বাংলাদেশে নতুন একটি রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ হয়েছে। নতুন রাজনৈতিক দল হওয়া বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। অনেক ছাত্রসংগঠনও হয়েছে। কিন্তু রাজনীতিতে সেগুলো ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পেরেছে বলে মনে হয়নি। কিন্তু নতুন এই রাজনৈতিক দল নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।
বিশেষ করে গণমাধ্যমগুলো বুঝে হোক, না বুঝে হোক বা তাদের তুষ্ট করার জন্য হোক কিংবা যৌক্তিক কারণে হোক, এই দলকে যথেষ্ট পারিমাণ কাভারেজ দিচ্ছে।
যদিও এটাকে কেউ কেউ কিংস পার্টি বলছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পরে ওই আন্দোলনের পুরোভাগে যে ছাত্রনেতারা ছিলেন, তাদের কয়েকজন সরকারের উপদেষ্টা হয়েছেন। তাদের সঙ্গে যারা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন, তারা সবাই মিলে এই রাজনৈতিক দল গঠন করছেন।
প্রত্যাশা করা হচ্ছে, দলটি শক্ত অবস্থান তৈরি করবে এবং দলটি গ্রহণযোগ্য কর্মসূচির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাবার চেষ্টা করবে। যদিও মতবিরোধ রয়েছে, তার পরও নতুন এই দল এসব চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিশেষ করে এই প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে একটি বড় রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতির কারণে এই শূন্যতা পূরণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
ঐতিহাসিক পটভূমি কী? রাজনৈতিক দল গঠনের ধারাবাহিকতার দিকে যদি আমরা তাকাই, বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিটি বড় পরিবর্তনের পর নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ইতিহাস রয়েছে। ব্রিটিশ আমলে কংগ্রেসের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছিল।
দেশভাগের পরপরই আওয়ামী মুসলিম লীগ, পরে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার পরেও নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে। আবার কিছু দল গুরুত্ব হারিয়ে বিলুপ্ত হয়েছে। বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ সেই ধারাবাহিকতারই অংশ।
তবে প্রশ্ন উঠছে, এই দল কি সত্যিই নতুন রাজনীতি আনবে, নাকি পুরোনা ধাঁচের রাজনৈতিক চর্চাতেই ফিরে যাবে। এই দল কি আসলেই ভিন্ন একটি রাজনৈতিক দল, নাকি অন্য কোনো দলের বি টিম বা সি টিম হিসেবে কাজ করবে? নতুন এই রাজনৈতিক দল নিয়ে যে বিতর্ক, সেটা হচ্ছে এরই মধ্যে তাদের গায়ে কিংস পার্টির তকমা লেগেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তারা কি সত্যিই স্বতন্ত্র নাকি বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত একটি দল, যা ক্ষমতাসীনদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সুবিধা পাচ্ছে। এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। কারণ নতুন দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। একজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করে দায়িত্ব নিয়েছেন। আরও দুজন উপদেষ্টা আছেন এবং এর বাইরেও অনেকে আছেন।
সমালোচকেরা মনে করছেন, নতুন দলের নেতৃত্বের কাঠামো এবং তাদের রাজনৈতিক অবস্থান এই সন্দেহ আরও উসকে দিচ্ছে। নতুন রাজনীতি নাকি পুরোনো ধারার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যারা এতদিন লেজুড়ভিত্তির ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে ছিলেন, তারা নিজেরাই কেন নতুন রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন গঠন করলেন? এটা কি তাদের নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়? নতুন ছাত্রসংগঠনটি যদি একটি নিরপেক্ষ প্ল্যাটর্ফম হিসেবে কাজ করে, তাহলে সেটি কীভাবে পরিচালিত হবে, তা নিয়ে কিন্তু প্রশ্ন রয়েছে।
নতুন দলের আদর্শিক ও দার্শনিক ভিত্তি নিয়েও কিন্তু স্পষ্টতা নেই। অতীতে রাজনৈতিক দল নির্দিষ্ট আদর্শে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু নতুন রাজনৈতিক দলটি কোন ধরনের দার্শনিক ভিত্তিতে এগোবে, তা কিন্তু এখনো স্পষ্ট নয়।
একটা রাজনৈতিক দলকে দীর্ঘস্থায়ী হতে হলে তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক বক্তব্য এবং আদর্শিক ভিত্তি স্পষ্ট করতে হয়। যদি নতুন এই দল গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক দর্শন ও কর্মসূচি দিতে না পারে, তাহলে অতীতে যেমন কিছু দল টিকতে পারে নাই, তারাও পারবে না।
এ ছাড়া তারা যদি শুধুই বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনা করতে থাকে এবং গঠনমূলক রাজনীতির কোনো রূপরেখা না দেয়, তাহলে জনসমর্থন আদায় করা তাদের জন্য অনেক কঠিন হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় নতুন দলের আত্মপ্রকাশ গুরুত্বপূর্ণ হলেও এটি টিকে থাকবে কি না, তা নির্ভর করবে তাদের কৌশল, আদর্শ ও সাংগঠনিক শক্তির ওপর। তারা যদি শুধু পুরোনো রাজনৈতিক শক্তির বিকল্প হতে চায়, তবে তাদের সুনির্দিষ্ট নীতি ও কর্মপরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন।
যেটা এখনো পর্যন্ত লক্ষণীয় নয়। যদি জনগণ তাদের বার্তা গ্রহণ করে, তবে তারা রাজনৈতিক অঙ্গনে দীর্ঘস্থায়ী হবে। নতুন রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠনের যাত্রা কেবল শুরু হয়েছে। এটি সত্যিকার অর্থে রাজনীতিতে নতুন কিছু আনতে পারে, নাকি পুরোনো রাজনীতিরই পুনরাবৃত্তি হবে, তা সময়ই বলে দেবে।
পথটা খুব মসৃণ নয়। অত্যন্ত বন্ধুর তাদের জন্য। আমরা তাদের স্বাগত জানাই। কিন্তু অবশ্যই তাদের রাজনীতি যেন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করে। বাংলাদেশের অসুস্থ রাজনীতির সংস্কৃতি থেকে তারা যদি বাংলাদেশকে বের করে আনতে পারে, অবশ্যই তারা সাধুবাদ পাবে।
জিল্লুর রহমান, সাংবাদিক, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক ও তৃতীয় মাত্রার সঞ্চালক। তার ভিডিও থেকে অনুলিখন
আপনার মতামত লিখুন :