লাইলাতুল কদর হলো এক মহিমান্বিত রাত, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ রাতে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে যা মানবজাতির জন্য এক মহা রহমত ও কল্যাণের উৎস। আল্লাহ তা` য়ালা এই রাতকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন এবং কুরআনে সূরা আল-কদরে স্পষ্টভাবে এর গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। হাদিস অনুযায়ী এ রাতে সঠিকভাবে ইবাদত করলে হাজার মাসের ইবাদতের সওয়াব পাওয়া যায়। তাই প্রতিটি মুসলিমের উচিত এই রাতের গুরুত্ব উপলব্ধি করা এবং এর ফজিলত অর্জনের জন্য সচেষ্ট থাকা।
১. লাইলাতুল কদরের নির্দিষ্ট সময়
কুরআন ও হাদিসের আলোকে লাইলাতুল কদর রমজানের শেষ দশকের কোনো এক বিজোড় রাতে হয়ে থাকে। বিশেষ করে ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯তম রাতে লাইলাতুল কদর পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "তোমরা লাইলাতুল কদরকে রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে অনুসন্ধান করো" (বুখারি ও মুসলিম)। অনেক ইসলামি বিশেষজ্ঞের মতে, ২৭তম রাতেই লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি তবে নিশ্চিতভাবে কেউ তা বলতে পারে না। তাই আমাদের উচিত পুরো শেষ দশকে ইবাদতে মশগুল থাকা যেন লাইলাতুল কদরের ফজিলত লাভ করা যায়।
২. লাইলাতুল কদর চেনার বাহ্যিক আলামত
লাইলাতুল কদর চেনার কিছু বাহ্যিক লক্ষণ রয়েছে যা রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবিরা বর্ণনা করেছেন। এ রাতের কিছু দৃশ্যমান আলামত হলো:
আকাশের স্বচ্ছতা ও আবহাওয়ার শীতলতা: লাইলাতুল কদরের রাতে আকাশ অত্যন্ত পরিষ্কার ও স্বচ্ছ থাকে। এ রাতে কোনো ঝড়-বৃষ্টি বা মেঘাচ্ছন্ন অবস্থা থাকে না। বাতাস হালকা ও শান্তিময় অনুভূত হয়।
স্নিগ্ধ ও প্রশান্ত পরিবেশ: এই রাতটি অত্যন্ত প্রশান্তিময় হয়। কোনো অতিরিক্ত গরম বা প্রচণ্ড ঠান্ডা অনুভূত হয় না, বরং আবহাওয়া ভারসাম্যপূর্ণ ও আরামদায়ক থাকে।
সূর্যের কোমল আলো: লাইলাতুল কদর শেষে পরদিন সকালে সূর্য উদয় হয় অত্যন্ত কোমল আলো নিয়ে। সূর্যের আলো মৃদু ও অতিরিক্ত উজ্জ্বলতা ছাড়াই দেখা যায়।
অস্বাভাবিক নিরবতা ও সান্ত্বনা: এ রাতে চারপাশে একটি অদ্ভুত নিরবতা বিরাজ করে, যা অনুভবযোগ্য। পশুপাখিরা সাধারণের তুলনায় কম শব্দ করে এবং রাতটি অন্য সব রাতের চেয়ে শান্ত মনে হয়।
৩. লাইলাতুল কদর চেনার আধ্যাত্মিক আলামত
এটি এমন একটি রাত যখন একজন মুমিন নিজের অন্তরে এক বিশেষ অনুভূতি পেতে পারে। কিছু আধ্যাত্মিক আলামত হলো:
অতিরিক্ত আত্মিক প্রশান্তি অনুভূত হওয়া: লাইলাতুল কদরের রাতে ইবাদত করলে হৃদয়ে এক অপূর্ব প্রশান্তি নেমে আসে। মনে হয় যেন আল্লাহর রহমত প্রবাহিত হচ্ছে।
ইবাদতে অদ্ভুত এক আগ্রহ সৃষ্টি হওয়া: সাধারণ দিনের চেয়ে বেশি বেশি ইবাদতে মন বসে এবং অলসতা দূর হয়ে যায়। অনেক সময় দীর্ঘ সময় ইবাদত করার পরও ক্লান্তি অনুভূত হয় না।
দোয়া কবুল হওয়ার অনুভূতি: এ রাতে আল্লাহর কাছে দোয়া করলে মনে হয় যেন দোয়া কবুল হয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় অশ্রুসজল হয়ে যায় এবং আত্মশুদ্ধির এক অনন্য অভিজ্ঞতা লাভ হয়।
গুনাহ থেকে মুক্তির প্রবল ইচ্ছা সৃষ্টি হওয়া: লাইলাতুল কদরের রাতে আত্মশুদ্ধির প্রবল ইচ্ছা জাগে। নিজের পাপ কাজের জন্য অনুতপ্ত হয়ে মানুষ কান্নাকাটি করে এবং আল্লাহর রহমত কামনা করে।
৪. লাইলাতুল কদর পরবর্তী সকাল
লাইলাতুল কদরের এক বিশেষ আলামত হলো এর পরদিন সকালে সূর্যের আলো অন্য দিনের চেয়ে কিছুটা ব্যতিক্রমী হয়।
সূর্যের আলো নরম ও কিরণহীন হয়: এদিন সূর্যের আলো খুব বেশি উজ্জ্বল হয় না বরং মিষ্টি ও কোমল থাকে যা সহজেই খালি চোখে দেখা যায়।
সকালটি অন্য দিনের তুলনায় শান্তিপূর্ণ হয়: সকাল বেলা পরিবেশে এক ধরনের প্রশান্তি বিরাজ করে। সাধারণত এই সময় বাতাস থাকে মৃদু এবং মনে হয় যেন প্রকৃতি আল্লাহর রহমতে পূর্ণ হয়ে আছে।
পশুপাখিদের স্বাভাবিক আচরণে পরিবর্তন: অনেক সময় লক্ষ্য করা যায় যে পাখিরা অন্যদিনের তুলনায় কম ডাকছে বা ভিন্ন আচরণ করছে। এই বিষয়গুলো সাহাবিরা পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং হাদিসে পাওয়া যায়।
৫. লাইলাতুল কদরের ইবাদত ও করণীয়
যেহেতু এই রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদতের চেয়ে বেশি সওয়াবের, তাই আমাদের উচিত এই রাতে সর্বোচ্চ ইবাদত করা। কিছু করণীয় বিষয় হলো:
নফল নামাজ পড়া: যত বেশি সম্ভব তাহাজ্জুদ ও অন্যান্য নফল নামাজ পড়া উচিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ইমানের সঙ্গে ও সওয়াবের আশায় ইবাদত করে তার পূর্ববর্তী সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়" (বুখারি ও মুসলিম)।
কুরআন তিলাওয়াত: এই রাতে বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত এবং কুরআনের আয়াত নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করা উচিত।
জিকির ও তাসবিহ: এই রাতে "সুবহানাল্লাহ", "আলহামদুলিল্লাহ", "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ", "আল্লাহু আকবার" ইত্যাদি জিকির বেশি বেশি করা উচিত।
গুনাহ থেকে মুক্তির দোয়া করা: রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদের শিখিয়েছেন, লাইলাতুল কদরে এই দোয়াটি বেশি বেশি পড়তে:
اللهم إنك عفو تحب العفو فاعف عني
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা`ফু আন্নি।
অর্থ: "হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমা করতে ভালোবাসো, আমাকে ক্ষমা করে দাও।"
দরিদ্রদের সাহায্য করা: এ রাতে দান-সদকা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গরিব ও অসহায় মানুষদের সাহায্য করা লাইলাতুল কদরের অন্যতম বড় আমল।
লাইলাতুল কদর এক মহিমান্বিত রাত, যা আমাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়গুলোর একটি। এটি চিনে নেওয়া এবং যথাযথ ইবাদতের মাধ্যমে এর সওয়াব অর্জন করা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই রাতের বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক আলামত দেখে আমরা উপলব্ধি করতে পারি কখন এটি হতে পারে। তাই আমাদের উচিত শেষ দশকের প্রতিটি বিজোড় রাতে ইবাদতে মশগুল থাকা, যেন আমরা লাইলাতুল কদরের বরকত ও আল্লাহর রহমত অর্জন করতে পারি।
আসুন, আমরা সবাই এই রাতের মর্যাদা বুঝে ইবাদতে মনোযোগী হই। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই এবং জান্নাত লাভের আশায় সারাটি রাত ইবাদতে কাটাই।
আপনার মতামত লিখুন :