ইসলাম আগমনের আগে জাহিলিয়াত বা অন্ধকার যুগে নারীরা ছিল চরম অবহেলিত ও ঘৃণিত। তখন তাদের বেঁচে থাকার অধিকারটুকু পর্যন্ত হরণ করা হতো। কন্যাসন্তানকে জীবিত মাটিতে পুঁতে ফেলার নির্মম ঘটনাও ঘটেছিল সে সময়। ইসলাম এসে এই বর্বরতা রুখে দিয়েছে।
শুধু তাই নয়, ইসলামপূর্ব জাহিলি যুগে মানুষ এতটাই নিচে নেমে গিয়েছিল যে তারা তাদের নারীদের দিয়ে দেহ ব্যবসা করাত। তাদের উত্তরাধিকার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করত। এমনকি নিজের উপার্জিত সম্পদে তাদের মালিকানা ছিল না, উপার্জন করে আনলেও স্বামীরা লুট করে নিত। মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনের মাধ্যমে আয়াত নাজিল করে তাদের সম্পদের অধিকারও নিশ্চিত করেছেন।
ইসলাম নারীদের অধিকারকে এতটাই গুরুত্ব দেয় যে ইসলামের ইতিহাসে রাসুল (স.) এর জীবদ্দশায় নারীর সম্ভ্রম রক্ষায় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার ইতিহাস পাওয়া যায়। যে যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল ‘বনু কাইনুকা’ নামের একটি গোত্রের সঙ্গে।
বনু কাইনুকা ছিল ইহুদিদের তিনটি গোত্রের মধ্যে সর্বাধিক হিংসুটে একটি গোত্র। তারা সবাই মদিনায় অবস্থান করত এবং তাদের মহল্লাটি তাদের নামেই কথিত ছিল। পেশার দিকে থেকে তারা ছিল স্বর্ণকার, কর্মকার ও পাত্র নির্মাতা।
তারা তাদের দুর্বৃত্তপনা, ঘৃণ্য কার্যকালাপ এবং উস্কানিমূলক কর্মতৎপরতা অব্যাহত রাখে। মুসলমানরা বাজারে গেলে তারা তাদের প্রতি উপহাসমূলক মন্তব্য করতো এবং ঠাট্টা-বিদ্রূপ চালাতো সবসময়। এমনি করে মুসলমানদের মানসিকভাবে কষ্ট দিতো। তাদের ঔদ্ধত্য এমন সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো যে, তারা মুসলিম মহিলাদেরও উত্যক্ত করতো।
এ সময় রসুল (স.) ইহুদিদের সমবেত করে একদিন ওয়াজ-নসিহত করে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। এছাড়া তাদের নিপীড়নমূলক কাজের মন্দ পরিণাম সম্পর্কেও সতর্ক করে দিলেন। কিন্তু এতে তাদের হীন ও ঘৃণ্য কার্যকলাপ বেড়ে গেলো।
এরপর একজন আবর মুসলিম মহিলা কাইনুকার বাজারে দুধ বিক্রি করতে আসে। দুধ বিক্রির পর সেই মহিলা নিজের প্রয়োজনে এক ইহুদি স্বর্ণকারের দোকানে বসে। ইহুদি তাঁর চেহারা অনাবৃত করতে বলে কিন্তু মহিলা রাজি হননি। এতে স্বর্ণকার সেই মহিলার কাপড়ের একাংশ গোপনে দরজার সাথে বেঁধে দেয়। মহিলা কিছুই বুঝতে পারেননি। মহিলা উঠে দাঁড়ানোর সাথে সাথে কাপড় খুলে গেলো ও তিনি অনাবৃত হয়ে গেলো। এত ইহুদিরা খিল খিল করে হেসে উঠলো। মুসলিম মহিলাকে তারা অপমান ও অপদস্ত করতে থাকলো।
এভাবে অপমানিত হয়ে তিনি কান্না শুরু করলেন। তার কান্না শুনে একজন মুসলমান কারণ জানতে চাইলেন। সব শুনে ক্রোধে অস্থির হয়ে তিনি সেই ইহুদির ওপর হামলা করে তাকে মেরে ফেললেন। ইহুদিরা যখন দেখলো যে, তাদের একজন লোককে মেরে ফেলা হয়েছে এবং মেরেছে তাদের শত্রু মুসলমান। তখন তারা সম্মিলিত হামলা করে সেই মুসলমানকেও মেরে ফেললো। মেরে ফেলেই তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে নিল।
এই ঘটনার সমাধান করার জন্য রাসুল (সা.) হামজা (রা.)-কে সাথে নিয়ে বনু কাইনুকা পোত্রে এলেন। ইহুদিরা রাসুল (সা.)-কে দেখে দুর্গের প্রধান ফটক বন্ধ করে দিলো। রাসুল (সা.) সাহাবাদের ডেকে তাদের দুর্গ অবরোধ করলেন। একটানা ১৫ দিন অবরুদ্ধ থেকে তার ভীত হয়ে পড়লো। তারা ভেবেছিল অন্য ইহুদি গোত্রদ্বয় এবং আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই তাদের সাথে মিলে মুসলিমদের সাথে যুদ্ধ করবে। কিন্তু তাদের সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসে নি দেখে তারা আত্মসমর্পন করলো।
এসময় আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই মুহাম্মদ (সা.) এর কাছে তাদের শাস্তি মওকুফের আবেদন জানালো। প্রসঙ্গত, এই ঘটনার মাসখানেক আগে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইসলাম গ্রহণ করেছিল।
অবশেষে রাসুল সা. সিদ্ধান্ত দিলেন বনু কাইনুকার লোকেরা আরবে থাকতে পারবে না। সাথে করে যা নেওয়া যায় এমন সম্পদ নিয়ে বনু কাইনুকা সিরিয়ার চলে গেল। মুহাম্মদ (সা.) ইহুদিদের পরিত্যাক্ত ধন-সম্পদ ও অস্ত্রশস্ত্র বাজেয়াপ্ত করলেন।
আরেকটি বর্ণনায়- এ ঘটনার পর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল (তিনি এর আগে তাদের অনেক অপরাধ ক্ষমা করেছিলেন)। তিনি মদিনার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব আবু লুবাবাহ ইবনে আবদুল মুনজির (রা.) এর ওপর অর্পণ করে স্বয়ং হামজাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব (রা.) এর হাতে মুসলিমদের পতাকা প্রদান করে আল্লাহর সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে বনু কাইনুকা গোত্রের দিকে ধাবিত হন। ইহুদিরা তাঁদের দেখামাত্র দুর্গের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে দুর্গের দ্বারগুলো ভালোভাবে বন্ধ করে দেয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) কঠিনভাবে তাদের দুর্গ অবরোধ করেন।
এই দিনটি ছিল শুক্রবার, হিজরি দ্বিতীয় সনের শাওয়াল মাসের ১৫ তারিখ। ১৫ দিন পর্যন্ত অর্থাৎ জুলকাদার নতুন চাঁদ উদয় হওয়া অবধি অবরোধ অব্যাহত থাকে। অবশেষে বনু কাইনুকা গোত্র আত্মসমর্পণ করল এবং বলল যে রাসুল (সা.) তাদের জান-মাল, সন্তান-সন্ততি এবং নারীদের ব্যাপারে যা ফায়সালা করবেন তারা তা মেনে নেবে। তারপর রাসুলুল্লাহ (সা.) এর নির্দেশক্রমে তাদের সবাইকে বন্দি করে নেওয়া হয়। (ইবনে হিশাম : ২/৪৭, আর রাহিকুল মাখতুম
: ২৪০-২৪২)
আপনার মতামত লিখুন :