ঢাকা সোমবার, ৩১ মার্চ, ২০২৫

সদকাতুল ফিতর আদায়ের সময় ও পদ্ধতি

ধর্ম ডেস্ক
প্রকাশিত: মার্চ ২৯, ২০২৫, ১০:০০ এএম
ছবি: সংগৃহীত

সদকা মানে দান, আর ফিতর মানে রোজার সমাপন বা ঈদুল ফিতর। অর্থাৎ ঈদুল ফিতরের দিন আদায় করা সদকাকেই সদকাতুল ফিতর বলা হয়। এটিকে জাকাতুল ফিতর বা ফিতরাও বলা হয়ে থাকে।

ইসলামের দৃষ্টিতে রমজানের শেষে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের ওপর সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘সাফল্য লাভ করবে সে, যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে, আর তার প্রতিপালকের নাম স্মরণ করে ও নামাজ কায়েম করে।’ (সুরা: আলা, আয়াত: ১৪-১৫)

ইমাম ইবন কাসির (রহ.) উল্লেখ করেছেন, উমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) মানুষকে ফিতরার জাকাত দিতে বলতেন এবং এই আয়াত তিলাওয়াত করতেন। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) সদকাতুল ফিতর অপরিহার্য করেছেন।

ছোট-বড়, স্বাধীন-পরাধীন সবার ওপরই এটি ওয়াজিব।’ (বুখারি, হাদিস : ১৫১২)
ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা দিয়েছেন: ‘ফিতরার জাকাত প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ওয়াজিব।’ (আল-হাকিম, সহিহ সনদ)

সদকাতুল ফিতর কেন: জাকাতের মতো সদকাতুল ফিতরও একটি আর্থিক ইবাদত। পবিত্র মাহে রমজানে সিয়াম পালন করতে গিয়ে সাধারণত আমাদের অনেক ভুলত্রুটি হয়ে যায়। সেই ত্রুটি-বিচ্যুতির ক্ষতিপূরণ হিসেবে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে নির্ধারিত একটি ইবাদতের নাম সদকাতুল ফিতর। এটি পরম করুণাময় মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি পবিত্র উপহারও বটে।

হাদিস শরিফে সদকাতুল ফিতরকে কাফফারাতুন লিসসাওম, অর্থাৎ রোজা অবস্থায় অবচেতনভাবে যে ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে যায়, তার কাফফারা বা ক্ষতিপূরণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

তা ছাড়া এটি সেই দান, যা ঈদের খুশিতে ধনী-গরিব সবাইকে অংশীদার করে এবং অভাবিদের সহায়তা করে। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) সদকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন- অশ্লীল কথা ও বেহুদা কাজ থেকে (রমজানের) সাওমকে পবিত্র করতে এবং মিসকিনদের খাদ্যের ব্যবস্থার জন্য।

যে ব্যক্তি (ঈদের) নামাজের পূর্বে তা আদায় করে সেটা কবুল সদকা গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি নামাজের পরে আদায় করে, তা সাধারণ দান হিসেবে গৃহীত হবে। (আবু দাউদ, হাদিস: ১৬০৯)

ইবন আবদুল বার (রহ.) বলেন, আহলে ইলমের দৃষ্টিতে ‘ফরজ’ শব্দের অর্থ হলো ‘ওয়াজিব’। আর যা রাসুলুল্লাহ (সা.) ওয়াজিব করেছেন, তা আল্লাহর নির্দেশেই ওয়াজিব করেছেন। তিনি কখনো নিজ ইচ্ছায় কিছু বলেননি। (আল-ইস্তিজকার : ৩/২৬৫)

ওকী ইবনুল জাররাহ (রহ.) বলেন, ‘ফিতরার জাকাত নামাজের জন্য সাহু সিজদার মতো, যা ছোটখাটো ভুলত্রুটি পূরণ করে।’

এটি কার ওপর ওয়াজিব : সদকাতুল ফিতরের নিসাব জাকাতের নিসাবের সমপরিমাণ। অর্থাৎ কারো কাছে সাড়ে সাত ভরি সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা অথবা তার সমমূল্যের নগদ অর্থ কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অতিরিক্ত সম্পদ ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের সময় বিদ্যমান থাকলে তার ওপর সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব হবে। যার ওপর সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব, তিনি নিজের পক্ষ থেকে যেমন আদায় করবেন, তেমনি নিজের অধীনদের পক্ষ থেকেও আদায় করবেন। তবে এতে জাকাতের মতো বর্ষ অতিক্রম হওয়া শর্ত নয়। (ফাতহুল ক্বাদির : ২/২৮১)

এমনকি পবিত্র রমজানের শেষ দিনেও যে নবজাতক দুনিয়ায় এসেছে কিংবা কোনো ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করেছে, তার পক্ষ থেকেও সদকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে। (ফাতাওয়া আলমগিরি: ১/১৯২)

সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ: এর পরিমাণ সম্পর্কে শরিয়তে দুটি মাপকাঠি নির্ধারণ করা হয়েছে; তা হচ্ছে ‘এক সা’ বা ‘নিসফে সা’। খেজুর, পনির, জব ও কিশমিশ দ্বারা আদায়ের ক্ষেত্রে এক সা =৩২৭০.৬০ গ্রাম (প্রায়) অর্থাৎ তিন কেজি ২৭০ গ্রামের কিছু বেশি। এ ছাড়া গম দ্বারা আদায় করতে চাইলে ‘নিসফে সা’=১৬৩৫.৩১৫ গ্রাম বা ১.৬৩৫৩১৫ কেজি (প্রায়) অর্থাৎ এক কেজি ৬৩৫ গ্রামের কিছু বেশি প্রযোজ্য হবে। (আওজানে শরইয়্যাহ, পৃ. ১৮)

আমাদের দেশে সতর্কতামূলক এক সা = তিন কেজি ৩০০ গ্রাম, আর আধা সা = এক কেজি ৬৫০ গ্রাম হিসাব করা হয়।
রাসুল (সা.)-এর যুগে মোট চারটি পণ্য দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করা হতো। খেজুর, কিশমিশ, জব ও পনির। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, আমাদের সময় ঈদের দিন এক সা খাদ্য দ্বারা সদকা আদায় করতাম। আর তখন আমাদের খাদ্য ছিল জব, কিশমিশ, পনির ও খেজুর। (সহিহ বুখারি)

পরবর্তী সময়ে লোকেরা অর্ধেক সা গমকে এর সমপরিমাণ ধরে নিয়েছে। (তিরমিজি, হাদিস : ৬৭৫)

উল্লিখিত খাদ্যবস্তুর পরিবর্তে সেগুলোর কোনো একটিকে মাপকাঠি ধরে তার মূল্য আদায় করলেও তা আদায় হয়ে যাবে। মূল্যের দিক থেকে ওই খাদ্যবস্তুগুলোর মধ্যে তফাত থাকলেও সবচেয়ে কম দামের বস্তুকে মাপকাঠি ধরে যদি কেউ ফিতরা আদায় করে দেয়, তাহলেও তা আদায় হয়ে যাবে। বর্তমান বাজারদর হিসাবে যেহেতু গমের দামই সবচেয়ে কম, তাই ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে প্রতিবছর আধা সা গমকে মাপকাঠি ধরে ওই সময়ের বাজারদর হিসাবে তার মূল্য ফিতরার সর্বনিন্ম পরিমাণ ঘোষণা করা হয়। এ বছর তা ১১০ টাকা। তবে এর মানে এই নয় যে ধনীরাও তাদের ফিতরা ১১০ টাকাই আদায় করবেন। উত্তম হলো, নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী বেশি মূল্যের খাদ্যবস্তুকে মাপকাঠি ধরে ফিতরা আদায় করা।

সদকাতুল ফিতর আদায়ের সময় : পবিত্র ঈদুল ফিতরের নামাজ পড়তে যাওয়ার আগেই সদকাতুল ফিতর আদায় করা উত্তম। তবে জাকাতের মতো সে সময়ের আগে রমজান মাসেও তা আদায় করা যায়। ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, লোকজনের ঈদের সালাতে বের হওয়ার পূর্বেই তা (সদকাতুল ফিতর) আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। (বুখারি, হাদিস : ১৫০৩)

প্রবাসীদের সদকাতুল ফিতর: প্রবাসীরা যদি সদকাতুল ফিতর হিসেবে খেজুর, পনির, জব, কিশমিশ, আটা ইত্যাদি দান করেন, তবে তা দুনিয়ার যেকোনো প্রান্তে সরাসরি এই জিনিসগুলো দ্বারা ফিতরা দিয়ে দিতে পারবেন। তবে কেউ যদি এগুলো না দিয়ে এগুলোর সমমূল্য পরিশোধ করতে চান, তবে সে ক্ষেত্রে ফিতরাদাতার অবস্থানরত দেশের বাজারমূল্য হিসেবে দিতে হবে

অর্থাৎ কেউ যদি সৌদি আরবে ঈদ করেন, তবে তাকে সৌদি আরবের বাজারমূল্য হিসাবে ফিতরা আদায় করতে হবে এবং তার নাবালক সন্তানদের ফিতরা যেহেতু তার ওপর ওয়াজিব সেহেতু তাদের ফিতরাও সৌদি আরবের বাজারমূল্য হিসেবে দিতে হবে, যদিও নাবালক সন্তানরা বাংলাদেশে অবস্থান করে।

তবে বাংলাদেশে অবস্থানরত সাবালক সন্তান ও স্ত্রীদের ফিতরা বাংলাদেশের বাজারমূল্য হিসেবে দেবে। (আদ্দুররুল মুখতার : ২/৩৫৫, হিন্দিয়া : ১/১৯০, দারুল ইফতা, বানুরি টাউন, ফতওয়া নং : ১৪৪০০৮২০২০০৮)।