ক্ষমতার অপব্যবহার যা ব্যক্তি-সমাজ এবং জাতির জন্য খুবই ক্ষতিকর। ইসলামের দৃষ্টিতে ক্ষমতা আল্লাহ প্রদত্ত একটি আমানত, যা সঠিকভাবে ব্যবহার করা একজন মুসলিমের নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব। ক্ষমতা কেবল ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য নয়, বরং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, মানবিক কল্যাণ এবং সমাজের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য ব্যবহার করা উচিত। ক্ষমতার অপব্যবহার ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। পবিত্র কুরআন এবং হাদিসে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে।
ইসলামে বলা হয়েছে, ক্ষমতা একটি পরীক্ষার মাধ্যম। আল্লাহ কুরআনে বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের আমানত তাদের নিকট পৌঁছে দিতে নির্দেশ দেন, যারা তার যোগ্য” (সূরা আন-নিসা, ৪:৫৮)। এটি পরিষ্কারভাবে নির্দেশ করে যে, ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব যোগ্য ব্যক্তির হাতে ন্যস্ত করা আবশ্যক এবং এটি কোনোভাবেই ব্যক্তিগত লোভ-লালসার হাতিয়ার হতে পারে না। ক্ষমতার অপব্যবহার ন্যায়বিচারের বিপরীত। ইসলাম ন্যায়বিচারকে একটি মৌলিক মূল্যবোধ হিসেবে গণ্য করে। আল্লাহ বলেন, “তোমরা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা কর এবং আল্লাহর জন্য সাক্ষ্য দাও, যদিও তা তোমাদের নিজেদের, পিতা-মাতা অথবা আত্মীয়স্বজনের বিপক্ষে যায়” (সূরা আন-নিসা, ৪:১৩৫)।
ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি যদি অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ন করে, তবে তা একটি বড় পাপ। ইসলাম এ ধরনের কাজকে ‘যুলুম’ বা অন্যায় হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন, “যুলুম বা অন্যায় কেয়ামতের দিন অন্ধকার হয়ে দাঁড়াবে” (সহীহ মুসলিম)। ক্ষমতা অপব্যবহারের ফলে দুর্নীতি, অনাচার এবং শোষণ বৃদ্ধি পায়, যা সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। ইসলামে এই ধরনের শোষণমূলক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, “তোমরা অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ আত্মসাৎ করো না এবং তাদের অধিকার হরণ করো না” (সূরা আল-বাকারাহ, ২:১৮৮)।
ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে বিরত থাকার জন্য ইসলামে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ইসলামে যিনি ক্ষমতায় থাকবেন, তার দায়িত্ব হলো আল্লাহর প্রতি ভয় এবং মানুষের প্রতি দয়া প্রদর্শন করা। আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, “প্রত্যেক শাসকই একজন রাখাল, এবং তার অধীনস্থদের সম্পর্কে সে দায়িত্বশীল” (সহীহ বুখারি, সহীহ মুসলিম)। এটি বোঝায় যে, ক্ষমতা ভোগের বিষয় নয়, বরং এটি দায়িত্ব পালনের একটি পবিত্র মাধ্যম। ক্ষমতার অপব্যবহারকারীরা কেবল মানুষদের কাছেই নয়, বরং আল্লাহর কাছেও জবাবদিহি করতে হবে।
ইসলামে ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা হলো যোগ্যতার ভিত্তিতে নেতৃত্ব নির্বাচন করা। রাসূল (সা.) বলেন, “যখন কোনো যোগ্যতাহীন ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তখন অপেক্ষা কর কেয়ামতের” (সহীহ বুখারি)। এটি স্পষ্ট যে, অযোগ্য ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা গেলে তা অপব্যবহার এবং অরাজকতা সৃষ্টি করবে। ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে মুক্ত থাকার জন্য ইসলামে শাসকদের জীবনে সরলতা এবং নম্রতা বজায় রাখার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। রাসূল (সা.) ছিলেন একজন সর্বোত্তম শাসক, যিনি ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কখনো অহংকার করেননি এবং সর্বদা মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন।
ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হলে ব্যক্তি এবং সমাজের মধ্যে আল্লাহভীতি এবং নৈতিক শিক্ষা প্রচলন করতে হবে। ইসলামে নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। আল্লাহ বলেন, “যে ব্যক্তি নিজেকে পবিত্র রাখে, সে সফল হয়” (সূরা আশ-শামস, ৯:৯)। ক্ষমতা পরিচালনার ক্ষেত্রে আল্লাহর ভয় এবং নৈতিকতা একজন ব্যক্তিকে অপব্যবহার থেকে বিরত রাখতে পারে। ইসলামে ক্ষমতা ব্যবহারের একটি আদর্শ উদাহরণ হলো খলিফা ওমর (রা.), যিনি সর্বদা জনগণের সেবায় আত্মনিয়োগ করতেন এবং নিজের জন্য কোনো বিশেষ সুবিধা গ্রহণ করতেন না।
ক্ষমতার অপব্যবহার কেবল ব্যক্তিগত পাপ নয়, এটি সামাজিক বিশৃঙ্খলা এবং অবিচারের কারণ। ইসলামে এই ধরনের অন্যায় কাজের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে জনগণের অধিকার হরণ করে, তারা দুনিয়া এবং আখিরাতে আল্লাহর শাস্তির মুখোমুখি হবে। আল্লাহ বলেন, “যারা অবিচার করে, তারা যেন মনে না করে যে আমরা তাদের অবকাশ দিচ্ছি তাদের মন্দ কাজ বাড়িয়ে তোলার জন্য; তাদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি” (সূরা আলে ইমরান, ৩:১৭৮)।
ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত বাস্তবসম্মত এবং মানবিক। এটি কেবল শাসকদের জন্য নয়, বরং সমাজের প্রতিটি স্তরের জন্য প্রযোজ্য। ইসলাম প্রতিটি ব্যক্তিকে তার নিজস্ব দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে নির্দেশ দেয়। রাসূল (সা.) বলেছেন, “তোমরা প্রত্যেকে একজন দায়িত্বশীল এবং তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জবাবদিহি করবে” (সহীহ বুখারি, সহীহ মুসলিম)। এই শিক্ষার মাধ্যমে সমাজে একটি ভারসাম্যপূর্ণ এবং ন্যায়বিচারপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব।
ইসলামের দৃষ্টিতে ক্ষমতার অপব্যবহার একটি মহাপাপ এবং এটি ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের জন্য ধ্বংসাত্মক। এই সমস্যার সমাধানে আল্লাহর নির্দেশনা অনুসরণ, নৈতিক শিক্ষা, এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। ইসলামের নির্দেশিত পথে চললে এবং ক্ষমতাকে আল্লাহর প্রদত্ত আমানত হিসেবে বিবেচনা করলে সমাজে ন্যায়বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। ইসলামের এই মূল্যবোধগুলো বাস্তবায়ন করা প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব, যা একটি ন্যায়পরায়ণ এবং সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে সহায়ক হবে।
ইমরান হাসান
তরুন লেখক
শিক্ষার্থী, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়
আপনার মতামত লিখুন :