আলোচিত ঢাকা মহানগর নাট্যোৎসব স্থগিত হওয়ায় হতাশ নাট্যকর্মীরা। বহুল প্রত্যাশিত এই উৎসব কি কারণে বন্ধ হলো তার সঠিক কারণ জানতে চাচ্ছেন সংস্কৃতিকর্মীরা। বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে থেকে এই বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দাবি করেছেন অনেকেই। যদিও ইতোমধ্যে বাংলাদেশ মহিলা সমিতির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বরাতে এই উৎসব বন্ধের কারণ হিসেবে আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল যে রমনা থানা থেকে ফোনে নাট্যোৎসব বন্ধ করতে বলা হয়েছে। সেই কারণে পরে সেটি স্থগিত করা হয়। রাজধানীর মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে এই উৎসব হওয়ার কথা ছিল।
তবে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী জানিয়েছেন, উৎসব বন্ধের জন্য নাট্যকর্মীদের একটা অংশই ভূমিকা রেখেছে। এখানে পুলিশ বা সরকার পক্ষের কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেউ জড়িত নন।
রোববার (১৬ফেব্রুয়ারি) সকালে ফেসবুক এক দীর্ঘ স্ট্যাটাসে উৎসব বন্ধ হওয়ার আসল কারণ বিস্তারিত তুলে ধরেছেন তিনি।
সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী লিখেছেন, ‘নাট্যোৎসব বন্ধের খবরটা দেখে আমরা কাল সন্ধ্যা থেকেই খোঁজ খবর নেয়া শুরু করি। কারণ সরকার শিল্পকলার মাধ্যমে সারাদেশে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছড়িয়ে দিতে উৎসাহ দিচ্ছে, গতকালও শিল্পকলায় তিনটা প্রদর্শনী হলো। আজকেও প্রাচ্যনাটের শো আছে শিল্পকলায়। তাহলে এখানে কেনো পুলিশ উৎসব বন্ধ করতে বলবে?
[33716]
তিনি লেখেন, খোঁজ নিয়ে জানলাম, পুলিশ এইরকম কিছুই বলেনি। কালকে রাতেই বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে তারা কাউকে উৎসব বন্ধ করতে বলেনি। বরং তারা নিরাপত্তা দিতে প্রস্তুত। তাহলে? আসল ঘটনা জানিয়ে ফারুকী বলেন, ‘আমাদের দ্রুত অনুসন্ধান থেকে জানা গেলো, নাট্যকর্মীদের মধ্যেই একটা অংশ এই উৎসবের বিরোধিতা করে মহিলা সমিতি কর্তৃপক্ষের কাছে হল বরাদ্দ বাতিলের জন্য জোর দাবি জানিয়ে আসছে বেশ কিছুদিন ধরে।
বিক্ষুব্ধ নাট্যকর্মীদের দাবি, এই উৎসবের আড়ালে জুলাই আন্দোলনের সময় ছাত্র-জনতা হত্যায় বিবৃতি দিয়ে উস্কানি দেয়া কিছু ব্যক্তি বা তাদের গোত্রীয় কিছু মানুষ সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। তারা দাবি জানায় জুলাইয়ে তাদের ভুমিকার জন্য বিচারের মুখোমুখি হওয়ার আগে কোনো পূনর্বাসন চলবে না। অবশেষে কালকে মহিলা সমিতি বরাদ্দ বাতিল করে। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, বিবৃতিতে তারা এইসব কিছু না বলে কৌশলে প্রথমে পুলিশের কাঁধে দোষ চাপানোর চেষ্টা করলো এবং বিবৃতির শেষে বললো- মবের কারণে উৎসব বাতিল করতে হলো। তারা তো জানেই কারা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে। তাদের পরিচয় না লিখে মব বলে চালিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্য কি একটা বিশেষ ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করা? বা কেন ঐ বিক্ষুব্ধ নাট্যকর্মীরা প্রতিবাদ করছে তারা জানে। কিন্তু সেটাও তারা বিবৃতিতে উল্লেখ না করা কি ঐ বিশেষ ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা কিনা সেটা সবাই ভেবে দেখতে পারেন। পাশাপাশি আরেকটা প্রশ্নও আসে, জুলাইয়ে তাদের ভুমিকার জন্য জাতির কাছে এখনো কি একবারও ক্ষমার চাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেছে তারা?’
[22955]
প্রসঙ্গত, ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে ঢাকা মহানগর নাট্যোৎসব শুরুর কথা ছিল। কিন্তু এতিন দুপুরে বাংলাদেশ মহিলা সমিতির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, রমনা থানা থেকে ফোনে নাট্যোৎসব বন্ধ করতে বলা হয়েছে। এ ঘটনা নিয়ে নিজেদের অবস্থান বর্ণনা করেন ঢাকা মহানগর নাট্য পর্ষদের আহ্বায়ক ঠান্ডু রায়হান।
মহানগর নাট্য পর্ষদ থেকে জানানো হয়, ‘বাংলাদেশের থিয়েটার আজ এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। কথা ছিল, শত দর্শক ও নাট্যকর্মী আজ যৌথভাবে ১৪ দিনব্যাপী ঢাকা মহানগর নাট্যোৎসব ২০২৫ উদ্বোধন করবেন। এ উপলক্ষে গত দুই মাস ঢাকার ৮৫টি নাট্যদলের কর্মীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে, গণ–অর্থায়নে যখন উৎসবের সব আয়োজন সম্পন্ন করেছেন, ঠিক তখন আমাদের জানানো হলো, উৎসব বন্ধ করতে হবে।
গতকাল বেলা ১টায় বাংলাদেশ মহিলা সমিতির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমাদের জানান, যে রমনা থানা থেকে ফোনে নাট্যোৎসব বন্ধ করতে বলা হয়েছে। আমরা উৎসব কমিটির পক্ষ থেকে রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করি। সন্ধ্যায় আমরা ওসি সাহেবের সঙ্গে। উৎসবের বিস্তারিত তথ্য তাকে অবহিত করি; যদিও এ ধরনের আয়োজনের জন্য পুলিশ বা সরকারের কোনো অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। আলোচনার পর ওসি সাহেব আমাদের আশ্বস্ত করেন এবং আমরা নিরাপত্তা সহযোগিতা চেয়ে একটি আবেদনপত্র জমা দিয়ে চলে আসি।
ঢাকা মহানগর নাট্য পর্ষদের পক্ষ থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, ‘থানায় নিরাপত্তা সহযোগিতা চেয়ে আবেদনপত্র জমা দিয়ে আসার কিছুক্ষণ পর একটি মব থানার মধ্যে ঢুকে একরকম হুমকির স্বরে গালাগালসহ মহিলা সমিতির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে উৎসব বন্ধ করার জন্য চাপ দেয়। এমন পরিস্থিতিতে মহিলা সমিতির কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানের সার্বিক নিরাপত্তার কথা ভেবে রাতেই মৌখিকভাবে আমাদের হল বরাদ্দ বাতিল করে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ১৪ ফেব্রুয়ারি রাতে কে বা কারা অন্ধকারে মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহীম মিলনায়তন থেকে উৎসবের সাজসজ্জা খুলে নিয়ে যায়। এরপরও নাটকের স্বার্থে আমরা ওসির সাথে আলোচনা করি। এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে সবার নিরাপত্তার কথা ভেবে আমাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে ও ভালোবাসায় আয়োজন করা প্রাণের নাট্যোৎসব আপাতত স্থগিত ঘোষণা করতে বাধ্য হচ্ছি।
[34029]
নাট্যকর্মী ও নাট্যপ্রেমীদের উদ্দেশে লেখা হয়েছে,নাট্যশিল্পী আমাদের পরিচয় হলেও আমরা রাজনৈতিক সচেতন মানুষ। কিন্তু আমরা যখন থিয়েটারে আসি, তখন আমাদের পরিচয়, আমরা শিল্পী। দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে নাটকের মাধ্যমে আমরা মানুষের কথা বলি। আজকের এই অনাকঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি। আমরা আশাবাদী, ঈদের ছুটির পর আবারও আমরা আসব নাটক নিয়ে আপনাদের সামনে। আপনারা আমাদের সাথে ছিলেন, আছেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন। কারণ, দর্শকেরাই আমাদের স্বজন, দর্শকেরাই আমাদের প্রেরণা। ভালো থাকবেন। দেখা হবে থিয়েটারে। এ প্রসঙ্গে পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার মো. মাসুদ রানা গণমাধ্যমকে বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।