বাংলাদেশের মতোই সংযুক্ত আরব আমিরাত তথা দুবাইতে এখন শীতকাল। ক’দিন আগের মরুভূমির তপ্ত গরমের লেশ নেই যেখানে। উপরোন্ত সূর্যের উত্তাপকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কনকনে ঠান্ডার সঙ্গে বয়ে চলে শৈত্যপ্রবাহ। আর এই সময় প্রকৃতিকে চ্যালেঞ্জ করে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোটাই যেন আমার কাছে যুদ্ধ জয়ের নেশায় টগবগিয়ে ছুটে চলার মতো। শীতকালীন এই ভ্রমণ মৌসুমে দুবাই মিরাক্কেল গার্ডেন ঘুরে আসা প্রতিটি প্রকৃতি প্রেমিকের জন্য এক চমৎকার অভিজ্ঞতা হতে পারে। সেই ধারণা থেকেই বেরিয়ে পড়লাম মিরাক্কেল গার্ডেনের উদ্দেশ্যে।
বলে রাখা ভালো, অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত শীতের মনোরম আবহাওয়ায় বাগানটি তার পূর্ণ রূপে উন্মুক্ত থাকে। এই সময়ে ঠান্ডা বাতাস, নরম রোদ, আর বাগানের রঙিন ফুলের সমারোহ দর্শনার্থীদের জন্য এক স্বপ্নময় পরিবেশ তৈরি করে। দুবাইয়ের আল কোসাইস-২ থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হলো এক সুন্দর সকালে। রাস্তার পাশের একটি ক্যাফে থেকে ধোঁয়া ওঠা চার কাপ কারাক চা নিয়ে ঘুরল গাড়ির চাকা। গন্তব্য শেখ মুহাম্মদ বিন জায়েদ রোড টুয়ার্ডস আবুধাবি অভিমুখে ৩৪ কিলোমিটার, আরজান ৩০ নম্বর এক্সিট ধরে মিরাক্কেল গার্ডেন। চাইলে আল খেইল রোড ধরেও যাওয়া সম্ভব। তবে ট্রাফিক এড়িয়ে দ্রুত সময়ে পৌঁছুতে এই রাস্তাটিই সঠিক মনে করলেন আমার পার্সোনাল ড্রাইভার। ওহ, একা মানুষ চার কাপ চা কেন নিলাম সেটার উত্তর জানতে মন চাইছে নিশ্চয়ই? হ্যাঁ, এক কাপ আমার, এক কাপ আমার পার্সোনাল ড্রাইভার আর দুইকাপ পাপ্পু ও রায়হানের জন্য। আজকে আমার সফরসঙ্গী এরাই। গাড়িতে ফুল ভলিউমে গান শুনতে শুনতে আর রাস্তার দু’পাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। দূর থেকে চোখে পড়লো দুবাইয়ের জনপ্রিয় থিম পার্ক ‘আইএমজি ওয়ার্ল্ড’ ও ‘গ্লোবাল ভিলেজ’। এসব জায়গায় ভ্রমণ নিয়ে আরেকদিন লিখব বিস্তারিত। গাড়ি পার্কিং করে প্রবেশ করা যাক ফুলের স্বর্গরাজ্যে। সকালবেলা ঠান্ডা বাতাস এবং রোদ্রজ্জ্বল পরিবেশে আমরা বাগানে প্রবেশ করি। টিকিট কেটে ঢোকার পরপরই চোখে পড়ল অপরূপ ফুলের সমাহার। বাগানে ঢুকতেই রঙের বৈচিত্র্য আর মনোরম সাজসজ্জা আমাদের মুগ্ধ করল। মিরাক্কেল গার্ডেনের মূল আকর্ষণ হলো বিভিন্ন রঙের এবং প্রজাতির ফুল দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের স্থাপত্য। এখানে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় যাত্রবাহী বিমান ‘এয়ারবাস এ৩৮০’ এর ফুলের অবয়ব। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডধারী এই মডেলটি বিশ্বের বৃহত্তম ফুলের স্ট্রাকচার। এটি তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়েছে ৫ লাখেরও বেশি ফুল এবং গাছ। প্লেনের প্রতিটি অংশ এতটাই নিখুঁতভাবে ফুল দিয়ে সাজানো যে, এটি দেখলে মনে হয় সত্যিকারের একটি প্লেন বাগানে নেমে এসেছে। দিনের আলোতে এর সৌন্দর্য যেমন মুগ্ধ করে, তেমনি রাতে আলোকসজ্জার মধ্যে এটি আরও জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে ওঠে। ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়লো ‘হার্ট প্যাসেজ’। যেখানে দেখা মেলে একের পর এক হৃদয়াকৃতির আর্চওয়ে। যা প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য আদর্শ জায়গা বললেই চলে। লাল, গোলাপি এবং সাদা রঙের ফুল দিয়ে সাজানো এই পথটি যেন ভালোবাসার এক জীবন্ত প্রতীক। এখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে ভালোবাসেন ভ্রমণকারীরা। তা ছাড়া এটি বাগানের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফটোস্পটগুলোর মধ্যে একটি। এবার থমকে দাঁড়ালাম ফ্লোরাল কাসলের সামনে। এটি একটি ফুলের দুর্গ যা আপনাকে অন্য এক রাজ্যে নিয়ে যাবে। দুর্গটি এমনভাবে সাজানো হয়েছে যেন এটি একটি রূপকথার গল্প থেকে উঠে এসেছে। এর চারপাশে ফুলের দেয়াল, মিনার এবং প্রবেশপথ দর্শকদের অন্যরকম এক মুগ্ধতায় আবৃত করে। সূর্যাস্তের আলোয় এই দুর্গটি আরও মোহনীয় দেখায়। ঘুরতে ঘুরতে দেখতে পেলাম একটি মেয়ে আকাশে উড়ে যাচ্ছে! কাছে গিয়ে দেখলাম এটিও ফুল দিয়ে তৈরি একটি ‘উড়ন্ত মেয়ের অবয়ব’। মাটিতে পা রাখা এক বিশালাকৃতির মেয়ের ভাস্কর্য, যা সম্পূর্ণ ফুল দিয়ে তৈরি। এটি এমনভাবে সাজানো হয়েছে যেন মেয়েটি বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। এর চারপাশে থাকা ফুলের ঝর্ণার মতো সাজসজ্জা পুরো ভাস্কর্যটিকে জীবন্ত মনে করায়। দর্শনার্থীরা এটি ঘিরে ছবি তোলার জন্য ভিড় করেন। আমরাও কয়েকটা ছবি আর ভিডিও তুলে নিলাম আমাদের ফোনে। কিছুটা শীতের সময় হলেও দুপুরের রোদ যখন চোখ রাঙাচ্ছে আর হাঁটাহাঁটিতে যখন গরম লাগতে শুরু করেছে, তখন আমরা পৌঁছে গেলাম ‘প্যারাসোল প্যাসেজ’এ। এই অংশে ছাতার মতো আচ্ছাদিত পথ রয়েছে, যা আপনাকে রোদ থেকে সামান্য স্বস্তি দেয়। পথটি বিভিন্ন রঙের ছাতা দিয়ে সাজানো, যা উপরে তাকালে একটি মনোরম রংধনুর দৃশ্য তৈরি করে। এটি খুবই জনপ্রিয় একটি ফটোস্পট এবং বাচ্চাদের জন্য বিশেষ আকর্ষণীয়। সবমিলিয়ে আমাদের কাছেও মিরাক্কেল গার্ডেন রঙের সমুদ্রে অপরূপ যাত্রা।
এবার কিছু অভিজ্ঞতা ও ভ্রমণ টিপস শেয়ার করা যেতে পারে। শীতকালীন মৌসুমে গার্ডেনের পরিবেশ বিশেষভাবে মনোরম। ঠান্ডা আবহাওয়া এবং নরম রোদ ফুলের সৌন্দর্যকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে। এই সময়ে বাগানে বিভিন্ন প্রদর্শনী এবং সাংস্কৃতিক ইভেন্টের আয়োজন করা হয়, যা ভ্রমণকারীদের অভিজ্ঞতাকে আরও সমৃদ্ধ করে। ভ্রমণ মৌসুমে দর্শনার্থীদের ভিড় বেড়ে যায়। তবে এর মধ্যেও শান্ত পরিবেশে ফুলের রূপ উপভোগ করার সুযোগ মেলে। প্রতি বছর, মিরাক্কেল গার্ডেনে কিছু না কিছু নতুন সংযোজন করা হয়। গত মৌসুমে সংযোজন করা ‘ফ্লাওয়ার ক্লক’ দেখতে পেলাম সেখানে। যা একটি বিশাল ঘড়ি এবং এর প্রতিটি অংশ ফুল দিয়ে তৈরি। এ ছাড়াও, বিভিন্ন মুভি বা কার্টুন চরিত্রের থিমে সাজানো সেকশন রয়েছে। যা শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক উভয়ের কাছেই আকর্ষণীয়। যারা ছবি তুলতে ভালোবাসেন তাদের জন্য বলতে চাই, বাগানটি আসলেই এক বিশাল ফটোস্পট। প্রতিটি কোণায় এমন কিছু রয়েছে যা ফ্রেমে বন্দি করার মতো। বিশেষ করে সূর্যাস্তের সময় এখানে ছবি তুললে অন্যরকম এক মায়াবী সৌন্দর্য ধরা পড়ে। বাগানের আলোকসজ্জা রাতে এক বিশেষ আকর্ষণ যোগ করে। বিশাল জায়গাজুড়ে এই ফুলের রাজ্যে ঘুরতে এলে বিশ্রাম ও খাবার নিয়ে আগে থেকে ভাবনা চিন্তা করাই ভালো। বলে রাখা ভালো, বাগানের ভেতরে বসার জায়গা এবং বেশকিছু খাবারের স্টল রয়েছে। আমরা স্থানীয় আরব খাবার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের ফাস্ট ফুড উপভোগ করেছি। ঠান্ডা লেমোনেড এবং আরবীয় কাবাব আমাদের দিনটিকে আরও স্মরণীয় করে তোলে। প্রবেশ ফটকে ধাক্কাধাক্কি বা দীর্ঘ লাইনের ঝামেলা পোহাতে না চাইলে আগে থেকেই টিকিট অনলাইনে বুক করুন। কারণ ভিড় বেশি হলে লাইনে অপেক্ষা করতে হতে পারে। আরামদায়ক পোশাক এবং জুতা পরুন, কারণ হেঁটে পুরো বাগান ঘুরতে হবে। ক্যামেরা বা স্মার্টফোনের জন্য পর্যাপ্ত চার্জ রাখুন। এ ছাড়াও, একটি পাওয়ার ব্যাংক সঙ্গে রাখা ভালো। শিশুরা সঙ্গে গেলে তাদের জন্য বাগানের ম্যাপটি সঙ্গে রাখুন, যাতে তারা হারিয়ে না যায়।
পরিশেষে গার্ডেনটি ঘুরে আমরা অনুভব করলাম যে প্রকৃতি কতটা সৃজনশীল হতে পারে। রঙ এবং সৌন্দর্যের এই অপূর্ব সমাহার এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা এনে দেয়। বাগানের প্রতিটি অংশই যেন আলাদা গল্প বলে। শীতকালীন মৌসুমে এই বাগানের সৌন্দর্য যেন আরও বেশি উজ্জ্বল এবং আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে। দুবাই মিরাক্কেল গার্ডেন একবার দেখলে মনে হবে আপনি যেন কোনো পরীর দেশের স্বপ্নের বাগানে এসেছেন। প্রকৃতির মাঝে মনুষ্য সৃষ্ট এই চমৎকার সৌন্দর্য দেখার জন্য এটি আপনার ভ্রমণ তালিকায় অবশ্যই থাকা উচিত। প্রতিটি ভ্রমণপিপাসুর জন্য এটি এক অবিস্মরণীয় গন্তব্য। আপনার পরবর্তী ভ্রমণ পরিকল্পনায় এটি যোগ করুন এবং নিজেকে হারিয়ে ফেলুন রঙের সমুদ্রে। আমরাও নিজেদের হারিয়ে ফিরে যাচ্ছে পরবর্তী গন্তব্যে। এই জায়গা থেকে গ্লোবাল ভিলেজ খুব কাছাকাছি। পড়ন্ত বিকেলকে সঙ্গী করে পরবর্তী গন্তব্য আমাদের ‘গ্লোবাল ভিলেজ’।
আপনার মতামত লিখুন :