‘সুরা জুমা’ পবিত্র কোরআনের ৬২তম সুরা। এটি মদিনায় অবতীর্ণ। এর ২ রুকু, ১১ আয়াত। জুমা শব্দের অর্থ জনসমাবেশ। এ সুরায় বলা হয়েছে আকাশ ও পৃথিবীতে আল্লাহর একচ্ছত্র কর্তৃত্বের কথা। ইহুদিদের অন্যায় আচরণের কথা উল্লেখ করে মৃত্যুর অলঙ্ঘনীয় বিধানের কথা বলা রয়েছে। জুমার আজান হলে সব কাজ বন্ধ করে দ্রুত জুমার নামাজে সামিল হওয়ার নির্দেশ এবং নামাজ শেষে আবার জীবনের যাবতীয় কাজে লিপ্ত হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
সুরাটিতে জুমার নামাজের গুরুত্ব বর্ণনা করে আল্লাহ বলছেন, ‘হে ইমানদারগণ! জুমার দিনে যখন সালাতের জন্য ডাকা হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং কেনাবেচা ত্যাগ করো। এটাই তোমাদের জন্য সর্বোত্তম, যদি তোমরা জানতে।’ (সুরা জুমা, আয়াত ৯)
জুমার দিনের আমল সম্পর্কে বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এককভাবে অন্য কোনো দিন এবং সে দিনের নামাজ নিয়ে এত বর্ণনা আর পাওয়া যায় না। যেমন আবু হুরাইরা (রা.)–র বরাতে বর্ণনা করা হয়েছে যে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যার ওপর সূর্য উদিত হয়েছে, তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দিন হলো জুমার দিন। এদিনে আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে, এই দিনে তাঁকে জান্নাতে স্থান দেওয়া হয়েছে এবং এই দিনেই তাঁকে জান্নাত থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।’ (সহিহ মুসলিম) আমলের দিক থেকে আল্লাহ তাআলা যেসব দিনকে ফজিলত ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করেছেন, এর অন্যতম হলো জুমার দিন। এদিনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক নানা ঘটনা।
১১টি আয়াতের মাদানি এ সুরা মূলত তিনটি অংশে বিভক্ত।
প্রথম অংশে (আয়াত ১-৪) আল্লাহর অনুগ্রহ ও আয়াত (নিদর্শন) হিসেবে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর আল-কোরআন নাজিলের কথা বলা হয়েছে।
দ্বিতীয় অংশে (আয়াত ৫-৮) এমন এক জাতির কথা বলা হয়েছে, যারা নিজেদের মর্যাদার বড়াই করত। কিন্তু তাদের কিতাবের (আল্লাহর আয়াত বা নিদর্শন) মর্যাদা তারা দিতে পারেনি। এ জন্য তাদের প্রতি আল্লাহর প্রতিদানের ব্যাপারেও তারা বেখেয়াল। তারা মৃত্যু, পুনরায় আল্লাহর দরবারে জড়ো হওয়ার বিষয়টি অবজ্ঞার সঙ্গে নেয়।
তৃতীয় অংশে (আয়াত ৯-১১) আল্লাহ আমাদের জুমার দিনে তাঁর দরবারে জড়ো হওয়ার জন্য বলেছেন। এ জুমার দিনে আল্লাহর আহ্বানে গুরুত্বসহকারে (ব্যবসা ও ক্রীড়া-কৌতুক বাদ দিয়ে) সাড়া দেওয়ার মাধ্যমে সাফল্য লাভের উপদেশ দেওয়া হয়েছে।
এ সুরায় আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করতে উপদেশ দেওয়া হয়েছে। এসব কিছুর কারণে সফলতার আশা করার কথা বলা হয়েছে। এভাবেই তিন অংশে সুরাটি গাঁথা।
সুরার প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু, সবই আল্লাহর প্রশংসা ও মহিমা ঘোষণা করে, যিনি পবিত্র পরাক্রমশালী ও তত্ত্বজ্ঞানী।’ এ ছাড়া আল্লাহ বড় এবং আল্লাহর চারটি গুণবাচক নামের (মালিক, কুদ্দুস, আজিজ, হাকিম) কথা এসেছে।
দ্বিতীয় আয়াতে আছে, ‘তিনিই নিরক্ষরদের মধ্য থেকে একজনকে রাসুল করে পাঠিয়েছেন, যে তাঁর আয়াত আবৃত্তি করে তাদের কাছে, তাদের উন্নত করে এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়। এর আগে তারা ছিল ঘোর বিভ্রান্তিতে।’ আল্লাহর ওই ৪টি গুণবাচক নামের রঙে রঙিন হয়ে তাঁর প্রেরিত শেষ নবী ও রাসুল কীভাবে তাঁর দীন প্রচার করে গেছেন, তার বর্ণনা এসেছে।
তৃতীয় আয়াতে আছে, ‘যারা এখনো তাদের দলভুক্ত হয়নি, তাদের জন্যও তাকে পাঠানো হয়েছে। আল্লাহ তো পরাক্রমশালী, তত্ত্বজ্ঞানী।’ মুহাম্মদ (সা.)–এর কাজের পরিধি যে শুধু তাঁর সময়েই নয়, বরং তাঁর অবর্তমানেও এ কাজ চলতে থাকবে।
চতুর্থ আয়াতে আছে, ‘এ আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি দান করেন। আল্লাহ তো মহা অনুগ্রহশীল।’ ইসলাম মক্কার সীমানা ছাড়িয়ে সবদিকে ছড়িয়ে পড়বে। মানুষের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ হতেই থাকবে।
পঞ্চম আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘যাদের তওরাতের বিধান দেওয়া হলেও তা অনুসরণ করেনি তাদের উপমা, বই বওয়া গাধা! কত খারাপ তাদের উপমা, যারা আল্লাহর আয়াতকে মিথ্যা বলে! আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়কে সৎ পথে পরিচালনা করেন না।
ষষ্ঠ আয়াতে আছে, ‘বলো, হে ইহুদিরা! যদি তোমরা মনে করো যে তোমরাই আল্লাহর বন্ধু, অন্য কোনো মানবসম্প্রদায় নয়, তবে তোমরা মৃত্যু কামনা করো, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’
সপ্তম আয়াতে আছে, ‘তাদের কৃতকর্মের কারণে তারা কখনো মৃত্যু কামনা করবে না। সীমালঙ্ঘনকারীদের সম্পর্কে আল্লাহ ভালো করেই জানেন।’
অষ্টম আয়াতে আছে, ‘যে মৃত্যু থেকে তোমরা পালাতে চাও, তোমাদের সে মৃত্যুর সামনাসামনি হতেই হবে। তোমাদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে অদৃশ্য ও দৃশ্যের পরিজ্ঞাতা আল্লাহর কাছে, আর তোমাদের জানিয়ে দেওয়া হবে, যা তোমরা করতে।’
নবম আয়াতে বলা হয়, ‘হে বিশ্বাসীরা! জুমার দিনে যখন নামাজের জন্য ডাকা হয়, তখন তোমরা আল্লাহকে মনে রেখে তাড়াতাড়ি করবে ও কেনাবেচা বন্ধ রাখবে। এ-ই তোমাদের জন্য ভালো, যদি তোমরা বোঝো।’
দশম আয়াতে আছে, ‘নামাজ শেষ হলে তোমরা বাইরে ছড়িয়ে পড়বে ও আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে এবং আল্লাহকে বেশি করে ডাকবে, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’
একাদশ আয়াতে বলা হয়, ‘ব্যবসায়ের সুযোগ বা তামাশা দেখলে তোমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে তারা সেদিকে ছুটে হয়। বলো, “আল্লাহর কাছে যা আছে, তা তামাশা ও ব্যবসার চেয়ে অনেক ভালো। আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ জীবিকাদাতা।”’
সপ্তাহের গুরুত্বপূর্ণ কাজ জুমার নামাজ আদায় করা শেষে আবার ভূপৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ে আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করতে বলেছেন। এর মধ্যে জীবিকার জন্য চেষ্টা করা ও অন্যান্য অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করতে উপদেশ দেওয়া হয়েছে এবং এসব কিছুর কারণে সফলতার আশা করার কথা বলা হয়েছে।
জুমার জমায়েত আমাদের কিয়ামতের জমায়েতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় প্রতি সপ্তাহে। এ জুমায় আমরা ইচ্ছা করে জমায়েত হই। আর কিয়ামতের সময় আমাদের জমায়েত হতেই হবে। এই সাপ্তাহিক জমায়েত হাশরের জমায়েতেরই একটা মহড়া।
সুতরাং শুরুতে আল্লাহ তাঁর কিতাব নাজিলের কথা বলেছেন এবং সেই কিতাবের মর্যাদা অনুযায়ী তাঁর রাসুল (সা.) কাজ করে একটি সর্বজনীন সমাজ গঠন করে গেছেন। সেই কিতাবের মর্যাদা না দিলে পরিণতি কেমন হবে, সেদিকে ইঙ্গিত দিতে আল্লাহ আমাদের সতর্ক করেছেন এবং প্রতি সপ্তাহে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে জমায়েত হয়ে কিতাবের মর্যাদা দান করার মাধ্যমে সাফল্য অর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করে প্রথম মসজিদে হাজির হয়, সে যেন একটি উট কোরবানি করল, দ্বিতীয় যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করে, সে যেন একটি গরু কোরবানি করল, তৃতীয় যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করল, সে যেন একটি ছাগল কোরবানি করল। অতঃপর চতুর্থ যে ব্যক্তি মসজিদে গেল, সে যেন একটি মুরগি সদকা করল। আর পঞ্চম যে ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করল, সে যেন একটি ডিম সদকা করল। এরপর ইমাম যখন বেরিয়ে এসে মিম্বরে বসে গেলেন খুতবার জন্য, তখন ফেরেশতারা লেখা বন্ধ করে খুতবা শুনতে বসে যায়।’ (সহিহ বুখারি: ৮৮১)
আপনার মতামত লিখুন :