লাইলাতুল কদর বা শবে কদর ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাতগুলোর একটি। এটি এমন এক রাত যা এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এই রাতে আল্লাহ তায়ালা অসংখ্য বান্দাকে গুনাহ থেকে মুক্তি দেন এবং তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করেন।
এ রাতে ফেরেশতারা নেমে আসেনএবং রহমতের দরজা খুলে দেওয়া হয়। পাশাপাশি মুমিনদের জন্য অফুরন্ত কল্যাণ বরাদ্দ করা হয়। তাই এই রাতে ইবাদত-বন্দেগি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও কল্যাণকর।
লাইলাতুল কদরের বিশেষ আমল
১. নফল নামাজ পড়া:
এই রাতে নফল নামাজ পড়ার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। যত বেশি সম্ভব নামাজ আদায় করা উচিত।
তাহাজ্জুদ নামাজ: তাহাজ্জুদ নামাজ লাইলাতুল কদরের অন্যতম প্রধান আমল। এটি বান্দার প্রতি আল্লাহর ভালোবাসা ও রহমত লাভের অন্যতম মাধ্যম। কমপক্ষে ২ রাকাত বা সম্ভব হলে ৮-১২ রাকাত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া যেতে পারে।
সালাতুত তাওবা (গুনাহ মাফের নামাজ): অতীতের গুনাহ থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া জরুরি।
২ বা ৪ রাকাত সালাতুত তাওবা পড়ে আল্লাহর কাছে অনুতপ্ত হওয়া উচিত।
সালাতুত তাসবিহ: এটি বিশেষ একটি নামাজ, যা রাসুল (সা.) অনেক ফজিলতের কথা বলেছেন।
এতে ৩০০ বার ‘সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার’ পাঠ করা হয়।
২. কুরআন তিলাওয়াত করা
লাইলাতুল কদরে কুরআন তিলাওয়াত করা সবচেয়ে উত্তম আমলগুলোর একটি।
কুরআন পাঠের ফজিলত: এই রাতে কুরআন তিলাওয়াত করা বান্দার গুনাহ মাফের জন্য বড় মাধ্যম।
আল্লাহর কাছে নৈকট্য অর্জনের জন্য কুরআনের আয়াতের ওপর গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করা উচিত।
অর্থসহ তিলাওয়াতের গুরুত্ব: শুধু আরবি পড়াই যথেষ্ট নয়, বরং কুরআনের অর্থ বোঝার চেষ্টা করা জরুরি।
এই রাতে সূরা আল-কদর, সূরা ইয়াসিন, সূরা আর-রহমান, সূরা আল-ইখলাস পড়া অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ।
৩. জিকির ও তাসবিহ পাঠ করা
লাইলাতুল কদরে বেশি বেশি জিকির করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
উত্তম জিকির সমূহ:
# সুবহানাল্লাহ ওয়া বিহামদিহি, সুবহানাল্লাহিল আজিম।
# লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।
# আস্তাগফিরুল্লাহ।
দরূদ শরিফ পাঠ:
রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি বেশি বেশি দরূদ পড়ে, সে কিয়ামতের দিন তার সুপারিশ লাভ করবে।
"اللهم صل على محمد وعلى آل محمد كما صليت على إبراهيم وعلى آل إبراهيم إنك حميد مجيد।"
৪. দোয়া ও ইস্তিগফার করা
লাইলাতুল কদর দোয়া কবুলের রাত।
রাসুলুল্লাহ (সা.) শিখানো বিশেষ দোয়া:
اللهم إنك عفو تحب العفو فاعف عني
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা`ফু আন্নি।
অর্থ: "হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমা করতে ভালোবাসো, আমাকে ক্ষমা করে দাও।"
গুনাহ মাফের দোয়া:
"রব্বানাঘফির লানা, ওয়া লি-ওয়ালিদাইনা, ওয়া লি-আহলিনা, ওয়া লি-মাসায়িখিনা, ওয়া লি-জামি আল মুসলিমিনা ওয়াল মুসলিমাত।"
অতীতের সকল পাপ থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে দোয়া করা উচিত।
রিজিক বৃদ্ধির দোয়া: "আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা রিজকান হালালান তায়্যিবান।"
হেদায়েত ও সুস্থতার দোয়া: "আল্লাহুম্মা ইহদিনা সিরাতাল মুস্তাকিম।"
পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের জন্য দোয়া: পরিবারের কল্যাণের জন্য আল্লাহর কাছে সুস্থতা, ঈমান, ও বরকতের দোয়া করা উচিত।
উম্মতের কল্যাণের জন্য দোয়া: গোটা মুসলিম উম্মাহর জন্য শান্তি ও কল্যাণ কামনা করা।
৫. দান-সদকা ও সৎকাজ করা
লাইলাতুল কদরে দান-সদকা করার সওয়াব অনেক গুণ বৃদ্ধি করা হয়।
গরিব ও অসহায়দের সাহায্য করা: যারা দুস্থ ও দরিদ্র, তাদের সহায়তা করা এক মহৎ আমল।
খাদ্য, পোশাক, বা আর্থিক সাহায্য প্রদান করা যেতে পারে।
মসজিদ ও মাদ্রাসায় দান করা: আল্লাহর ঘরের উন্নতির জন্য দান করা এই রাতে অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ।
সৎকাজ করা ও অন্যদের উপকারে আসা: নিজের আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীর খোঁজ-খবর নেওয়া উচিত।
সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ থেকে বিরত থাকার শিক্ষা দেওয়া।
৬. তওবা ও আত্মশুদ্ধি করা
এই রাতে আল্লাহর কাছে খাঁটি মনে তওবা করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
অতীত জীবনের ভুলের জন্য অনুতপ্ত হওয়া: নিজের গুনাহের কথা স্মরণ করে চোখের পানি ঝরানো উচিত।
আল্লাহর কাছে দোয়া করা উচিত যেন ভবিষ্যতে পাপ থেকে বিরত থাকতে পারি।
ভবিষ্যতে সৎপথে থাকার অঙ্গীকার করা: নামাজ ও ইবাদতের প্রতি যত্নবান হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
হারাম কাজ বর্জন করে হালাল পথে চলার দৃঢ় সংকল্প করা উচিত।
লাইলাতুল কদর মুসলমানদের জন্য অশেষ নিয়ামত ও বরকতময় এক রাত। এই রাতে ইবাদত করলে এক হাজার মাসের সওয়াব লাভ করা যায়। তাই এই সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত নয়। আমাদের উচিত, এই রাতকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো, বেশি বেশি নামাজ, কুরআন তিলাওয়াত, জিকির, দোয়া, তওবা, ও দান-সদকার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে লাইলাতুল কদরের বরকত লাভ করার তৌফিক দান করুন। আমিন।