শবে বরাত দুটি ভিন্ন শব্দের সমন্বয়ে গঠিত একটি নাম। শব এটি একটি ফার্সি শব্দ।। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, রাত আর বরাত এটা আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, ক্ষমা- মুক্তি -নিষ্কৃতি। সুতরাং শবে বরাত অর্থ, ক্ষমার রাত-মুক্তির রাত। হাদিস শরীফে এ রাতকে লাইলাতুল মিন নিসফি শাবান নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তবে অজ্ঞতাবশত অনেকে লাইলাতুল বরাত অর্থাৎ শবে বরাতের তরজমা করেন ভাগ্য রজনী যা মারাত্মক ভুল। তা ছাড়া ভাগ্য বা তাকদির মানুষের জন্মের আগেই আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। এখন আর নতুন করে কিছু নেই।
সুতরাং এ রাতের সঠিক এবং বিশুদ্ধ নাম হচ্ছে লাইলাতুল বারাত তথা ক্ষমার রাত বা মুক্তির রাত। এ রাতের অনেক ফজিলতের কথা বিভিন্ন কিতাবে পাওয়া যায়। এসম্পর্কিত অনেকগুলো হাদিসও বিভিন্ন বর্ণনাকারী থেকে বর্ণিত রয়েছে। তবে সেগুলোর অধিকাংশই অনির্ভরযোগ্য, বানোয়াট বা ভিত্তিহীন। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুহাদ্দিসগণের মতে লাইলাতুল বারাত সম্পর্কে তথা শবে বরাত সম্পর্কে হযরত মুয়াজ রাদিয়াল্লাহু তা`আলা আনহু এর হাদীসটি সর্বাধিক বিশুদ্ধ। এছাড়াও এরাত সম্পর্কে কিছু হাদিস রয়েছে হাসান। আর কিছু হাদিস রয়েছে জয়িফ বা দুর্বল।
হযরত মুয়াজ রাযিআল্লাহু তা`আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন; আল্লাহ তাআলা শবে বরাতে বা লাইলাতুল বারাতে জমিনে ঘোষণা করে দেন আজ রাতে দুই শ্রেণীর মানুষ ব্যতীত বাকি সবাইকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে। যে দুই শ্রেণীর লোককে ক্ষমা করা হবে না তারা হচ্ছে, মুশরিক অর্থাৎ যারা আল্লাহ তায়ালার সাথে ইবাদতে অন্য কাউকে শরিক করে এবং হিংসুক।
শবে রাতে করণীয়:
১/ মাগরিবের পর থেকে নিয়ে সুবহে সাদিক পর্যন্ত বেশি বেশি করে কোরআন তেলাওয়াত করা।
২/ যত বেশি সম্ভব নফল সালাত আদায় করা।
৩/ জিকির আজকার করা। বিভিন্ন ফজিলতপূর্ণ হাদিসে বর্ণিত মাসনুন দোয়া গুলো পাঠ করা।
৪/নিজ মা বাবা আত্মীয়-স্বজন এবং যত মুমিন মুমিনাত দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করেছেন তাদের রুহের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করা।
৫/ যারা দুনিয়ায় বেঁচে আছে তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা, সুস্বাস্থ্য ও হালাল রিজিকের জন্য দোয়া করা এবং সারা বিশ্ববাসীর শান্তি কামনা করে আল্লাহ তাআলার দরবারে প্রার্থনা করা।
৬/রাতের বেলা ইবাদত করা এবং দিনের বেলা নফল রোজা রাখা। হাদিস শরিফে এসেছে; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, শাবান মাসের পনেরতম রাতে তোমরা ইবাদত করো আর দিনের বেলায় রোজা রাখো।
সবচেয়ে উত্তম হবে, যদি আইয়ামে বীজ তথা শাবান মাসের ১৩,১৪,১৫ তারিখসহ রোজা রাখে। কেননা প্রতি মাসে এই তিন দিন রোজা রাখা সুন্নাত।
শবে বরাতে বর্জনীয়:
• ১/জামাতবদ্ধ হয়ে মসজিদে জিকির আজকার দোয়া দরুদ পাঠ করা।
• ২/নামাজের রাকাত সংখ্যা নির্দিষ্ট করে নেওয়া।
• ৩/ নির্দিষ্ট সুরা দিয়ে নির্দিষ্ট নামাজ আদায়ের কথা বিভিন্ন বইয়ে প্রচলিত আছে সেগুলো উপর আমল করা।
• ৪/ মাইক ছেড়ে ওয়াজ নসিহত করা সবিনা খতম করা ইত্যাদি। কারণ এতে অন্য মানুষের ইবাদতে ব্যাঘাত ঘটে। ঘুমের ডিস্টার্ব হয়। অসুস্থ মানুষ কষ্ট পায় এবং লেখাপড়ায় ব্যস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যাঘাত ঘটে। অযথা মানুষকে কষ্ট দেওয়া হয়, যা শরীয়তের দৃষ্টিতে কোনভাবেই বৈধ নয়।
• ৫/মাজারে মাজারে ঘুরে বেড়ানো । মাজার জিয়ারত করা কিংবা কবরস্থানে দল বেঁধে গিয়ে কবর জিয়ারত করা।
• ৬/ মোল্লা মুনশি ডেকে কবর জিয়ারত করানো। কারণ হাদীসে কবর জিয়ারত করার কথা বলা হয়েছে। অন্যকে ডেকে কবর জিয়ারত করানোর কথা কোথাও নেই। তাছাড়া জিয়ারতের সাথে এই দিনের তো কোনো বিশেষ সম্পর্ক নেই। তবে কেউ যদি একাকী কবরস্থানে গিয়ে নিজ বাবামার বা আত্মীয় স্বজনের কবর জিয়ারত করে তাহলে সমস্যা নেই।
• ৭/ শবে বরাতের মাগরিবের পর গোসলের মধ্যে কোন ফজিলত নেই ।কেউ ফজিলতের নিয়তে গোসল করলে তা বিদআত হবে। তবে ইবাদতের জন্য প্রস্তুতি হিসেবে ওযু গোসল খুশবু ব্যবহার করলে এতে কোন আপত্তির কিছু নেই।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে, সাবান মাসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব বেশি রোজা রাখতেন। যা অন্য কোন মাসে তার থেকে দেখা যেত না। হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদিয়াল্লাহু তা`আলা আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, শাবান মাসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ধারাবাহিক রোজা রাখতেন। এমনকি আমরা বলতাম যে তিনি ইফতার করবেন না অথচ তিনি ইফতার করতেন। আবার যখন তিনি রোজা রাখতেন না আমরা মনে করতাম তিনি হয়তো আর রোজা রাখবেন না।
আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু তা`আলা বলেন, রমজান মাস ছাড়া অন্য কোন মাসে আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পুরো মাস রোজা রাখতে দেখিনি আর শাবান মাস থেকে অধিক পরিমাণে রোজা রাখতে অন্য কোন মাসে দেখিনি । বুখারী ও মুসলিম।
আল্লাহ তা`আলা সবাইকে শবে বরাতের পবিত্রতা বজায় রেখে শবে বরাতের কল্যাণ বরকত অর্জন করার এবং সকল প্রকার শিরক বেদাত কুসংস্কার বর্জন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক, মুফতি রায়হান আহমাদ ফারুকী,
চেয়ারম্যান সৃষ্টির কল্যাণে ফাউন্ডেশন।
আপনার মতামত লিখুন :