ইংল্যান্ডের তৎকালীন রানীর দেয়া রাজকীয় সনদে ষোড়শ শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবসার নামে একটি কোম্পানি খুলেছিল ব্রিটিশরা। ওই সময় জয়েন্ট স্টক কোম্পানিটি সরকারিভাবে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নাম পেয়েছিল। তবে পরবর্তীতে একচেটিয়া ব্যবসা ও ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নিয়ে ব্রিটিশ সরকার সরাসরি ভারতবর্ষ শাসন শুরু করে।
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর ব্রিটিশরা রাজনৈতিক ক্ষমতা পেলেও বাংলার মানুষদের সমর্থনের অভাবে ১৭৭২ সালের আগ পর্যন্ত তারা শাসনকার্যের দায়িত্ব পায়নি। যার কারণে বিকল্প হিসেবে আজ্ঞাবহ নবাবদের নিজেদের হাতের পুতুলের মতো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে। ‘কাগজে-কলমে’ ওই সময়ে নবাবেরা মাঠপর্যায়ে শাসনের দায়িত্ব পালন করলেও কার্যত তাদের সামরিক ক্ষমতা কিংবা অর্থের ক্ষেত্রে কোনো এখতিয়ার ছিল না।
তবে দেওয়ানি ক্ষমতা পাওয়ার পর থেকে ব্রিটিশরা অধিক পরিমাণে করহার বাড়িয়ে দেয়। যার ফলে সে সময় জমির মালিকদের পক্ষে বেশিরভাগ সময়েই কর দেয়া সম্ভব হতো না। অন্যদিকে রাজস্ব আদায়ের নামে লুণ্ঠন ছাড়াও নানা ধরনের নির্যাতন ক্রমেই বেড়ে চলছিল।

এদিকে, ব্রিটিশরা বরাবরই ফকির-সন্ন্যাসীদের লুটেরা হিসেবে দেখতো। এর পেছনে কারণও রয়েছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ফকির ও সন্ন্যাসীরা শত শত বছর ধরে বিভিন্ন মন্দির ও তীর্থস্থান পরিদর্শন করতেন। ঐতিহ্য হিসেবে তারা স্থানীয় জমিদারদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ভিক্ষা নিতেন। পলাশীর যুদ্ধের আগ পর্যন্ত এই অর্থ ভিক্ষা দিতে জমিদারদের কোনো সমস্যা ছিল না, উল্টো তারা এটিকে সৌহার্দপূর্ণ লেনদেন হিসেবেই দেখতো। অন্যদিকে ব্রিটিশদের অধিক পরিমাণে করহারের ক্ষেত্রে এমন সৌহার্দপূর্ণ লেনদেন ছিল না।
অন্যদিকে, বাংলার মুসলিমরা শুরু থেকেই ইংরেজ শাসনের বিরোধী হয়ে উঠেছিল। পরবর্তীতে তা শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পাশাপাশি ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের জন্ম দেয়। যেখানে একাত্মতা জানিয়েছিল বাংলার কৃষক, শ্রমিক, জেলে, তাঁতি, ফকির-সন্ন্যাসীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। যার ফলে পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলার হিন্দু-মুসলমান, ফকির-সন্ন্যাসীরা ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রাম সংঘটিত করেন। যা ‘ফকির বিদ্রোহ’ ও ‘সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত।

ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন বা বিদ্রোহ মূলত ১৭৬৩ সালে শুরু হয়ে প্রায় চার দশক (১৮০০ সাল পর্যন্ত) স্থায়ী হয়েছিল। এ বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক ছিলেন ফকির মজনু শাহ। তৎকালীন বাংলা বিহারের মাদারিয়া সুফি তরিকার নেতা ছিলেন শাহ সুলতান হাসান সুরিয়া বোরহান। তার মৃত্যুর পর আঠারো শতকের মধ্যভাগে এ তরিকার নেতৃত্ব পান ফকির মজনু শাহ।
নেতৃত্ব পাওয়ার পর থেকে দরবেশ, ফকির ও যোগী-সন্ন্যাসীদের নিয়ে ফকির মজনু শাহ ব্রিটিশবিরোধী ঐক্যের মাধ্যমে সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তুলেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ফকির মজনু শাহ দীর্ঘ প্রায় ২৬ বছর ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অবিরাম যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। দীর্ঘ এই সময়ে ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামে প্রকাশ্য যুদ্ধ ছাড়াও গেরিলা যুদ্ধে ফকির মজনু শাহ ৫০ হাজারেরও বেশি সংখ্যক ফকির ও সন্ন্যাসীদের সংঘবদ্ধ করতে সক্ষম হন।

ইতিহাসবিদদের বর্ণনায় এসেছে, দীর্ঘ প্রায় ২৬ বছর নিজের অধীন সৈন্যদের নিয়ে সারা বাংলায় অনেক সফল অভিযান পরিচালনা করেন ফকির মজনু শাহ। এসব অভিযানে ব্রিটিশদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কুঠি ছাড়াও তাদের আওতাধীন রাজস্ব অফিসসহ বিভিন্ন স্থাপনা দখল করেন ফকির মজনু শাহ। এছাড়াও কোম্পানির শাসকদের হাতের পুতুল হিসেবে থাকা জমিদারদের কাচারি লুটের পাশাপাশি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যবাহিনীর সঙ্গেও যুদ্ধ করে তাদের পরাজিত করেন। এসব যুদ্ধে বিপুল সংখ্যক ইংরেজ সৈন্য ছাড়াও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বহু কর্মচারী নিহত হয়।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ফকির মজনু শাহের দীর্ঘ এসব লড়াই বৃহত্তর ঢাকা ছাড়াও ময়মনসিংহ, বগুড়া, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর অঞ্চলে সংঘটিত হয়। সফল এসব অভিযানে মজনু শাহের সঙ্গে আরও অনেক দরবেশ-ফকির নেতৃত্ব দিয়েছেন। পরবর্তীতে ১৭৮৭ সালের দিকে মুখোমুখি সশস্ত্র যুদ্ধে মজনু শাহ নিহত হন বলে জানা যায়।
        
                            
                                    
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
                                    
                                    
                                    
                                                                                    
                                                                                    
                                                                                    
                                                                                    
                                                                                    
                                                                                    
                            
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন