মহান আল্লাহ তা’য়ালা দ্বীন ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে রাসুল (সা.)-কে বেশ কিছু ছোট-বড় যুদ্ধের সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু এসব যুদ্ধ প্রচলিত যুদ্ধ-সংঘর্ষ থেকে আলাদা।
যুদ্ধের অনুমতি সংক্রান্ত আয়াত নাযিল হওয়ার পর কুরাইশ বাহিনীর মুকাবিলার জন্য রাসুলুল্লাহ (স.) মদিনা থেকে মক্কা অভিমুখী রাস্তাগুলিতে নিয়মিত টহল অভিযান প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় বাইরের বিভিন্ন গোত্রের সাথে তাঁর সন্ধি চুক্তিসমূহ খুবই ফলপ্রসূ প্রমাণিত হয়। যার এলাকাসমূহ মদিনা হতে মক্কার দিকে তিন মনযিল অর্থাৎ প্রায় ৫০ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
এইসব অভিযানের যেগুলিতে রাসুলুল্লাহ (স.) স্বয়ং অংশ গ্রহণ করতেন, সেগুলিকে ‘গাজওয়াহ’ (غَزْوَةٌ) এবং যেগুলিতে নিজে না গিয়ে অন্যদের পাঠাতেন, সেগুলিকে সারিইয়াহ (سَرِيَّةٌ) বলা হয়। এইসব অভিযানে যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে বের হলেও বলতে গেলে কোনটাতেই যুদ্ধ হয়নি। তবে মক্কায় খবর হয়ে গিয়েছিল যে, কুরাইশদের হুমকিতে মুহাজিরগণ ভীত নন, বরং তারা সদা প্রস্তুত।
১. সারিইয়া সায়ফুল বাহর (سرية سيف البحر) বা সমুদ্রোপকুলে প্রেরিত বাহিনী:
হিজরী ১ম সনের রামজান মাস (মার্চ ৬২৩ খৃ.)। হযরত হামযাহ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিবের নেতৃত্বে ৩০ সদস্যের এই মুহাজির বাহিনী প্রেরিত হয় সিরিয়া হতে আবু জাহলের নেতৃত্বে প্রত্যাবর্তনকারী ৩০০ সদস্যের কুরাইশ কাফেলার গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য। উভয় বাহিনী মদিনা থেকে ২৫০ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে লোহিত সাগরের তীরবর্তী ‘ঈছ’ (العِيْص) নামক স্থানে মুখোমুখি হয়। কিন্তু জুহায়না গোত্রের নেতা মাজদি বিন আমর, যিনি ছিলেন উভয় দলের মিত্র, তাঁর কারণে যুদ্ধ হয়নি। এ যুদ্ধে পতাকা বাহক ছিলেন আবু মারছাদ আল-গানাভী (রা.)
২. সারিইয়া রাবেগ (سرية رابغ) :
হিজরী ১ম সনের শাওয়াল মাস। ওবায়দাহ ইবনুল হারেছ বিন মুত্ত্বালিব-এর নেতৃত্বে ৬০ জনের এই মুহাজির বাহিনী প্রেরিত হয়। মদিনা থেকে দক্ষিণে এবং জেদ্দা থেকে ১৪০ কি.মি. উত্তরে অবস্থিত ‘রাবেগ’ অঞ্চলটি বর্তমানে মক্কা প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত। এই অভিযানে রাবেগ উপত্যকায় আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে ২০০ জনের এক বাহিনীর মুখোমুখি হলে উভয় পক্ষে কিছু তীর নিক্ষেপ ব্যতীত তেমন কিছু ঘটেনি।
তবে মাক্কী বাহিনী থেকে দু’জন দল ত্যাগ করে মুসলিম বাহিনীতে চলে আসেন। যারা গোপনে মুসলমান ছিলেন। যাদের একজন হলেন মিক্বদাদ বিন আমর এবং অন্যজন হলেন উৎবাহ বিন গাজওয়ান। এই যুদ্ধে হযরত সাদ বিন আবু ওয়াকক্বাছ (রা.) কাফেরদের প্রতি সর্বপ্রথম তীর নিক্ষেপ করেন। সে কারনে তিনি أَوَّلُ الْعَرَبِ رَمَى بِسَهْمٍ فِى سَبِيلِ اللهِ ‘আরবদের মধ্যে আল্লাহর রাস্তায় প্রথম তীর নিক্ষেপকারী’ হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।
এ জন্য রাসুল (স.) তার জন্য দোআ করেছিলেন, اللَّهُمَّ سَدِّدْ سَهْمَهُ وَأَجِبْ دَعْوَتَهُ ‘হে আল্লাহ! তুমি তার তীরকে লক্ষ্যভেদী কর এবং তার দোআ কবুল কর’। এ যুদ্ধের পতাকা বাহক ছিলেন মিসত্বাহ বিন আছাছাহ বিন মুত্ত্বালিব (রা.)।
৩. সারিইয়া খাররার (سرية الخرّار):
হিজরী ১ম সনে জিলকদ মাস। সাদ বিন আবু ওয়াকক্বাছ (রা.)-এর নেতৃত্বে ২০ জনের এই মুহাজির দল প্রেরিত হয় কুরাইশদের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য। তারা জুহফার নিকটবর্তী ‘খাররার’ উপত্যকা পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসেন। কেননা মক্কার কাফেলা এখান থেকে একদিন আগেই চলে গিয়েছিল। এ যুদ্ধের পতাকা বাহক ছিলেন মিক্বদাদ বিন ‘আমর (রা.)।
৪. গাজওয়া ওয়াদ্দান (غزوة ودّان أو الأبواء):
দ্বিতীয় হিজরীর সফর মাস (আগস্ট ৬২৩ খৃঃ)। রাসুলুল্লাহ (স.) সর্বপ্রথম এই অভিযানে নিজেই নেতৃত্ব দেন, যাতে ৭০ জন মুহাজির ছিলেন। মদিনা থেকে ২৫০ কি.মি. দক্ষিণে এই অভিযানে তিনি ১৫ দিন মদিনার বাইরে ছিলেন এবং যাওয়ার সময় খাযরাজ নেতা সা‘দ বিন ওবাদাহ (রা.)-কে মদিনার আমীর নিযুক্ত করে যান। এই অভিযানেরও উদ্দেশ্য ছিল কুরাইশ কাফেলার পথ রোধ করা। কিন্তু বাস্তবে তাদের দেখা মেলেনি। তবে এই সফরে তিনি স্থানীয় বনু যামরাহ (بَنُو ضَمْرَة) গোত্রের সাথে সন্ধিচুক্তি সম্পাদনে সমর্থ হন (ইবনু হিশাম ১/৫৯১)। এ যুদ্ধের পতাকা বাহক ছিলেন হামযা বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব (রা.)।
৫. গাজওয়া বুওয়াত্ব (غزوة بواط):
দ্বিতীয় হিজরীর রবিউল আউয়াল মাস (সেপ্টেম্বর ৬২৩ খৃঃ)। ২০০ ছাহাবিকে নিয়ে আল্লাহর রাসুল (স.) স্বয়ং এ অভিযানে বের হন। মদিনা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে ১০০ কি.মি. দূরে এটি অবস্থিত। উমাইয়া বিন খালাফের নেতৃত্বে ১০০ জনের কুরাইশ কাফেলার গতিরোধ করাই ছিল এ অভিযানের উদ্দেশ্য। কিন্তু কোন সংঘর্ষ হয়নি। এই অভিযানে বের হওয়ার সময় তিনি আউস নেতা সা‘দ বিন মুআয (রা.)-কে মদিনার আমীর নিযুক্ত করে যান। এ যুদ্ধের পতাকা বাহক ছিলেন সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ (রা.)
৬. গাজওয়া সাফওয়ান(غزوة سفوان) :
দ্বিতীয় হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে মক্কার নেতা কুর্জা বিন জাবের আল-ফিহরি মদিনার চারণভূমি থেকে গবাদিপশু লুট করে নিয়ে গেলে ৭০ জন ছাহাবিকে নিয়ে রাসুলুল্লাহ (স.) তার অনুসরণ করেন এবং বদর প্রান্তরের কাছাকাছি সাফওয়ান উপত্যকা পর্যন্ত ধাওয়া করেন। কিন্তু লুটেরাদের ধরতে ব্যর্থ হন। এই অভিযানকে অনেকে গাজওয়া বদরে উলা (غَزْوَةُ بَدْرٍ الْأُولَى) বা বদরের প্রথম যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন। এই সময় মদিনার আমীর ছিলেন যায়েদ বিন হারেছাহ (রা.)।
এটাই ছিল মদিনার উপকণ্ঠে কুরাইশদের প্রথম হামলা। এ যুদ্ধের পতাকা বাহক ছিলেন আলী ইবনু আবু ত্বালিব (রা.)।
৭. গাজওয়া জুল-উশাইরাহ (غزوة ذى العُشيرة):
২য় হিজরীর জুমাদিউল আওয়াল ও আখের মাস মোতাবেক ৬২৩ খৃষ্টাব্দের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাস। ১৫০ বা ২০০ ছাহাবির একটি দল নিয়ে রাসুলুল্লাহ (স.) একটি মূল্যবান রসদবাহী কুরাইশ কাফেলার গতিরোধে বের হন। কিন্তু ইয়াম্বু‘-এর পার্শ্ববর্তী জুল-‘উশায়রা পর্যন্ত গিয়েও তাদের ধরতে ব্যর্থ হন। এ সময় মদিনার আমীর ছিলেন আবু সালামাহ (রা.)। আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে এই কুরাইশ কাফেলাটি বহাল তবিয়তে মক্কায় ফিরে যায় এবং এর ফলেই বদর যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরী হয়। এই অভিযানকালে রাসুলুল্লাহ (স.) বনু মুদলিজ ও তাদের মিত্রদের সাথে সন্ধি চুক্তি সম্পাদন করেন। এ যুদ্ধের পতাকা বাহক ছিলেন হামযা বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব (রা.)।
৮. সারিইয়া নাখলা (سرية نخلة):
দ্বিতীয় হিজরীর রজব মাস (জানুয়ারি ৬২৪ খৃঃ)। আব্দুল্লাহ বিন জাহশের নেতৃত্বে ৮ বা ১২ জন মুহাজির ছাহাবির একটি ক্ষুদ্র দল প্রেরিত হয়। এ যুদ্ধে প্রেরণের সময় রাসুল (স.) তার হাতে একটি পত্র দেন এবং বলেন, দু’দিন পথ চলার আগ পর্যন্ত যেন পত্রটি না খোলা হয়। দু’দিন চলার পর তিনি পত্র খোলেন এবং পাঠ করার পর সবাইকে বলেন, আমাদেরকে তায়েফ ও মক্কার মধ্যবর্তী নাখলায় অবতরণ করতে বলা হয়েছে এবং সেখানে গিয়ে কুরাইশ কাফেলার অপেক্ষায় থাকতে বলা হয়েছে। অতএব যিনি শহিদ হতে চান কেবল তিনিই আমার সাথে যাবেন। অথবা ইচ্ছা করলে ফিরে যাবেন। এ ব্যাপারে আমি কাউকে চাপ দিব না তবে আমি যেতে প্রস্তুত’। তখন সাথী মুহাজিরগণের সবাই তাঁর সঙ্গে থাকলেন, কেউই ফিরে আসলেন না। ওই মুহাজিরগণের মধ্যে ছিলেন আমীর আব্দুল্লাহ বিন জাহশ ছাড়াও সাদ বিন আবু ওয়াকক্বাছ, আবু হুযায়ফা বিন উৎবা বিন রাবীআহ, উক্কাশা বিন মিহছান, উৎবা বিন গাজওয়ান, ওয়াক্বিদ বিন আব্দুল্লাহ, খালেদ বিন বুকাইর ও সোহায়েল বিন বায়যা’ প্রমুখ (ইবনু হিশাম ১/৬০১-০২)।
অতঃপর তাঁরা নাখলা উপত্যকায় পৌঁছে একটি কুরাইশ কাফেলাকে আক্রমণ করেন ও তাদের নেতা আমর ইবনুল হাযরামীকে হত্যা করে দু’জন বন্দীসহ গণিমতের মাল নিয়ে মদিনায় ফিরে আসেন। এটাই ছিল ইসলামের ইতিহাসে প্রথম গণিমত লাভ এবং প্রথম নিহত হওয়ার ঘটনা ও প্রথম দুই ব্যক্তি বন্দী হওয়ার ঘটনা। ঘটনাটি ঘটে রজব মাসের শেষ দিনে। কেননা তারা দেখলেন যদি আমরা যুদ্ধ না করি, তাহলে শত্রু পালিয়ে যাবে। এমতাবস্থায় তারা (বন্দী) যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেন। সে কারণ রাসুলুল্লাহ (স.) বন্দীদের মুক্তি দেন ও নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের রক্তমূল্য দেন। এ সময় মুসলমানেরা হারাম মাসের বিধান লঙ্ঘন করেছে বলে মুশরিকদের রটনার জবাবে সূরা বাক্বারাহ ২১৭ আয়াতটি নাযিল হয়। তাতে বলা হয়,
يَسْأَلُونَكَ عَنِ الشَّهْرِ الْحَرَامِ قِتَالٍ فِيهِ قُلْ قِتَالٌ فِيهِ كَبِيرٌ وَصَدٌّ عَنْ سَبِيلِ اللهِ وَكُفْرٌ بِهِ وَالْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَإِخْرَاجُ أَهْلِهِ مِنْهُ أَكْبَرُ عِنْدَ اللهِ وَالْفِتْنَةُ أَكْبَرُ مِنَ الْقَتْلِ وَلاَ يَزَالُونَ يُقَاتِلُونَكُمْ حَتَّى يَرُدُّوكُمْ عَنْ دِينِكُمْ إِنِ اسْتَطَاعُوا وَمَنْ يَرْتَدِدْ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَيَمُتْ وَهُوَ كَافِرٌ فَأُولَئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ-
‘লোকেরা তোমাকে প্রশ্ন করছে নিষিদ্ধ মাস ও তার মধ্যে যুদ্ধ করা সম্পর্কে। তুমি বল, এ মাসে যুদ্ধ করা মহাপাপ। তবে আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করা ও তাঁর সাথে কুফরি করা এবং মাসজিদুল হারামে প্রবেশে বাধা দেওয়া ও তার অধিবাসীদের বহিষ্কার করা আল্লাহর নিকটে আরও বড় পাপ। আর ফিৎনা (কুফরি) করা যুদ্ধ করার চাইতে বড় পাপ। বস্তুত, যদি তারা সক্ষম হয়, তবে তারা সর্বদা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, যতক্ষণ না তারা তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন থেকে ফিরাতে পারে। আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি স্বধর্ম ত্যাগ করবে, অতঃপর কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে, তাদের দুনিয়া ও আখেরাতের সকল কর্ম নিষ্ফল হবে। তারা জাহান্নামের অধিবাসী হবে এবং সেখানেই চিরকাল থাকবে’ (বাক্বারাহ ২/২১৭)।
অর্থাৎ মুসলমানদের এই কাজের তুলনায় মুশরিকদের অপকর্মসমূহ ছিল বহু গুণ বেশি অপরাধজনক। এই যুদ্ধে নিহতের বদলা নিতেই আবু জাহল বদরে যুদ্ধ করতে এসেছিল। এই অভিযান শেষে শাবান মাসে মুসলমানদের ওপরে জিহাদ ফরজ হয় (বাক্বারাহ ২/১৯০-৯৩; মুহাম্মাদ ৪৭/৪-৭, ২০)।
প্রসঙ্গত, সকল অভিযানে রাসুল (স.) নিজে চারটিতে অংশ নেন, অন্য চারটিতে অন্যদের পাঠায়েছেন। এসব অভিযানে পতাকা থাকতো সাদা রঙয়ের এবং পতাকাবাহী সেনাপতি থাকতেন পৃথক ব্যক্তি।
আপনার মতামত লিখুন :