মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ নবী এবং রাসূল। তাঁর নবুয়তের সত্যতার সবচেয়ে বড় প্রমান তাঁর প্রতি নাযিলকৃত মহাগ্রন্থ আল কুরআন। এটি তাঁর শ্রেষ্ঠতম মুজিজা (কারামত)। এর বাইরে অসংখ্য ছোট বড় মুজিজা আল্লাহ তাআ`লা তাঁর দ্বারা প্রকাশ করিয়েছেন। তেমনি তিনটি ঘটনা আলোকপাত করার প্রয়াস পাব বক্ষমান নিবন্ধে।
প্রথম ঘটনা
প্রিয় নবীজীর (স.) চাচা আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব ছিলেন বেশ ধনী মানুষ। ইসলামের ইতিহাসে মক্কাবাসী অবিশ্বাসীদের সাথে সংঘটিত সর্বপ্রথম সম্মুখ সমর বিখ্যাত বদর যুদ্ধে তিনি মক্কার মুশরিক কুরাঈশ সৈন্যদলের সাথে ছিলেন। মক্কা থেকে রওনা হবার আগে গভীর রাতে খুব গোপনে বেশ কিছু সম্পদ স্ত্রীর কাছে লুকিয়ে রেখে যান এবং কিছু সম্পদ তিনি সাথে নিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মক্কা থেকে তিনি যখন বদর অভিমুখে যদ্ধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন, তখন কুরাঈশ সৈন্যদের জন্য ব্যয় করার লক্ষ্যে ২০ উকিয়া স্বর্ণমুদ্রা সাথে নিয়ে যাত্রা করেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে সেগুলো কুরাইশ বাহিনীর জন্য ব্যয় করার পূর্বেই তিনি মুসলমানদের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে যান। বলা বাহুল্য, এ যুদ্ধে পরাজিত মক্কার কুরাঈশদের অনেকেই মুসলিমদের হাতে বন্দী হয়েছিল। পরবর্তীতে এসব যুদ্ধবন্দীদের মুক্তিপণ নিয়ে মুক্ত করে দেয়া হয়েছিল।
মুক্তিপণ গ্রহন করে ছেড়ে দেয়া হচ্ছিল মক্কার অবিশ্বাসী বন্দিদেরকে। একসময় আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব মুক্তিপণ দেয়ার পালা এলো। তাকে রাসূলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকটে আনা হলো। রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তিনি বললেন, ‘আমি তো মুসলিম ছিলাম!’
রাসুল (স.)বললেন, ‘আপনার ইসলাম সম্পর্কে আল্লাহ তাআ`লাই ভালো জানেন। যদি আপনার কথা সত্য হয় তবে আল্লাহ তাআ`লা আপনাকে এর প্রতিফল দেবেন। আমরা তো শুধু প্রকাশ্য কর্মকাণ্ড দেখে তার উপরে নির্ভর করেই হুকুম দেব। সুতরাং, আপনি আপনার নিজের এবং দুই ভাতিজা আকিল ইবন আবি তালিব ও নওফেল ইবন হারিসের মুক্তিপণও পরিশোধ করবেন।’
আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব আবেদন করলেন, ‘আমার এতো টাকা কোথায়? মানে, এতো টাকা কোত্থেকে আসবে?’
রাসুল (স.) বললেনঃ ‘কেন, আপনার নিকট কি সে সম্পদগুলো নেই, যা আপনি মক্কা থেকে রওনা হওয়ার সময়ে আপনার স্ত্রী উম্মুল ফযলের নিকট রেখে এসেছেন এবং বলেছিলেন, আমি যদি এ যুদ্ধে মারা যাই, তাহলে এ মাল ফযল আবদুল্লাহ ও কুছামের সন্তানরদেরকে দিও?’
আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব বললেন ‘আপনি সে কথা কেমন করে জানলেন?! আমি তো রাতের অন্ধকারে একান্ত গোপনে সেগুলো আমার স্ত্রীর কাছে দিয়েছিলাম এবং এ ব্যাপারে তৃতীয় কোন লোক তো জানতো না!’
রাসুলে (স.) বললেনঃ ‘সে ব্যাপারে আমার রব আমাকে বিস্তারিত অবহিত করেছেন।’
আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব বললেন, ‘আল্লাহর কসম, আমি নিশ্চিত হয়েছি যে, আপনি আল্লাহর রাসুল! কেননা, এই লুকানো সম্পদের কথা আমি আর আমার স্ত্রী উম্মুল ফযল ছাড়া আর কেউই জানতো না।’
তিনি সাথে সাথে পাঠ করে নিলেন কালিমা শাহাদাহ এবং মুহূর্তকাল দেরি না করে আশ্রয় নিলেন ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে। সে দিন হতে তিনি হয়ে গেলেন একনিষ্ঠ একজন মুসলিম। সাহাবায়ে কেরামের আলোকিত পথের সহযাত্রী হওয়ার সৌভাগ্যলাভে সমুন্নত হল তাঁর মর্যাদা। নামের সাথে যুক্ত হয়ে থেকে গেল `রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু`র মর্যাদাবান খেতাব। তিনি হয়ে গেলেন আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা ‘আনহু।
দ্বিতীয় ঘটনাঃ
খাইবারের দুর্গ বিজয়ের পরের ঘটনা। এক ইহুদি মহিলা বকরীর মাংসে বিষ মিশিয়ে রাসুলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হত্যা করার চেষ্টা করল। এ ঘটনায় মারাও গিয়েছিলেন একজন সাহাবী।
সেই সাহাবী মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ পরের ঘটনা। রাসুলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন ‘এখানে যতজন ইহুদি আছে আমার কাছে তাদের সকলকে একত্রিত কর।’ তাদের সকলকে একত্রিত করে তাঁর রাসুল (স.) আনয়ন করা হল।
রাসুল (স.) তাদের উদ্দেশ্যে বললেন ‘আমি তোমাদের কাছে একটা ব্যাপারে জানতে চাই, তোমরা কি সে বিষয়ে আমাকে সত্য কথা বলবে?’ তারা বলল ‘হ্যাঁ, হে আবুল কাসিম।’ (আবুল কাসিম হচ্ছে, রাসুলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপনাম)।
রাসুল (স.)বললেনঃ ‘তোমাদের পিতা কে?’ তারা বলল ‘আমাদের পিতা অমুক...` রাসুল (স.) বললেন `তোমরা মিথ্যে বলেছ; বরং, তোমাদের পিতা অমুক।` (তিনি তাদের সত্যিকার বাবার নাম বলে দিলেন)। তারা বলল ‘আপনি সত্য বলেছেন ও সঠিক বলেছেন।’ এরপর তিনি বললেন ‘আমি যদি তোমাদের নিকট আরেকটি প্রশ্ন করি, তাহলে কি তোমরা সেক্ষেত্রে আমাকে সত্য কথা বলবে?’
তারা বলল ‘হ্যাঁ, হে আবুল কাসিম যদি আমরা মিথ্যে বলি, তবে তো আপনি আমাদের মিথ্যা জেনে ফেলবেন, যেমনিভাবে জেনেছেন আমাদের পিতার ব্যাপারে।’
যারা খাবারে বিষ মিশিয়ে তাঁকে মেরে ফেলতে চাইলো, তাদের কাছে এভাবে তিনি নিজ নবুয়তের সত্যতার একটা চিহ্ন দেখিয়ে গেলেন। সঠিকভাবে তাদের বাবার নাম বলে দিয়ে আসলেন। তারাও দ্বিধাহীনভাবে স্বীকার করে নিল যে, তারা মিথ্যা বলার পরেও রাসুলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সঠিকভাবে তাদের বাবার নাম বলে দিয়েছেন এবং তারা এরপর পুনরায় মিথ্যা বললে সেটাও যে রাসুল (স.) ধরে ফেলবেন বলে তারা মিথ্যা বলার সাহস পেল না।
তৃতীয় ঘটনা
মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে সংঘটিত একটি ঘটনা। মক্কা বিজয় করে মুসলিমগণ মক্কা নগরে প্রবেশ করার পর যখন রাতের আগমন ঘটল, তখন রাতভর তাঁরা তাকবির ধ্বনি ও কালিমার আওয়াজে চারদিক মুখরিত করে রাখলেন। এমনকি, এভাবেই সকাল হয়ে গেল।
তখন আবু সুফিয়ান স্ত্রী হিন্দকে ডেকে বললেন- ‘দেখ না, এসবই আল্লাহর পক্ষ থেকে হচ্ছে।’ হিন্দা বললো, ‘হ্যাঁ- এ আল্লাহর পক্ষ থেকেই।’
কুরাঈশদের নেতা আবু সুফিয়ান ও তার স্ত্রী হিন্দা সবসময়েই ইসলামের বিরোধিতা করে আসতেন। রাসুল (স.) এর সাথে শত্রুতা পোষণ করে তারা এতদিন অনেক কিছুই করে এসেছেন।
এরপর আবু সুফিয়ান খুব সকালে উঠে রাসুলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট গিয়ে উপস্থিত হলেন। তাকে দেখে রাসুল (স.) বললেন ‘তুমি হিন্দাকে বলেছিলে, দেখ না- এসব আল্লাহর পক্ষ থেকে হচ্ছে। আর হিন্দা বলেছিল, হ্যাঁ- এ আল্লাহর পক্ষ থেকে।’
তখন আবু সুফিয়ান বললো, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। সেই আল্লাহর কসম, যার নামে কসম খাওয়া হয়- আমার এ কথা হিন্দা ব্যতিত অন্য কোন ব্যক্তি শোনেনি!’
আপনার মতামত লিখুন :