বদর যুদ্ধ (আরবি: غزوة بدر) ইসলামের ইতিহাসে প্রথম ও প্রধান সশস্ত্র যুদ্ধ যা দ্বিতীয় হিজরীর ১৭ রমজান (১৭ মার্চ ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দ) সংগঠিত হয়। এটি মদিনার মুসলিম ও মক্কার কুরাইশদের অর্থাৎ কাফিরদের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল। এই যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলিমরা সংখ্যায় অনেক কম হয়েও মক্কার কাফির শক্তিকে পরাজিত করে ইসলামের স্বর্নোজ্জল সূচনার সৃষ্টি করেন। এই জয়ের ফলে মুসলিমদের ক্ষমতা পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পায়।
এর মাধ্যমে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য সূচিত হয়ে যায়। এজন্য এই যুদ্ধকে সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী বলা হয়। আল-কুরআনে এই দিনকে ইয়াওমূল ফুরক্বান বলা হয়।
বদর যুদ্ধের পূর্বে ৬২৩ থেকে ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে মুসলিম ও কুরাইশদের মধ্যে আটটি খন্ডযুদ্ধ বা অভিযান হয়। এইসব অভিযানের যেগুলিতে রাসুলুল্লাহ (স.) স্বয়ং অংশ গ্রহণ করতেন, সেগুলিকে ‘গাজওয়াহ’ (غَزْوَةٌ) এবং যেগুলিতে নিজে না গিয়ে অন্যদের পাঠাতেন, সেগুলিকে সারিইয়াহ (سَرِيَّةٌ) বলা হয়। এইসব অভিযানে যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে বের হলেও বলতে গেলে কোনটাতেই যুদ্ধ হয়নি।
১৭ রমজানের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে ইসলামের ইতিহাসে। দ্বিতীয় হিজরিতে বদর নামক স্থানে এই দিনে মুসলমান ও কুরাইশ বাহিনীর মধ্যে ঐতিহাসিক বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। বদরের যুদ্ধ ছিল মুসলমান ও কুরাইশদের মধ্যে প্রথম সামরিক যুদ্ধ। এ যুদ্ধ রাসূলুল্লাহ সা: নিজে এ যুদ্ধ পরিচালনা করেন। এ যুদ্ধের ফলে ইসলামে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে।
পবিত্র আল-কুরআনের সূরা আল ইমরান ও সূরা আনফালে বদর যুদ্ধের বর্ণনা এসেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘স্মরণ করো! যখন আল্লাহ তোমাকে স্বপ্নে দেখিয়েছিলেন, তারা সংখ্যায় অল্প। যদি তিনি তাদের সংখ্যায় বেশি দেখাতেন তবে তোমরা সাহস হারাতে এবং যুদ্ধের ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি করতে। কিন্তু আল্লাহ রক্ষা করেছেন। নিশ্চয় তিনি অন্তরের খবর জানেন।’ (সূরা আনফাল : ৪৩)
রাসূলুল্লাহ (সা.) ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে আল্লাহর নির্দেশে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। মদিনায় হিজরতের ফলে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইসলাম ও মুসলমানদের জীবনে এক নব অধ্যায়ের সূচনা হয়। মদিনাবাসী রাসূল্ল্লুাহ (সা.) ও ইসলামের সুমহান শান্তির বাণীকে সাদরে গ্রহণ করে। ইসলাম প্রচার ও প্রসার চার দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। মাত্র দুই বছরে রাসূলুল্লাহ (সা.) কলহপ্রিয় মাদিনাবাসীদের একটি সভ্য জাতিতে পরিণত করতে সক্ষম হন। মদিনায় শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মদিনা সনদ প্রণয়ন করা হয়।
এতে করে মদিনায় বসবাসরত পৌত্তলিক, ইহুদি, খ্রিষ্টানের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও মদিনা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সুসংহত হয়। রাসূল্ল্লুাহ (সা.) মদিনায় আগমনের পর থেকে ইসলামের প্রচারও বাড়তে থাকে। ইসলামের অপ্রতিরোধ্য অগ্রগতিতে কুরাইশরা ঈর্ষান্বিত ও নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় চিন্তিত হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় মদিনা থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করতে ব্যস্ত হয়ে যায়। তাদের এই ষড়যন্ত্রের সাথে ছিল মদিনার খাজরাজ বংশের নেতা মুনাফিক আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই। সে মদিনার শাসক হওয়ার প্রবল ইচ্ছা লালন করছিল।
কিন্তু মদিনায় ইসলাম ও রাসূলুল্লাহ (সা.) ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ একবারে বিনষ্ট হয়ে যায়। তাই সে গোপনে মক্কার কুরাইশদের সাথে ষড়যন্ত্র করে রাসূলুল্লাহ (সা.)কে মদিনা থেকে বিতাড়িত করার পরিকল্পনা করে। এছাড়া কুরাইশদের দীর্ঘ দিনের বাণিজিক পথ বন্ধ হতে পারে ভেবে তারা ইসলামকে ধ্বংস করতে উঠে-পড়ে লাগে। কারণ মক্কার বণিকরা সিরিয়া, মিসর এবং অন্যান্য দেশের সাথে মদিনা হয়ে বাণিজ্য করত। মক্কার কুরাইশরা মদিনায় সীমান্তবর্তী এলাকায় দস্যুবৃত্তি ও লুটতরাজ করত। তারা মুসলমানদের শস্যক্ষেত, ফলবান বৃক্ষ ও গবাদিপশু প্রায়ই লুণ্ঠন করত। তা ছাড়া ইসলামের ঘোর শক্র আবু সুফিয়ানের মিথ্যা প্রচার বদরের যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। আবু সুফিয়ানের মিথ্যা প্রচারণার ফলে আবু জাহেলের নেতৃত্বে ৭০০ উষ্ট্রারোহী, ১০০ অশ্বারোহী ও ২০০ পদাতিক সৈন্যসহ প্রায় ১০০০ সৈন্য নিয়ে মদিনার অভিমুখে যাত্রা করা হয়।
এ সংবাদ শুনে শান্তপ্রিয় নবী সা: চিন্তিত হয়ে পড়লেন এবং কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। তখনই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আল-কুরআনের আয়াত নাজিল করে বলেন, ‘তাদের সাথে যুদ্ধ করো, যারা তোমার সাথে যুদ্ধ করে। তবে সীমা অতিক্রম করো না। কারণ সীমালঙ্ঘনকারীদের আল্লাহ পছন্দ করেন না।’ (সূরা-বাকারাহ : ১৯০)
তারপর রাসূলুল্লাহ (সা.) যুদ্ধসংক্রান্ত মন্ত্রণাসভার পরামর্শক্রমে ৩১৩ জন মতান্তরে ৩২৪ জনের একটি ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে মদিনার প্রায় ৮০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে বদর উপত্যকায় আল-আরিশ পাহাড়ের পাদদেশে শিবির স্থাপন করেন। ফলে মুসলিমদের অনুকূলে পানির কূপগুলো চলে আসে এবং সূর্যকিরণ চোখে পড়ত না। দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজানে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ১৭, ১৯ ও ২১ রমজান এ তিন দিন যুদ্ধের পর কুরাইশ বাহিনী পরাজিত হয়ে পলায়ন করে। এ যুদ্ধে কুরাইশদের নেতা আবু জেহেলসহ ৭০ জন নিহত হয় এবং ৭০ জন বন্দী হয়। পক্ষান্তরে ১৪ জন মুসলিম শাহাদতবরণ করেন।
বদরের যুদ্ধ ছিল মুসলিম ও ইসলামের অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধ। এ যুদ্ধে মুসলিমরা পরাজিত হলে পৃথিবী থেকে চিরতরে ইসলামের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেত। এ যুদ্ধে বিজয় আরবের মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে। ইসলাম ধর্মের প্রতি আরববিশ্ব এমনকি পৃথিবীর মানুষের আকর্ষণ বৃদ্ধি করে।
বদর যুদ্ধের অবস্থা তুলে ধরে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘আল্লাহ তোমাদের বদরে সাহায্য করেছেন। অথচ তোমরা ছিলে ক্ষীণশক্তি।’ (সূরা : আলে ইমরান : ১২৩) মূলত, বদরের যুদ্ধ ছিল সত্যের ওপর মিথ্যার বিজয়। ইসলাম ও মুসলমান সত্যের পথে অবিচল ছিল। তাই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তারা সাহায্য পেয়েছে। সর্বোপরি, বদরের যুদ্ধ মুসলমানদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে, বিশ্বজয়ের পথ মসৃণ করে ও মিথ্যার ওপর সত্যের বিজয়ের মাধ্যমে সর্বোত্তম ইতিহাস রচনা করে।
বদরের যুদ্ধ ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধগুলোর মধ্যে একটি। এটি ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এক যুদ্ধ। এটি ছিল ইসলামের ইতিহাসে প্রথম যুদ্ধ। এর আগে মুসলিমরা শুধু নির্যাতিতই হয়েছে, এই প্রথম তারা রুখে দাঁড়ায়। এই যুদ্ধের পর ইসলামী রাষ্ট্র আরও বেশি সুসংহত হয়েছে।
বদরের যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয়ের পর আরবে ইসলামের আবেদন বৃদ্ধি পায়, এবং ইসলামের প্রচার-প্রসারে গতি আসে। যদি মুসলিমরা এই যুদ্ধে হেরে যেত, তবে ইসলাম হয়তো অস্তিত্বের সংকটে পড়ত। মুসলিমরা হেরে গেলে কুরাইশরা ইসলামের উত্থানকে স্তিমিত করে দিত। এ যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয়ের ফলে আরবে এক নতুন শক্তির উত্থান ঘটে। পরবর্তীতে বিভিন্ন যুদ্ধে জয়ের মাধ্যমে এই শক্তি একসময় পরাশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। বদরের যুদ্ধজয় ছিল মুসলিমদের বিশ্বজয়ের ভিত্তি।
আপনার মতামত লিখুন :