ঢাকা শনিবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫

কেমন ছিলো হযরত ওমর (রা.)-এর শাসনকাল

তৌফিক সুলতান

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৭, ২০২৫, ০৫:৪৫ পিএম

কেমন ছিলো হযরত ওমর (রা.)-এর শাসনকাল

ফাইল ছবি

ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে ফারুক (সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী) উপাধিতে ভূষিত করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের রূপরেখা দান করেছেন; তা বাস্তবায়নে তিনি অনন্যসাধারণ অবদান রাখেন। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের বহু আইন, বিধান ও প্রতিষ্ঠান তাঁর হাতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহু (৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দ–৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দ) ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা ও প্রধান সাহাবীদের অন্যতম। আবু বকর (রাঃ) মৃত্যুর পর তিনি দ্বিতীয় খলিফা হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। উমর (রাঃ) ইসলামী আইনের একজন অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ ছিলেন। ন্যায়ের পক্ষাবলম্বন করার কারণে তাকে ফারুক (আরবি: الفاروق; সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী) উপাধি দেওয়া হয়। আমিরুল মুমিনীন উপাধিটি সর্বপ্রথম তার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে।

ইতিহাসে তাকে প্রথম উমর হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। নামের মিল থাকার কারণে পরবর্তী কালের উমাইয়া খলীফাহ্ উমর বিন আব্দিল আযীযকে দ্বিতীয় উমর হিসেবে সম্বোধন করা হয়। সাহাবীদের মর্যাদার ক্ষেত্রে আবূ বকর (রাঃ) পর উমরের অবস্থান। এছাড়াও তিনি ছিলেন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) শ্বশুর, যেহেতু উমর (রাঃ) মেয়ে হাফছাহ বিন্‌তে উমর ছিলেন হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এর স্ত্রী।

উমর (রাঃ) শাসনামলে খিলাফাতের সীমানা অকল্পনীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। এসময় সাসানীয় সাম্রাজ্য ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের দুই তৃতীয়াংশ মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে আসে। তার শাসনামলে জেরুজালেম মুসলিমদের হস্তগত হয়। তিনি পূর্বের নাসরানী রীতি বদলে ইয়াহূদীদেরকে জেরুসালেমে বসবাস ও উপাসনা করার সুযোগ দিয়েছিলেন। তার জীবনকর্মে উপর শিবলী নোমানীর রচিত আল ফারুক অন্যতম।

জন্ম ও পরিচয় : তাঁর পুরো নাম আবু হাফস ওমর ইবনুল খাত্তাব বিন নুফাইল বিন আবদুল উজ্জা। মা-বাবা উভয়ের বিবেচনায় তিনি কুরাইশ ছিলেন। ওমর (রা.) মহানবী (সা.)-এর ১৩ বছর পর জন্মগ্রহণ করেন। পবিত্র কাবাঘরের সন্নিকটে অবস্থিত জাবালে ওমরে ছিল তাঁর বাড়ি।

খিলাফতের প্রতিষ্ঠা

উসামা বিন জায়িদ (রাঃ) নিকট প্রেরিত চিঠি

মুহাম্মদ সাঃ এর মৃত্যুর পর খিলাফতের প্রতিষ্ঠায় উমর (রাঃ) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।মুহাম্মদ সাঃ এর দাফনের প্রস্তুতি চলার সময় কিছু মুসলিম শহরের উপকণ্ঠে সাকিফা নামক স্থানে তার উত্তরসূরির বিষয়ে আলোচনায় বসে। এরপর আবু বকর (রাঃ), উমর (রাঃ) এবং আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ এখানে উপস্থিত হন। এসময় আনসারদের মধ্য থেকে দাবি উঠে যে উত্তরসূরি আনসারদের মধ্য থেকে নির্বাচিত করতে হবে। উমর (রাঃ) এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে বলেন যে উত্তরাধিকার মুহাজিরদের মধ্য থেকে হতে হবে। কিছু গোত্র ইসলামপূর্ব গোত্রীয় নেতৃত্ব ব্যবস্থায় ফিরে যেতে ইচ্ছুক ছিল যাতে প্রত্যেক গোত্রের নেতা গোত্রকে নেতৃত্ব দিত। শেষপর্যন্ত আবু বকর (রাঃ) কে খলিফা হিসেবে অধিক যোগ্য বলে দাবি করে তার প্রতি উমর (রাঃ) আনুগত্য প্রকাশ করেন। এই সিদ্ধান্ত শেষপর্যন্ত সবাই মেনে নেয়।

ইসলামি খিলাফত প্রতিষ্ঠায় উমর (রাঃ) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ধরা যায়। পৃথিবীর ইতিহাসেও এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

আরও পড়ুনঃ বদর যুদ্ধ: ইসলামের ইতিহাসে প্রথম ও প্রধান সশস্ত্র যুদ্ধ

আবু বকর (রাঃ) এর যুগ

আবু বকর (রাঃ) এর শাসনামলে উমর (রাঃ) তার একজন প্রধান সচিব ও উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন। রিদ্দার যুদ্ধের সময় প্রথমে তিনি আবু বকর (রাঃ) কিছু মতের সাথে একমত না হলেও পরে তা মেনে নেন এবং তাকে সহায়তা করেন। শেষপর্যন্ত বিদ্রোহীদের দমন করে আরব উপদ্বীপকে একতাবদ্ধ করা হয়।

ইয়ামামার যুদ্ধে অনেক হাফিজ শহিদ হলে উমর (রাঃ) কুরআন গ্রন্থাকারে সংকলনের জন্য আবু বকর (রাঃ) নিকটে আবেদন জানান। আবু বকর (রাঃ) প্রথমে তাতে রাজি না থাকলেও পরে সম্মত হন। এর ফলে কুরআন গ্রন্থাকারে সংকলিত হয়।

আবু বকর (রাঃ) মৃত্যুর পূর্বে উমর (রাঃ) কে তার উত্তরসূরি নিয়োগ দিয়ে যান। উমর (রাঃ) কঠোর প্রকৃতির ছিলেন। তাই অনেকে তাকে পরবর্তী খলিফা হিসেবে সমর্থন করতে চাননি। তবে এরপরও আবু বকর (রাঃ) তাকে নিজের উত্তরসূরি মনোনীত করে যান।

উমর (রাঃ) তার ইচ্ছাশক্তি, বুদ্ধিমত্তা, রাজনৈতিক সচেতনতা, নিরপেক্ষতা, ন্যায়বিচার এবং দরিদ্র ও অসহায়দের প্রতি সদয় আচরণের জন্য পরিচিত ছিলেন।

উল্লেখ করা হয় যে আবু বকর (রাঃ) তার উচ্চ পর্যায়ের উপদেষ্টাদের বলেছিলেন :

আমার কোমলতার জন্য তার (উমর (রাঃ)) কঠোরতা ছিল। যখন খিলাফতের ভার তার কাঁধে আসবে তখন সে আর কঠোর থাকবে না। যদি আল্লাহ আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে কাকে আমি আমার উত্তরসূরি নিয়োগ দিয়েছি, তবে আমি তাকে বলব যে আপনার লোকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়েছি।

উত্তরসূরি হিসেবে উমর (রাঃ) ক্ষমতা ও সক্ষমতা সম্পর্কে আবু বকর (রাঃ) অবগত ছিলেন। উমর (রাঃ) সম্পূর্ণ বিবাদহীনভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন।

আবু বকর (রাঃ) মৃত্যূর পূর্বে উমর (রাঃ) কে ডেকে তার অসিয়ত লিখতে বলেন যাতে তিনি উমর (রাঃ) কে নিজের উত্তরসূরি ঘোষণা করে যান। অসিয়তনামায় উমর (রাঃ) ইরাক ও সিরিয়া জয়ের অভিযান চালু রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়।

আবু বকর (রাঃ) সিদ্ধান্ত ইসলামি খিলাফতকে শক্তিশালী করতে ভূমিকা রেখেছিল।

২২ আগস্ট আবু বকর (রাঃ) মৃত্যুবরণ করেন। একই দিনে উমর (রাঃ) খলিফার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

উমর (রাঃ) নিজের খিলাফতের সময়ে ক্ষমতাপ্রাপ্তি পর সকল মুসলিম তাকে বায়াত প্রদান করেন। তার ব্যক্তিত্বের কারণে জনতা তাকে সমীহ করত। মুহাম্মদ হুসাইন হায়কলের মতে উমর (রাঃ) প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল তার প্রজা ও মজলিশ আল শুরার সদস্যদের মন জয় করা।

উমর (রাঃ) বাগ্মী ব্যক্তি ছিলেন। জনগণের মনে স্থান করে নেয়ার জন্য তার এই দক্ষতা সাহায্য করেছে।

শাসক হিসেবে উমর (রাঃ) দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের কল্যাণের জন্য কাজ করেছেন।ফিদাকের জমির ব্যাপারে তিনি আবু বকর (রাঃ) নীতির অনুসরণ করেছেন এবং একে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহারের নীতি চালু রাখেন।

রিদ্দার যুদ্ধে কয়েক হাজার বিদ্রোহী ও ধর্মত্যাগীকে দাস হিসেবে বন্দী করা হয়েছিল। উমর (রাঃ) এসকল বন্দীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন এবং তাদের মুক্তির নির্দেশ দেন। এই ঘোষণা বেদুইন গোত্রগুলোর কাছে উমর (রাঃ) জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করেছিল।

উমর (রাঃ) সরকার এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থায় পরিচালিত হয়। এতে খলিফা ছিলেন সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ। পুরো ইসলামিক সাম্রাজ্যকে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করা হয়। পাশাপাশি আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া এসব অঞ্চলের কিছু স্বায়ত্তশাসিত এলাকা খিলাফতের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেয়। প্রদেশগুলো প্রাদেশিক গভর্নর বা ওয়ালি কর্তৃক শাসিত হত। উমর (রাঃ) ব্যক্তিগতভাবে ওয়ালিদের নিযুক্ত করতেন। প্রদেশগুলোকে বিভিন্ন জেলায় বিভক্ত করা হত। পুরো ইসলামিক সাম্রাজ্যে প্রায় ১০০ এর মতো জেলা ছিল। প্রতিটি জেলা বা প্রধান শহর একজন অধস্তন জেলা গভর্নর বা ভাইসর আলেমের দায়িত্বে থাকত। ভাইসর আলেমরা সাধারণত উমর (রাঃ) কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হতেন তবে প্রাদেশিক গভর্নররাও তাদের নিয়োগ দিতে পারতেন। প্রাদেশিক স্তরে অন্যান্য অফিসাররা ছিলেন-

যেমন:

কাতিব, প্রধান সচিব

কাতিব উদ দিওয়ান, সামরিক সচিব

সাহিব উল খারাজ, রাজস্ব আদায়কারী

সাহিব উল আহদাস, পুলিশ প্রধান

সাহিব বাইতুল মাল, কোষাগার কর্মকর্তা

সাহিব আল খারাজ,রাজস্ব বিভাগীয় অফিসার

কাজি, প্রধান বিচারক

অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওয়ালি বা ভাইসর প্রদেশের সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি বা উপমহাসেনাধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত থাকলেও কিছু প্রদেশে পৃথক সামরিক অফিসার থাকত। প্রতিটি নিয়োগ লিখিত আকারে দেওয়া হত। নিয়োগের সময় গভর্নরদের জন্য দিকনির্দেশনা প্রদান করা হত। দায়িত্বগ্রহণের পর গভর্নররা জনতাকে প্রধান মসজিদে জড়ো করে তাদের সামনে দিকনির্দেশনা পড়ে শোনাতেন।

কর্মকর্তাদের প্রতি উমর (রাঃ) সাধারণ নির্দেশনা ছিল :

স্মরণ রেখ, আমি তোমাকে জনগণের উপর দিকনির্দেশদাতা ও স্বেচ্ছাচার হিসেবে নিয়োগ দিই নি। আমি তোমাকে একজন নেতা হিসেবে পাঠিয়েছি যাতে জনগণ তোমার উদাহরণ অনুসরণ ও অনুকরণ করতে পারে। মুসলিমদেরকে তাদের অধিকার প্রদান কর যাতে তারা অন্যায়ে পতিত না হয়ে ন্যায় ও সত্যের দিকে পতিত ও ধাবিত হয়। তাদের মুখের উপর নিজেদের দরজা খুলে রাখবে যাতে ক্ষমতাশালীরা দুর্বলদের সাহায্য সহযোগিতা করতে পারে এবং নিজেকে তাদের চেয়ে উচ্চ মনে হয় এমন কোনো আচরণ করা থেকে বিরত থাকবে যাতে তাদের প্রতি স্বৈরাচারী শাসক-শোষকরা করে থাকে।

এ ছাড়াও আরো কিছু বিধিনিষেধ প্রাদেশিক গভর্নর ও রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের উপর জারি করা হয়। প্রধান কর্মকর্তাদেরকে হজ্জের সময় মক্কায় আসতে হত এবং এসময় জনগণ তাদের বিরুদ্ধে যে কোনো অভিযোগ তুলতে পারত। দুর্নীতি রোধ করার জন্য উমর তার কর্মকর্তাদের উচ্চ বেতন-ভাতা দিতেন। নিজ অঞ্চলে সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ প্রধান থাকাবস্থায় গণিমতের সম্পদ ছাড়াও প্রাদেশিক গভর্নররা বার্ষিক পাঁচ থেকে সাতহাজার দিরহাম করে পেতেন।

উমরের অধীনে সাম্রাজ্যকে নিম্নোক্ত প্রদেশে বিভক্ত করা হয় :

আরবকে মক্কা ও মদিনা প্রদেশে বিভক্ত করা হয়;

ইরাককে বসরা ও কুফা প্রদেশে বিভক্ত করা হয়;

টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর উচ্চ অংশে আল-জাজিরা প্রদেশ ছিল।;

সিরিয়া ছিল একটি প্রদেশ;

ফিলিস্তিনকে ইলিয়া ও রামলাহ প্রদেশে বিভক্ত করা হয়;

মিশরকে উচ্চ মিশর ও নিম্ন মিশর প্রদেশে বিভক্ত করা হয়;

পারস্যকে খোরাসান, আজারবাইজান ও ফারস প্রদেশে বিভক্ত করা হয়।

রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের জন্য উমর সর্বপ্রথম বিশেষ বিভাগ গঠন করেন। এই বিভাগ প্রশাসনিক আদালত হিসেবে কাজ করত এবং এর আইনি কর্মকাণ্ড উমর ব্যক্তিগতভাবে তদারক করতেন।এই বিভাগ মুহাম্মদ ইবনে মাসলামার দায়িত্বে দেওয়া হয়। গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগগুলোর ক্ষেত্রে তিনি ঘটনাস্থল, অভিযোগ তদন্ত ও পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে উমরের সহায়তা করতেন। কিছু ক্ষেত্রে অনুসদ্ধান কমিটির সাথে তদন্তের বিষয়ে আলোচনা করা হত। ক্ষেত্রবিশেষে অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে মদিনায় তলব করে আদালতের সম্মুখীন করা হত। উমর তার গোয়েন্দা বিভাগের সহায়তায় কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনেন।

কিছু ক্ষেত্রে উমর পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন :

উমর সর্বপ্রথম পাবলিক মিনিস্ট্রি প্রথা চালু করেন যেখানে সরকারি কর্মকর্তা ও সৈনিকদের রেকর্ড লিপিবদ্ধ করা থাকত। প্রাদেশিক গভর্নর ও রাষ্ট্রপতিদের কাছে পাঠানো চিঠির অনুলিপিও রেকর্ড হিসেবে সুরক্ষিত থাকত।

আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তিনি প্রথম পুলিশ বাহিনী নিয়োগ দেন।

জনতা বিশৃংখল পরিস্থিতির সৃষ্টি করলে তিনি প্রথম তাদের শৃঙ্খলায় আনেন।

খাল খনন

উমরের শাসনামলে বসরা শহর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পানীয় জল ও সেচের জন্য তিনি খাল খননের ব্যবস্থা করেন। আল তাবারির বিবরণ অনুযায়ী শহর পরিকল্পনাধীন অবস্থায় উতবা ইবনে গাজওয়ান প্রথম টাইগ্রিস নদী থেকে বসরা পর্যন্ত খাল খনন করেন। শহর তৈরির পর আবু মুসা আশআরিকে এর প্রথম গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়। আবু মুসা আশআরি বসরা ও টাইগ্রিস নদীকে সংযোগকারী দুইটি গুরুত্বপূর্ণ খাল খনন করান। এগুলো হল আল-উবুলা নদী ও মাকিল নদী। সমগ্র বসরা অঞ্চলে কৃষির উন্নয়ন এবং পানীয় জলের সরবরাহের জন্য এই খালদ্বয় মূল ভূমিকা পালন করেছে। উমর পতিত জমির চাষাবাদের জন্য নীতি গ্রহণ করেন। যারা এসকল জমি আবাদ করত তাদেরকে এসব জমি প্রদান করা হয়। এই নীতি উমাইয়া আমলেও চালু ছিল। ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে খাল খননের ফলে ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে কৃষিক্ষেত গড়ে উঠে

সংস্কার

মূল নিবন্ধসমূহ: উমরের সংস্কার ও উমরের চুক্তি

উমরের শাসনামলে খিলাফতের সীমানা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। তাই বিশাল সাম্রাজ্যকে ধরে রাখার জন্য তিনি রাজনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে শুরু করেন। তিনি বেশ কিছু প্রশাসনিক সংস্কার সাধন করেন। নতুন বিজিত অঞ্চলে তিনি প্রশাসন গঠন করেন যাতে কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও আমলাতন্ত্র ছিল। তার শাসনামলে বসরা ও কুফা শহরদ্বয় নির্মিত ও সম্প্রসারিত হয়। ৬৩৮ সালে তিনি মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববী বর্ধিত ও সংস্কার করেন।

নাজরান ও খায়বারের খ্রিষ্টান ও ইহুদিদেরকে সিরিয়া ও ইরাকে চলে যাওয়ার জন্য তিনি নির্দেশ প্রদান করেছিলেন। তিনি ইহুদিদেরকে জেরুজালেমে পুনরায় বসতি করার সুযোগ দেন। পূর্বে এই সুযোগ ছিল না।

তিনি আদেশ জারি করেন যাতে বলা হয় যে এই খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের সাথে ভালো আচরণ করতে হবে এবং তাদের নতুন বসতিতে সমপরিমাণ জমি প্রদান করা হয়। উমর অমুসলিমদের জন্য হেজাজে তিন দিনের বেশি অবস্থান করায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। উমর সর্বপ্রথম সেনাবাহিনীকে রাষ্ট্রীয় বিভাগ হিসেবে গঠন করেন।

ফিকহের ক্ষেতে উমরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। সুন্নিরা তাকে একজন শ্রেষ্ঠ ফকিহ হিসেবে শ্রদ্ধা করে থাকে।

৬৪১ সালে তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগার হিসেবে বাইতুল মাল গঠন করেন। মুসলিমদেরকে বার্ষিক ভিত্তিতে ভাতা প্রদান করা হত।

নেতা হিসেবে উমর সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তার সমসাময়িক অন্যান্য শাসকদের ব্যতিক্রম হিসেবে তিনি দরিদ্র মুসলিমদের মত জীবনযাপন করতেন। তার শাসনামলে হিজরি বর্ষপঞ্জি প্রণীত হয়।

জেরুজালেম সফর

উমরের জেরুজালেম সফর বেশ কিছু সূত্রে উল্লেখ রয়েছে। সাম্প্রতিককালে আবিষ্কৃত একটি জুডিও-আরবি বিবরণে নিম্নোক্তভাবে উল্লেখ করা হয়েছে :

‘উমর অইহুদি এবং কিছু ইহুদিদেরকে হারাম আল শরিফ এলাকা পরিচ্ছন্ন করার আদেশ দেন। উমর এই কাজ পরিদর্শন করেছেন। আগত ইহুদিরা বাকি ফিলিস্তিনের ইহুদিদের চিঠি লিখে, এবং জানায় যে উমর ইহুদিদের জেরুজালেমে পুনরায় বসবাসের অনুমতি দিয়েছেন। আলোচনার পর উমর সত্তরটি ইহুদি পরিবারকে ফেরার অনুমতি দেন। তারা শহরের দক্ষিণ অংশ অর্থাৎ ইহুদি বাজারে ফিরে আসে (সিলোয়ামের পানি, হারাম আল শরিফ ও এর ফটকের নিকটে থাকা তাদের লক্ষ্য ছিল)। এরপর অধিনায়ক উমর তাদের অনুরোধ মঞ্জুর করেন। টাইবেরিয়াস ও এর আশপাশের অঞ্চল থেকে সত্তরটি পরিবার তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে ফিরে আসে।’

আলেক্সান্দ্রিয়ান বিশপ ইউটিকিয়াসের নামের একটি বিবরণে উল্লেখ আছে যে উমর হারাম আল শরিফে পড়ে থাকা আবর্জনা পরিষ্কার করিয়েছিলেন।

সামরিক সম্প্রসারণ

মূল নিবন্ধ: উমরের যুগের সামরিক বিজয়

মুসলিমদের সিরিয়া জয়ের পর ৬৩৮ সালে উমর খালিদ বিন ওয়ালিদকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেন। ইতিপূর্বে খালিদ সিরিয়ায় মুসলিম বাহিনীর প্রধান ছিলেন। মানুষ খালিদকে বিজয়ের মূল চাবিকাঠি মনে করতে থাকায় উমর তাকে পদচ্যুত করেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে বিজয় আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে এবং কোনো মানুষ তা আনতে পারে না। আরবে দুর্ভিক্ষ এবং লেভান্টে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে ৬৩৮ থেকে ৬৩৯ সালের মধ্যে এক বছর সময় সামরিক অভিযান সাময়িকভাবে মুলতবি ছিল। উমরের শাসনামলে লেভান্ট, মিশর, সিরেনাইকা, ত্রিপলিতানিয়া, ফেজান, পূর্ব আনাতোলিয়া এবং ব্যাক্ট্রিয়া, পারস্য, আজারবাইজান, আর্মেনিয়া, ককেসাস ও মাকরানসহ প্রায় সমগ্র সাসানীয় সাম্রাজ্য খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়। মিশর ও নতুন বিজিত সাসানীয় সাম্রাজ্যে শাসনব্যবস্থা স্থিতিশীল করে তোলার জন্য উমর মৃত্যুর পূর্বে সামরিক অভিযান স্থগিত করেছিলেন। মৃত্যুর সময় তার শাসন পশ্চিমে বর্তমান লিবিয়া থেকে পূর্বে সিন্ধু নদ এবং উত্তরে আমু দরিয়া নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা

৬৩৮ সালে আরবে খরার ফলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ক্ষুধা ও মহামারীর কারণে অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করে। মদিনায় সঞ্চিত খাদ্য শেষ হয়ে যাওয়ার পর উমর সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও ইরাকের প্রাদেশিক গভর্নরদেরকে সাহায্যের জন্য চিঠি লেখেন। গভর্নরদের সময়মত পাঠানো সাহায্য হাজার হাজার মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিল। সিরিয়ার গভর্নর আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ সর্বপ্রথম আবেদনে সাড়া দেন।

পরে আবু উবাইদা ব্যক্তিগতভাবে মদিনা সফর করেন এবং সেখানে দুর্যোগ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠার জন্য উমরকে সহায়তা করেন।

মদিনায় সাহায্য পৌঁছানোর পর উমর ইরাক, ফিলিস্তিন ও সিরিয়ার পথে মরুভূমির বসতির দিকে তার লোকদের পাঠান যাতে সেখানে অবস্থানরতদের সাহায্য পৌঁছানো যায়। ফলে লক্ষাধিক লোক প্রাণে বেঁচে যায়। ৬৩৯ সাল নাগাদ অবস্থার উন্নতি হয়। আরবে বৃষ্টিপাত হওয়ায় দুর্ভিক্ষ শেষ হয়। ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের কাজ উমর ব্যক্তিগতভাবে তদারক করেছিলেন।

প্লেগ মহামারী

আরবে দুর্ভিক্ষ শেষ হওয়ার পর সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের অনেক জায়গায় প্লেগ দেখা দেয়। সিরিয়া সফরের সময় পথিমথ্যে সিরিয়ার গভর্নর আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ সাথে সাক্ষাৎ হয় এবং তিনি উমরকে প্লেগ সম্পর্কে সতর্ক করে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানান। উমর আবু উবাইদাকে তার সাথে আসতে বললে আবু উবাইদা নিজ বাহিনীকে কঠিন অবস্থায় ফেলে মদিনা যাওয়াতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। ৬৩৯ সালে আবু উবাইদা প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এসময় সিরিয়ায় প্রায় ২৫,০০০ মুসলিম প্লেগে মৃত্যুবরণ করে। সে বছরে পরবর্তীতে প্লেগের প্রাদুর্ভাব কমে এলে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পুনর্গঠনের জন্য উমর সিরিয়া সফর করেন।

কল্যাণ রাষ্ট্র

দরিদ্রদের কাছাকাছি থাকার জন্য উমর নিজে সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তার বাড়ি ছিল মাটির তৈরি এবং তিনি প্রতি সন্ধ্যায় জনগণের অবস্থা পরিদর্শনের জন্য রাস্তায় বের হতেন। উমর বাইতুল মাল নামক রাষ্ট্রীয় কোষাগার স্থাপন করেন।

বাইতুল মাল থেকে মুসলিম ও অমুসলিম দরিদ্র, অসহায়, বৃদ্ধ, এতিম, বিধবা ও অক্ষমদেরকে সহায়তা প্রদান করা হত। বাইতুল মাল পরবর্তী উমাইয়া ও আব্বাসীয় খিলাফতের সময়েও প্রচলিত ছিল। এছাড়াও উমর শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করেন। দুর্ভিক্ষ ও প্লেগ মহামারীর জন্য ৬৩৮-৬৩৯ সময়ে সামরিক অভিযান স্থগিত করা হয়েছিল।

মুক্ত বাণিজ্য

ইতিপূর্বে ইহুদি ও স্থানীয় খ্রিষ্টানদের উপর বাইজেন্টাইন-সাসানীয় যুদ্ধের ব্যয়ভার মেটানোর জন্য অধিক হারে করারোপ করা হয়েছিল। মুসলিমদের অভিযানের সময় তারা বাইজেন্টাইন ও পারস্যের বিপক্ষে মুসলিমদের সহায়তা করে। ফলে বিজয় ত্বরান্বিত হয়েছিল। ইসলামী রাষ্ট্রে নতুন এলাকা অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এসব অঞ্চলের জনগোষ্ঠী মুক্ত বাণিজ্যের সুবিধা ভোগ করে। এর ফলে ইসলামী রাষ্ট্রের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে বাণিজ্য সহজতর হয়। বাণিজ্যকে উৎসাহিত করার জন্য ইসলামী বাণিজ্যের পরিবর্তে সম্পদের উপর কর ধার্য করা হয়। মুসলিমরা দরিদ্রদের যাকাত দিতে বাধ্য থাকে। মুহাম্মদ কর্তৃক মদিনা সনদ স্বাক্ষরিত হওয়ার পর থেকে ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা ইসলামি রাষ্ট্রের অধীনে তাদের নিজেদের আইনে চলতে পারত এবং নিজস্ব বিচারকের কাছে বিচার চাইতে পারত। একারণে তারা শুধু নিরাপত্তার জন্য কর প্রদান করত। সাম্রাজ্যের দ্রুত বৃদ্ধিতে সহায়ক হওয়ার জন্য বাইজেন্টাইন ও পারস্যের বিজিত অঞ্চলগুলোতে কর আদায় প্রক্রিয়া পূর্বের মতো রাখা হয়। কর ব্যবস্থার আওতায় লোকেরা পূর্বের বাইজেন্টাইন ও সাসানীয় সময়ের চেয়ে কম হারে কর প্রদান করত।

শৈশবে তিনি উটের রাখাল হিসেবে কাজ করতেন এবং যৌবনে পদার্পণের পর তিনি ব্যবসায় মনোযোগী হন। ব্যবসা করে তিনি বিপুল সম্পত্তির মালিক হন। ইসলাম গ্রহণের আগেও ওমর (রা.)-কে মক্কার অন্যতম অভিজাত ব্যক্তি মনে করা হতো এবং তিনি বিভিন্ন সময় কুরাইশের প্রতিনিধিত্ব করেন।

দৈহিক বৈশিষ্ট্য : ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) ছিলেন সুঠাম দেহের অধিকারী।

তাঁর দৈহিক গঠনই তাঁর শক্তিমত্তা, শারীরিক সামর্থ্য ও প্রখর ব্যক্তিত্বের সাক্ষ্য দিত। ঐতিহাসিকদের বর্ণনা মতে, তিনি ছিলেন দীর্ঘদেহী ও শক্তিমান পুরুষ। মানুষের ভিড়ে দাঁড়ালে তাঁকে সহজেই চিহ্নিত করা যেত। তাঁর সিনা বা বুক ছিল প্রশস্ত এবং দাড়ি ছিল অত্যন্ত ঘন। তিনি দুই হাতে কাজ করতে পারতেন।

তিনি দ্রুত পথ চলতেন এবং ভরাট কণ্ঠে কথা বলতেন।

আল্লাহভীতি : ওমর (রা.) ছিলেন অত্যন্ত সুচরিত্রের অধিকারী। আল্লাহভীতি, সততা ও ন্যায়পরায়ণতা ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তিনি বলতেন, ‘তোমরা হিসাব গ্রহণের আগে নিজেদের হিসাব গ্রহণ কোরো এবং তোমাদের আমল পরিমাপ করার আগে নিজেরা পরিমাপ করে দেখো এবং নিজেকে মহাবিচারের জন্য প্রস্তুত কোরো।’ যদি কোনো কারণে কারো প্রতি তিনি অন্যায় করেছেন, তবে তিনি নিঃসংকোচে তাঁর কাছে অনুতাপ প্রকাশ করতেন।

সাহসিকতা : ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) ছিলেন অত্যন্ত সাহসী ও বীর। তিনি সত্য প্রকাশে কখনো ভয় পাননি। আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) তাঁর সম্পর্কে বলেন, আমার জানা মতে, ওমর ইবনুল খাত্তাব ছাড়া সবাই গোপনে হিজরত তথা মক্কা ত্যাগ করেছে। তিনি যখন হিজরতের ইচ্ছা করেন, তখন তরবারি ও তীর-ধনুক হাতে নেন এবং কাবাঘরে যান। তিনি তাওয়াফ করেন এবং দুই রাকাত নামাজ পড়েন। অতঃপর কুরাইশ নেতাদের কাছে গিয়ে বলেন, যে ব্যক্তি তাঁর মাকে কাঁদাতে চায়, সন্তানকে এতিম ও স্ত্রীকে বিধবা করতে চায় সে যেন আমার সঙ্গে এই উপত্যকার পেছনে সাক্ষাৎ করে।

জ্ঞান ও প্রজ্ঞা : মহানবী (সা.)-এর সান্নিধ্যের বরকতে ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী হন। যুগশ্রেষ্ঠ মনীষীরা তাঁর জ্ঞানের সাক্ষ্য দিয়েছেন। যেমন মুজাহিদ (রহ.) বলেন, কোনো বিষয়ে মানুষের ভেতর মতবিরোধ হলে তারা ওমর (রা.) কি করে সে দিকে লক্ষ রাখত এবং তারা সে অনুযায়ী আমল করত। আল্লামা শালবি (রহ.) বলেন, যে ব্যক্তি বিচারের ক্ষেত্রে সুদৃঢ় মতামত গ্রহণ করে খুশি হতে চায়, সে যেন ওমর (রা.)-এর কথা গ্রহণ করে। আর আল্লামা ইবনুল মুসাইয়িব (রহ.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পর আমি ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-কেই সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী মনে করি।

দানশীলতা : মহান এই সাহাবি ছিলেন অত্যন্ত দানশীল এবং দুনিয়াবিমুখ। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে যুদ্ধের জন্য নিজের সমুদয় সম্পদের অর্ধেক দান করে দেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর বদান্যতার প্রশংসা করেন। খাইবারের যুদ্ধের পর গনিমতের সম্পদ লাভ করলে তা অসহায়, দুস্থ ও নিকটাত্মীয়দের জন্য ওয়াফক করে দেন। তিনি জায়তুনের তেল ও রুটি খেতেন এবং পেটে পাথর বেঁধে রাখতেন।

আদর্শ শাসক : মুসলিম জাহানের খলিফা হিসেবে ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ, দূরদর্শী ও ন্যায়পরায়ণ। নেতৃত্বের গুণাবলির জন্যই আবু বকর সিদ্দিক (রা.) তাঁকে নিজের উত্তরসূরি মনোনীত করেন এবং জনসাধারণও তাঁকে হৃদ্যতার সঙ্গে গ্রহণ করে নেয়। তিনি সমকালীন বিশ্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় সমকালীন বিশ্বের প্রতি লক্ষ রাখতেন। যেমন তিনি রোমান সম্রাটের তুলনায় কম কর নির্ধারণ করেন এবং অক্ষমদের ক্ষমা করার নীতি গ্রহণ করেন। সামরিক জ্ঞানেও ওমর (রা.) ছিলেন অতুলনীয়। তাঁর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও সামরিক প্রজ্ঞার কারণে স্বল্প সময়ে ইসলামী খিলাফতের সীমানা দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর শাসনামলে সমগ্র শাম, মিসর ও পারস্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ইসলামী খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়।

রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ওমর (রা.)-এর প্রবর্তিত কয়েকটি ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠান হলো—

১. প্রশাসনিক বিন্যাস : নতুন নতুন অধিদপ্তর ও বিভাগ খোলার মাধ্যমে তিনি প্রশাসনিক কার্যক্রমগুলোকে বিন্যস্ত করেন। যেমন শিক্ষা বিভাগ, অর্থ বিভাগ, পুলিশ ও নিরাপত্তা বিভাগ, বাজার পরিদর্শক বিভাগ ইত্যাদি।

২. রাষ্ট্রীয় কোষাগার প্রতিষ্ঠা : ইসলামের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) ‘বায়তুল মাল’ বা রাষ্ট্রীয় কোষাগার প্রতিষ্ঠা করেন। যেন রাষ্ট্রীয় সম্পদ সংরক্ষণ করে তা বহুমুখী কল্যাণকর খাতে ব্যবহার করা যায়।

৩. বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা : ওমর (রা.)-এর আগে সাধারণত খলিফা ও তাঁর নিযুক্ত ওয়ালি বা গভর্নর বিচার কার্য সম্পাদন করতেন। কিন্তু তিনি বিচার বিভাগকে পৃথক করেন এবং নির্দিষ্ট শর্তের ভিত্তিতে বিচারক নিয়োগের বিধান করেন।

৪. কৃষিব্যবস্থার উন্নয়ন : ওমর (রা.) কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন এবং ইসলামে খিলাফতের বিভিন্ন স্থানে একাধিক খাল ও নালা খনন করেন।

৫. হিজরি সন প্রবর্তন : তিনি পৃথক ইসলামী বর্ষ হিসেবে হিজরি সন প্রবর্তন করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মদিনায় হিজরতের বছরকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করায় এর নাম হিজরি সন রাখা হয়।

২৬ জিলহজ ২৩ হিজরি তিনি মদিনায় একজন আততায়ীর হাতে শহীদ হন। আল্লাহ ইসলামের এই মহান খলিফার উপর রহমতের বৃষ্টি বর্ষন করুন। আমিন।

সহ-প্রধান শিক্ষক, ভাওয়াল ইসলামিক ক্যাডেট একাডেমি। কাপাসিয়া, গাজীপুর।

আরবি/এইচএম

Link copied!