ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৬ মার্চ, ২০২৫

আল কোরআনের প্রত্যয় ও শুদ্ধাচার চর্চা

ব্যারিস্টার মুতাসিম বিল্লাহ ফারুকী
প্রকাশিত: মার্চ ৬, ২০২৫, ০৫:৪৫ পিএম
ব্যারিস্টার মুতাসিম বিল্লাহ ফারুকী

নৈতিকতা ও মূল্যবোধ দেশের সর্বাধিক চর্চিত বিষয় হলেও সামাজিকভাবে প্রতিনিয়তই শুনতে হয় নৈতিকতার অবক্ষয় তথা সদাচার, শুদ্ধাচারের সংকটের কথা! এ ছাড়া নৈতিক মূল্যবোধ, সদাচার তথা শুদ্ধাচার চর্চার অভাবই সমাজে দুর্নীতি, অপরাজনীতি, সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণু আচরণ, ধর্মান্ধতা প্রভৃতির মূল কারণ সে বিষয়েও সবাই একমত এবং এটাও সবাই মনে করেন যে, এ অবস্থার আশু উত্তরণ জরুরি কেননা শুদ্ধাচার চর্চাই পারে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও শান্তিপূর্ণ সমাজ তথা বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় মুখ্য ভূমিকা রাখতে। 

কিন্তু কীভাবে এ অবস্থার উত্তরণ করা যাবে, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ এর সমাধান খুঁজেন বিদেশি বুদ্ধিজীবীদের লেখায়, জীবনচরিতে! অনেকেই প্রেরণা খুঁজেন দেশের সাংবিধানিক মূলনীতি ও বৈশিষ্ট্যের এবং প্রচলিত আইন ও প্রথায়।

অথচ মহাগ্রন্থ আল কোরআন কি চমৎকারভাবেই না শিক্ষা দেয় শুদ্ধাচারের, নির্দেশনা দেয় মানবিক মানুষ হওয়ার! হযরত মোহাম্মাদ (সা. আ.) এর জীবন ও চরিত বিশ্লেষণ ও তা অনুসরণের মাধ্যমে যে কেউ নিজেকে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন। এ জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্র ও সমাজে ইসলাম নির্দেশিত শুদ্ধাচার চর্চার সমন্বিত উদ্যোগ। 

ইসলামের দৃষ্টিতে সদাচারের সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- 
১। সততা ও ন্যায়বিচার 
২। দয়া ও সহানুভূতি 
৩। বিনয় ও নম্রতা 
৪। ক্ষমাশীলতা, মহানুভবতা, ধৈর্যশীলতা

৫। অন্যের প্রতি সম্মান দেখানো

আল কোরআন আমাদের সদাচার তথা শুদ্ধাচার শিক্ষার অন্যতম মাধ্যম হতে পারে; সদাচারের গুরুত্ব, ধর্ম বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে সবার সমঅধিকার কি অসাধারণ ভাবেই না সুরা আল হুজারাত আয়াত ১৩ তে বর্ণিত হয়েছে; তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদা সম্পন্ন যে অধিক তাকওয়া (বিষষ নবযধাবফ) অর্জন করেছে। এই তাকওয়া অর্জনের তাগিদেই আছে সব শুভ কাজ, শুদ্ধাচার চর্চার তাগিদ এবং বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে মানুষের সমমর্যাদার ঘোষণা।

মক্কা বিজয়ের পর আল্লাহর এই বাণী উদ্ধৃত করে, হযরত মোহাম্মাদ (সা. আ.) বলেছেন, সব প্রশংসা মহান আল্লাহর, যিনি তোমাদের থেকে দোষ-ত্রুটি এবং অহংকার দূর করে দিয়েছেন। 

বিদায় হজের ভাষণেও তিনি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, হে লোকজন, সাবধান, তোমাদের আল্লাহ একজন; কোনো আরবের ওপর অনারবের, কোনো অনারবের ওপর আরবের, কোন কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের, কোনো শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের কোনো আধিপত্য নেই। 

আমাদের দেশে পরচর্চা ও পরনিন্দা একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জেনে না জেনে, বুঝে না বুঝে আমরা প্রতিনিয়ত ভয়ংকর এই অসদাচরণ করে যাচ্ছি। কোনোভাবেই এ অবস্থার উন্নয়ন করা যাচ্ছে না। না ব্যক্তি জীবনে, না সামাজিক জীবনাচরণে। অথচ আল কোরআনেই এর প্রতিকার রয়েছে। 

মহান আল্লাহ সুরা হুমাযাহ (আয়াত ১-৩) তে বলেছেন,
وَيْلٌ لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةٍ
ٱلَّذِى جَمَعَ مَالًا وَعَدَّدَهُ يَحْسَبُ أَنَّ مَالَهُۥٓ أَخْلَدَهُۥ 
অর্থাৎ, 
দুর্ভোগ তাদের যারা সামনে অথবা পেছনে অন্যের নিন্দা করে এবং অর্থ সঞ্চিত করে রাখে আর গণনা করে কিন্তু ভালো কাজে ব্যয় করে না। এ ঘোষণার মাধ্যমে ইসলাম শেখায় পরচর্চা, পরনিন্দা না করার, শিক্ষা দিচ্ছেন অর্থ জমিয়ে না রেখে ভালো কাজে ব্যয় করার। কি অসাধারণ নৈতিকতার গাইডলাইনস। এখানেই ক্ষান্ত হননি মহান আল্লাহ, পরচর্চাকারীদের জন্যে কঠিন শাস্তির ঘোষণা দিয়েছেন। 

এ তথ্য জানা কোনো বিশ্বাসী মানুষ কখনোই এ ধরনের জঘন্য কাজে লিপ্ত হবেন না। আল কোরআন সর্বাধিক গুরুত্ব দেয় ন্যায়বিচার ও সততার ওপর। 
সূরা আন নিসা’তে আমরা এর চমৎকার বর্ণনা পাই (৪-৫৮)
এ সূরায় নর-নারীর পারস্পরিক সম্পর্ক এবং অধিকার বিষয় উল্লেখিত হয়েছে। স্বামী-স্ত্রী, ইয়াতিম, আত্মীয়-স্বজন, ক্রেতা, বিক্রেতা এবং শ্রমিকের অধিকার বিষয়ে তাকওয়া অর্জনের কথা বলে বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। 

অন্যের হক বা অধিকার বিষয়ে সচেতন থাকা এবং তা আদায়ে সচেষ্ট থেকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা ইসলামের দৃষ্টিতে বাধতামূলক। আল্লাহ ভীতি আর আখেরাতে শাস্তির ভয়ই এসব অধিকার সংরক্ষণে প্রত্যেককে আন্তরিক ও সচেতন করে তুলতে সক্ষম।

সূরা নাহাল আয়াত ৯০ এর মাধ্যমেও আমরা নৈতিকতার দারুণ শিক্ষা নিতে পারি

اِنَّ اللّٰہَ یَاۡمُرُ بِالۡعَدۡلِ وَالۡاِحۡسَانِ وَاِیۡتَآیِٔ ذِی الۡقُرۡبٰی وَیَنۡہٰی عَنِ الۡفَحۡشَآءِ
وَالۡمُنۡکَرِ وَالۡبَغۡیِ ۚ یَعِظُکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَذَکَّرُوۡنَ

এ সূরায় মহান আল্লাহ ইনসাফ তথা ন্যায়পরায়ণতা, দয়া , সদাচার ও আত্মীয় স্বজনদের প্রতি দায়িত্ব পালন ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন এবং অশ্লীলতা, মন্দকাজ ও সীমা লঙ্ঘন বা জুলুম করতে নিষেধ করেছেন।

মহানুভবতা, ধৈর্যশীলতা, অন্যের প্রতি সম্মান জানানো 

আল কোরআন আমাদের মহানুভবতা, ক্ষমাশীলতা, ধৈর্যশীলতা, অন্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের শিক্ষা দেয়। সুরা আল বাকারা আয়াত ৮৩ এ বর্ণিত হয়েছে;

وَ اِذۡ اَخَذۡنَا مِیۡثَاقَ بَنِیۡۤ اِسۡرَآءِیۡلَ لَا تَعۡبُدُوۡنَ اِلَّا اللّٰهَ ۟ وَ بِالۡوَالِدَیۡنِ اِحۡسَانًا وَّ ذِی الۡقُرۡبٰی وَ الۡیَتٰمٰی وَ الۡمَسٰكِیۡنِ

وَ قُوۡلُوۡا لِلنَّاسِ حُسۡنًا وَّ اَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَ اٰتُوا الزَّكٰوۃَ ؕ ثُمَّ تَوَلَّیۡتُمۡ اِلَّا قَلِیۡلًا مِّنۡكُمۡ وَ اَنۡتُمۡ مُّعۡرِضُو﴾

আর যখন বনী ইসরাইলের অঙ্গীকার নিয়েছিলাম যে, তোমরা আল্লাহ ব্যতিত কারো ইবাদত করবে না এবং সদয় ব্যবহার করবে মাতা পিতা, আত্মীয়স্বজন, এতিম ও গরিবদের সঙ্গে। সদাচার করবে মানুষের সঙ্গে এবং যথাযথভাবে সালাত প্রতিষ্ঠা ও যাকাত আদায় করবে। 

⁠ক্ষমাশীলতা 
ক্ষমা করা মানুষের একটি অনুকরণীয় মহৎ গুণ। ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয় অন্যের দোষ-ত্রুটি ক্ষমা করার। সূরা আল ইমরান আয়াত ১৩ তে আল্লাহ বলেছেন, তোমরা যদি অন্যকে ক্ষমা করো আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করবেন।’ 

আল কোরআন আমাদের মানবসেবার সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা পাই মানবিক মানুষ হবার অনুপ্রেরণা। আমরা হতে শিখি দয়া ও সহানুভূতিশীল। 

সূরা আল মাউন এ উল্লেখিত হয়েছে। 
اَرَءَیۡتَ الَّذِیۡ یُكَذِّبُ بِالدِّیۡ﴾
فَذٰلِكَ الَّذِیۡ یَدُعُّ الۡیَتِیۡمَ
وَ لَا یَحُضُّ عَلٰی طَعَامِ الۡمِسۡكِیۡنِ ؕ﴾
فَوَیۡلٌ لِّلۡمُصَلِّیۡ
الَّذِیۡنَ هُمۡ عَنۡ صَلَاتِهِمۡ سَاهُوۡن 
الَّذِیۡنَ هُمۡ یُرَآءُوۡنَ﴿
وَ یَمۡنَعُوۡنَ الۡمَاعُوۡنَ
অর্থাৎ 
তুমি কি তাকে দেখেছ, যে কর্মফল দিবসকে অস্বীকার করে?
সে তো সেই (লোক) যে এতিমকে ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেয়, 
এবং সে অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দানে উৎসাহ প্রদান করে না, 
অতএব পরিতাপ সেই সব সালাত আদায়কারীদের জন্য 
যারা নিজেদের নামাজের ব্যাপারে উদাসীন,
যারা লোক দেখানোর জন্য তা করে,
এবং গৃহস্থালীর প্রয়োজনীয় ছোটখাট সাহায্য দানে বিরত থাকে।

এ সূরা থেকে আমরা শিখতে পারি যে, অন্যকে সাহায্য করা তথা মানবসেবা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব। গরিব, এতিম আর সাহায্য প্রার্থীর সঙ্গে সুন্দর আচরণ করা, সহযোগিতা করার নৈতিক বাধ্যবাদকতা রয়েছে আমাদের সবার। এই সূরায় ভণ্ডামি বা লোক দেখানো কাজ এমনকি ধর্মচর্চাকেও ধিক্কার জানানো হয়েছে।

বিনয় ও নম্রতার দীক্ষা 
আল কোরআনের মাধ্যমে ইসলাম আমাদের শিখায় গর্ব পরিহার করে বিনয়ী ও নম্র হতে। সূরা আল মুমিনুন আয়াত ৬ এ মহান আল্লাহ বলেছেন, পৃথিবীতে যারা আল্লাহকে ভয় করে এবং নিজেদের অহংকার থেকে দূরে রাখে তাদের জন্য রয়েছে শ্রেষ্ঠ পুরুস্কার।

বাংলাদেশ মুসলিমপ্রধান দেশ হলেও ইসলামিক জ্ঞানচর্চা তেমন উৎকর্ষতা অর্জন করেছে বা সার্বজনীন হয়েছে তা বলা যাবে না! ফলে আমাদের সমাজে ইসলামের আদর্শ, নির্দেশনা জানা এবং সে অনুযায়ী জীবন গঠনের প্রচেষ্টা খুব কমই দেখা যায়!  

এ ছাড়া পশ্চিমা সংস্কৃতির কুপ্রভাব ও পশ্চিমা বিশ্বের ইসলামবিরোধী প্রচার আমাদের তরুণদের ইসলাম সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে কিছুটা হলেও সফল হয়েছে! 

অথচ আল কোরআনের জ্ঞান অর্জনই সব অপ সংস্কৃতির বেড়াজাল পেরিয়ে আমাদের তরুণদের করতে পারে সহজ সরল পথের দিশারী এবং এ জাতি পেতে পারে সব সামাজিক সমস্যার সমাধান। এর জন্য প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার, দরকার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার। 

সঙ্গে সঙ্গে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম, সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন সমূহের এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করাও জরুরি। আল কোরআনের আলোকযাত্রায় সবাইকে সাথী করা গেলে, আমাদের আবালবৃদ্ধবনিতা বিশেষ করে তরুণদের ইসলামী শিক্ষার বিষয়ে আগ্রহী করে তোলা সম্ভব হবে। 

আল কোরআন ও আল হাদিস সহি শুদ্ধভাবে জানা এবং লব্ধ জ্ঞান অনুযায়ী জীবনাচার তৈরির মাধ্যমেই আমরা হতে পারি পরিবার তথা সমাজের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস এবং গড়ে তুলতে পারি আদর্শ সমাজ তথা গর্বের বাংলাদেশ। সেইসঙ্গে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে পরকালে পেতে পারি অনন্ত সুখ, শান্তি ও সফলতা।