ক্ষমা মানুষের মহৎ গুণ, যা ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনে শান্তি ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইসলাম ধর্মে ক্ষমার গুরুত্ব বারবার উল্লেখ করা হয়েছে, যা কেবল আত্মশুদ্ধির মাধ্যম নয়, বরং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের অন্যতম উপায়। কোরআন ও হাদিসে ক্ষমার গুরুত্ব, তার ফলাফল এবং তা চর্চার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত পুরস্কারের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
কোরআনের দৃষ্টিতে ক্ষমা :
পরম দয়াময় আল্লাহ তা`আলা কোরআনে ক্ষমার গুরুত্বকে একাধিকবার তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ‘আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন।’ (সুরা আল ইমরান, আয়াত : ১৫৯)
এ আয়াতটি আমাদের শেখায়, ক্ষমা শুধু একটি মহৎ গুণ নয়, বরং এটি মানুষের আত্মিক উন্নয়নে সহায়ক। যারা ক্ষমা করতে পারে, তারা মানবিক গুণাবলির শীর্ষে অবস্থান করে।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, "তোমরা ক্ষমা কর এবং উপেক্ষা কর, যেমন আল্লাহ ক্ষমা করেন।" (সূরা আন-নূর: ২২)
আবার রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, "যে ক্ষমা করে, আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন।"
এই শিক্ষা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ক্ষমার মাধ্যমে আমরা শুধু মানুষের সঙ্গে নয়, বরং আল্লাহর সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করতে পারি।
অন্যত্র পরম করুণাময় আল্লাহ বলেন,
‘তোমরা তোমাদের রবের ক্ষমা ও সেই জান্নাতের দিকে ধাবিত হও যার প্রশস্ততা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর ন্যায়। যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে মুত্তাকীদের জন্য।’ (সুরা আল ইমরান, আয়াত : ১৩৩)
এখানে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, যারা ক্ষমাশীল, তারা জান্নাতের উপযুক্ত। ক্ষমা মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য, যা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য অপরিহার্য।
আল্লাহ আরও বলেন,
‘আর ক্ষমা করে দেয়াই তাকওয়ার নিকটতম।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৩৭)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, ক্ষমা কেবল সামাজিক সম্প্রীতি নয়, তাকওয়া বা খোদাভীতিরও প্রমাণ।
হাদিসে ক্ষমার প্রশংসা :
রাসূলুল্লাহ (সা.) ক্ষমার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি তাঁর জীবনে শত্রুদের প্রতি ক্ষমার চর্চা করেছেন, যা মুসলিমদের জন্য অনুকরণীয়। এক হাদিসে তিনি বলেছেন,
‘ক্ষমাশীল ব্যক্তিকে আল্লাহ মর্যাদায় উন্নীত করেন।’ (মুসলিম শরীফ)
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
‘শক্তিশালী সেই ব্যক্তি নয়, যে কুস্তিতে জয়ী হয়; বরং সেই ব্যক্তি প্রকৃত শক্তিশালী, যে ক্রোধের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
ক্ষমার সামাজিক ও আত্মিক প্রভাব :
ক্ষমার প্রভাব কেবল ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়; এটি সমগ্র সমাজকে শান্তিপূর্ণ করে তোলে।
১. সম্পর্ক উন্নয়ন: ক্ষমার মাধ্যমে শত্রুতার অবসান ঘটে এবং সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
২. মহানুভবতার প্রমাণ: ক্ষমা প্রদর্শন ব্যক্তি চরিত্রের উন্নতির পরিচায়ক।
৩. আত্মিক শান্তি: যারা ক্ষমা করে, তাদের মন শান্ত থাকে এবং তারা আল্লাহর বিশেষ রহমত লাভ করে।
ক্ষমার মহিমা প্রতিষ্ঠায় উদাহরণ :
রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কা বিজয়ের সময় তাঁর প্রতি অত্যাচারকারী কুরাইশদের ক্ষমা করে দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি বলেছিলেন,
‘আজ তোমাদের প্রতি কোনো প্রতিশোধ নেই। তোমরা সবাই মুক্ত।’
এই মহৎ ক্ষমার ফলস্বরূপ, ইসলামের শত্রুরাও তাঁর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছিল।
ক্ষমার চর্চা: কীভাবে শুরু করবেন?
১. আল্লাহর উপর ভরসা: ক্ষমাশীল হতে আল্লাহর সাহায্য চাওয়া জরুরি।
২. নিজেকে নিয়ন্ত্রণ: ক্রোধকে দমন করা এবং উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধারণ করা।
৩. প্রতিশোধের চিন্তা ত্যাগ: প্রতিশোধ থেকে বিরত থাকা ক্ষমার প্রথম ধাপ।
নির্যাস:
ক্ষমা একটি শক্তি, যা মানুষের হৃদয়কে শুচি শুদ্ধ করে এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে। ইসলামের শিক্ষার আলোকে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ, যা ব্যক্তি ও সামষ্টিক জীবনে আল্লাহর নৈকট্য এনে দেয়। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে ক্ষমার যে গুরুত্ব এবং সুফল ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে চর্চার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা উচিত। কারণ, ক্ষমা শুধু একটি মানবিক গুণ নয়; এটি আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের সেতু।
ক্ষমা হলো মানব হৃদয়ের পরম মহিমা, যা অন্তরের কালিমা দূর করে মানুষকে সত্যিকার অর্থে মহান করে তোলে। এটি এমন একটি গুণ, যা বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসার অন্ধকারকে আলোর পথ দেখায় এবং সম্পর্কের জটিলতাকে মমতার সুতোয় বাঁধে। ইসলামের শিক্ষায় ক্ষমাকে শুধু একটি নৈতিক গুণ হিসেবে নয়, বরং আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি করুণার প্রকাশ এবং তাঁর সন্তুষ্টি লাভের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
ক্ষমার ফলে সমাজে ভালোবাসা ও সৌহার্দ্যের বীজ বপন হয়, যা বিভেদকে মুছে দিয়ে শান্তির সুরধ্বনি তোলে। তাই, ক্ষুদ্র বা বড়—প্রতিটি পরিস্থিতিতে ক্ষমার গুণ চর্চা করা শুধু ব্যক্তিগত উন্নতির পথ নয়, এটি মানবতার সেবায় নিবেদিত এক মহৎ অঙ্গীকার। ক্ষমা সেই সেতু, যা আমাদের আত্মার সত্তাকে পরিশুদ্ধ করে এবং আল্লাহর করুণাধারার প্রবাহে সিক্ত করে।
লেখক: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অতিরিক্ত সচিব
আপনার মতামত লিখুন :