর গৃহস্থালির নানা পণ্য। রয়েছে খেলাধুলা ও চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা। সন্ধ্যার পর থেকে মেলার এক পাশে চলে বিলিয়ার্ড বা পুল খেলার আসর। অন্যদিকে অনুষ্ঠান মঞ্চে চলে সাংস্কৃতিক আয়োজন। অধিকাংশ নাইট মার্কেট বা এ ধরনের মেলার আয়োজক ফিলিপাইন ও ভারতীয়রা। যে কারণে মেলায় আগতদের শুনতে হয় ফিলিপিনো আর হিন্দি গান। মাঝে মাঝে বাড়তি মনোরঞ্জন দিতে ম্যাজিক শো এবং লটারির আয়োজনও চোখে পড়ে। দুবাইয়ের দেরা এবং বার দুবাইতে বেশ কয়েকটি নাইট মার্কেট রয়েছে। যেগুলো সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বেশ জমজমাট থাকে। বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে বেশি জমজমাট দেখা যায়।
শীতে কর্মস্থলে স্বস্তি
এই সময়টাতে যারা খোলা আকাশের নিচে বা দালানকোঠা, ব্রিজ ও রাস্তা নির্মাণের কাজ করেন, তাদের জন্য কিছুটা স্বস্তি বয়ে নিয়ে আসে বলা চলে। গরমের তীব্রতা কম থাকায় বেশ স্বস্তি বোধ করেন শ্রমিকরা। এ ছাড়াও যারা বাইক রাইডিং বা বিভিন্ন ডেলিভারি কাজে নিয়োজিত, তাদের জন্যও কিছুটা স্বস্তি নেমে আসে শীতের সঙ্গে। এই সময়টাতে কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে কাজে বের হবার প্রস্তুতি নিয়ে চলে যেতে হয় কর্মস্থলে। কাজ করতে হয় বিকাল-সন্ধ্যা পর্যন্ত। তবে শীতল আবহাওয়ার কারণে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না কোনো কাজে। এ ছাড়া সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত যারা বাইরে কাজ করেন, তাদের সঙ্গে রাখতে হয় গরম কাপড় বা জ্যাকেট ও জুতা। গ্রীষ্মকালে বা তীব্র গরমে মধ্যাহ্ন কর্মবিরতি থাকে দেশটিতে।
ছুটিতে দেশে ফেরার হিড়িক
শীতকালে প্রবাসীদের দেশে ফেরার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। সুপার মার্কেট, হাইপার মার্কেট ও শপিংমলগুলোতে একপ্রকার হিড়িক লেগে যায় কেনাকাটার। এই সময়টাতে এয়ারপোর্টে গেলে দেখা যায় সেই চিত্র।
সৌদি আরব
মরুভূমির দেশ সৌদি আরবে শীতকালে তুষারপাত হয়! ভাবতেই কেমন এক অনুভূতি তৈরি হয় মনে। কিন্তু ঘটনা তো আর মিথ্যা নয়। আর সময়টা শীতকালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে মার্চ মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত। সে সময় দেশটির দক্ষিণাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় অল্প সময়ের জন্য তুষারপাত হয়। থাকে কনকনে ঠান্ডা। সে সময় দেশটির উত্তরাঞ্চলে থাকে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। এ থেকে বোঝা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে মরুর দেশ সৌদি আরবে। যে কারণে এখানে দেয়া দিয়েছে বিরল আবহাওয়া। যেখানে বছরের অধিকাংশ সময় প্রচণ্ড গরম থাকে। অথচ সম্প্রতি কিছু অঞ্চলে তাপমাত্রা নেমে গেছে শূন্যের ঘরে। বয়ে যাচ্ছে তীব্র শীত। ইতোমধ্যে দেশটিতে বৃষ্টিপাত ও বজ্রপাতের আভাস দেওয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষ দেশটিতে বসবাসরতদের বন্যার ঝুঁকিপূর্ণ উপত্যকা এবং নিচু জলাবদ্ধ অঞ্চলগুলো এড়িয়ে চলতে বলেছে। সে সঙ্গে অফিসিয়াল পোর্টাল এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে জারি করা নির্দেশাবলি অনুসরণ করার আহ্বান জানিয়েছে। সৌদির আবহাওয়া অফিস বলছে, মক্কা, মদিনা, বাহা, তাবুক, জুফ, হাইল, উত্তর সীমান্ত ও পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশে বৃষ্টিপাত হতে পারে। মক্কা অঞ্চলে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাতের ফলে আকস্মিক বন্যা, শিলাবৃষ্টি এবং ধুলাবালি ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। এছাড়া রিয়াদ অঞ্চলে হালকা বৃষ্টি ও ধুলাবালি উত্তেজক বাতাস বইতে পারে। এ ছাড়াও সৌদির উত্তরাঞ্চলে ব্যাপক শীত পড়েছে। কুরাইয়া অঞ্চলে ১ ডিগ্রি, তুরাইফয়ে ০ ডিগ্রি, রাফায় ১ ডিগ্রি, আরায় ২ ডিগ্রি, সাকাকাতে ৩ ডিগ্রি এবং তাবুকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। বলে রাখা ভালো, শীতপ্রধান দেশগুলোর মতো পুরো শীতকাল যে সৌদিতে তুষারপাত হয়, বিষয়টি তেমন নয়। তাই সেখানে তুষার দেখতে হলে কিছু সময় নিয়ে যেতে হবে। সৌদি আরবের পাঁচ জায়গায় তুষারপাত দেখা যেতে পারে।
তাবুক: সৌদি আরবের তুষারপাতের সবচেয়ে ভাইরাল ভিডিও এবং ফটোগুলো আসে তাবুক থেকে। তাবুক প্রদেশের জাবাল আল-লজের উচ্চতা ২ হাজার ৫৪৯ মিটার। বিশ্বের যেসব পর্বতে শীতকালে তুষার পড়ে,
এটি সেগুলোর একটি। এটিকে জাবাল আল-লজ বা বাদাম পর্বত বলা হয়; কারণ এটি বাদামগাছে সমৃদ্ধ। ১০ হাজার বছর আগের গ্রানাইট মালভূমি এবং রক পেইন্টিংয়ের কারণে এটিকে সৌদির আকর্ষণীয় পর্যটন গন্তব্য বিবেচনা করা হয়। এ ছাড়া এই জায়গার হালি নামে শহরটি শীতকালে পর্যটকদের আকর্ষণের জায়গা।
তুরাইফ: দেশটির উত্তর সীমান্তে অবস্থিত তুরাইফ শহরে সৌদি আরবে সর্বকালের সবচেয়ে ঠান্ডা তাপমাত্রার রেকর্ড আছে। সেখানকার তাপমাত্রা মাইনাস ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমেছিল। এটি আরব উপদ্বীপে রেকর্ড করা সবচেয়ে কম তাপমাত্রার মধ্যে একটি।
শাকরা: শাকরা সৌদির কেন্দ্রীয় অংশের কাছাকাছি এবং রিয়াদ থেকে মাত্র ১৯০ কিলোমিটার দূরে। শীতকালে তুষারপাতের ফলে জায়গাটিকে দুর্দান্ত দেখায়। সেখানকার গাছ, ঘরবাড়ি, মাটি ও বালুময় সবকিছু এ সময় ঢেকে যায় তুষারের চাদরে। সৌদি আরবের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষেরা তুষারপাত দেখতে যায় শাকরায়।
আরার: ইরাক সীমান্তে অবস্থিত আরার। এখানে উর্বর চারণভূমি এবং চুনাপাথরের ছোট ছোট পাহাড় আছে। শীতে কখনো কখনো এখানকার তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রিতে নেমে যায়। তখন কিছুটা তুষারপাতের মুখোমুখি হয় বসবাসকারীরা।
রাফা: সৌদি আরবের রাফা অবস্থিত ইরাক সীমান্তের কাছে। অঞ্চলটির রেকর্ড তাপমাত্রা ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। উষ্ণ মরুভূমির জলবায়ু হওয়া সত্ত্বেও শহরটি গভীর তুষারপাতের সাক্ষী হয়ে রয়েছে।
কুয়েত
মরুময় আবহাওয়ার দেশ সৌদির মতো অভূতপূর্ব শৈত্যপ্রবাহে জমে যাওয়ার অবস্থায় পৌঁছেছে মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ কুয়েতও। বছরের অধিকাংশ সময় যে দেশে প্রচণ্ড গরম আবহাওয়া থাকে, সেখানে বর্তমানে কুয়েতের তাপমাত্রা নেমে গেছে শূন্যের নিচে মাইনাস ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। কুয়েতের আবহাওয়া দপ্তরের সর্বশেষ বুলেটিনে জানানো হয়, বিশেষত গ্রামীণ ও মরু এলাকাগুলোতে ঠান্ডার প্রকোপ বেশি। আবহাওয়া দপ্তরের বরাত দিয়ে কুয়েতের সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, মাত্র ১৭ হাজার ৮১৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দেশটির সর্বত্র তাপমাত্রা মাইনাস ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে মাইনাস ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠানামা করছে। দেশজুড়ে ব্যাপক শীতল বাতাস বয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গায় তুষারপাতের খবরও পাওয়া গেছে। কুয়েতের আবহাওয়া দপ্তরের নির্বাহী পরিচালক দাহরার আল আলী গণমাধ্যমকে বলেন, দেশটির আবহাওয়া এখন একটি বর্ধিত উচ্চচাপ ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে। এই উচ্চচাপ ব্যবস্থাটি বায়ুমণ্ডলের ওপরের স্তরের শীতলতা এবং
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে আসা নাতিশীতোষ্ণ বাতাসের মধ্যকার মিথস্ক্রিয়ার ফলাফল। বর্তমানের শৈত্যপ্রবাহের জন্য আবহাওয়ার এই উচ্চচাপ ব্যবস্থাকে দায়ী করেছেন তিনি। তবে এই পরিস্থিতি খুব শিগগিরই শৈত্যপ্রবাহ থামার সম্ভাবনা নেই।
আপনার মতামত লিখুন :