ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ, ২০২৫

বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাচ্ছেন ৬৯ হাজার রোহিঙ্গা, যা জানা গেল

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: মার্চ ১৮, ২০২৫, ০১:১২ পিএম
ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশের মূলধারার একটি গণমাধ্যম সূত্রে লেখা , “জুনের মধ্যে বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাচ্ছেন সৌদিতে থাকা ৬৯ হাজার রোহিঙ্গা” পোস্টার প্রচার করা হয়েছে। যা সঠিক নয় বলে জানিয়েছে তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানার।

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার সৌদি আরবে থাকা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট দিতে যাচ্ছে শীর্ষক দাবিটি বিভ্রান্তিকর। প্রকৃতপক্ষে, রোহিঙ্গারা ১৯৭৫ পরবর্তী সময় থেকেই নানা সময়ে বাংলাদেশের পাসপোর্ট পেয়ে সৌদি আরবে গেছে যা মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় আগামী জুনের মধ্যে তা নবায়ন করবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার৷ তাছাড়া, পাসপোর্ট নবায়ন করার সিদ্ধান্ত বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই নেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলে মূলধারার গণমাধ্যমটির ওয়েবসাইটে “জুনের মধ্যে বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাচ্ছেন সৌদিতে থাকা ৬৯ হাজার রোহিঙ্গা” শীর্ষক শিরোনামে গত ১৩ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়।

উক্ত প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, আগামী জুন মাসের মধ্যেই সৌদিতে থাকা ৬৯ হাজার রোহিঙ্গা পাসপোর্ট পাচ্ছেন। বিশেষ ক্যাটাগরিতে তাদের এমআরপি পাসপোর্ট দেওয়া হচ্ছে। সৌদি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এরই মধ্যেই ২৫ হাজার ৬৫১ জনের একটি তালিকা পাওয়া গেছে। পাসপোর্ট কার্যক্রম চলমান রাখার জন্য সরকারের কাছে অর্থ বরাদ্দও চাওয়া হয়েছে। তবে চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে অনেক কম। এতে সময়ের মধ্যে পাসপোর্ট দেওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

১৯৭৫ সালের পর থেকে কয়েক ধাপে সৌদি আরবে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নেন। এই রোহিঙ্গাদের অনেকেই বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে সেখানে গেছেন। আবার অনেক রোহিঙ্গা সৌদিতে অবস্থানকালে বাংলাদেশের পাসপোর্ট সংগ্রহ করেছেন।

সৌদি সরকার বলেছে, এমন রোহিঙ্গার সংখ্যা ৬৯ হাজার। তাদের পাসপোর্টের মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে। নবায়ন করতে হবে। গত বছর মে মাসে বাংলাদেশ সরকার এসব রোহিঙ্গার পাসপোর্ট নবায়ন করে দিতে সম্মত হয়। এজন্য বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে সমঝোতা সই হয়। সে অনুযায়ী উভয়পক্ষ একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করে। বর্তমানে ওয়ার্কিং গ্রুপ রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট প্রদানে কাজ করছে।

এরই সূত্র ধরে অনুসন্ধানে ডয়চে ভেলে বাংলার ওয়েবসাইটে “রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট নবায়নের সিদ্ধান্ত” শীর্ষক শিরোনামে গত বছরের ১২ মে’তে প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রতিবেদন পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, “সৌদি আরবে অবস্থান করা ৬৯ হাজার রোহিঙ্গার পাসপোর্ট নবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার

। ২০১০ সাল থেকে তারা (সৌদি আরব) মূলত এই পাসপোর্ট নবায়নের জন্য চাপ দিচ্ছে। রোববার (১২ মে ২০২৪) সৌদির এক প্রতিনিধি দল সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে৷ ওই বৈঠকে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দ্রুত নবায়নের জন্য চাপ দেওয়া হয়৷ এক পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকার তাদের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়৷”
 
রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট ইস্যু বিষয়ে উক্ত প্রতিবেদন থেকে এছাড়াও জানা যায়, মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক সামরিক অ্যাটাশে এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক সৌদি আরবে যাওয়া রোহিঙ্গাদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন।

ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘৭৫ এর পরবর্তী সময়ে সৌদি সরকার বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে আড়াই লাখ করে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়৷ তখন আমরা

পাঠিয়েছিলাম। পাকিস্তানও পাঠিয়েছিল আমরা যে ভুলটি করেছি, সেটা পাকিস্তান করেনি। পাকিস্তান কিন্তু তাদের জন্য ট্রাভেল ডকুমেন্ট তৈরি করে৷ সেই ডকুমেন্টে তারা নামের পাশে ব্র্যাকেটে আর লিখে দেয়৷ অর্থাৎ পাকিস্তানি নাগরিক হলেও তারা রোহিঙ্গা৷ কিন্তু বাংলাদেশ সরাসরি তাদের পাসপোর্ট দিয়ে দেয়৷ এটা তখনকার প্রশাসনে যারা ছিলেন তাদের ভুল। মারাত্মক ভুল। তখন কিন্তু সৌদি আরব আমাদের বলেনি, তাদের পাসপোর্ট দিতে হবে। আমরাই আগ্রহী হয়ে তাদের পাসপোর্ট দিয়েছিলাম। সেটাই এখন আমাদের গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যত দিন যাচ্ছে সংকট ততই বাড়ছে।”

অর্থাৎ, পাসপোর্ট নবায়নের সিদ্ধান্ত লম্বা সময় ধরে সৌদি আরবের চাপের ফলে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েই নেওয়া হয়েছে এবং রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেওয়া হয়েছিল মূলত তারও অনেক আগে ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে। উল্লেখ্য যে, ২০২৪ সালে পাসপোর্ট নবায়নে সম্মত হওয়ার আগে নানা সময়ে নানা সংখ্যার রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দেওয়ার বিষয়ে সৌদি আরব বাংলাদেশকে নিয়মিত চাপ দিলে সেসময় বাংলাদেশ সরকার পাসপোর্ট দিতে অস্বীকৃতি জানায়। অবশেষে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ সরকার মেনে নেয়।

এছাড়া, গত বছরের মে মাসে মূলধারার ২টি  গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদন থেকেও একই তথ্য জানা যায়। উক্ত প্রতিবেদনগুলো থেকেও জানা যায়, গত বছর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, সৌদিতে থাকা ওই ৬৯ হাজার রোহিঙ্গার পাসপোর্ট বাংলাদেশ নবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতবছর ঢাকায় একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, তারা তো বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে গিয়েছিল৷ সুতরাং আমরা শুধু তাদের পাসপোর্ট রিনিউ করে দেব। তাদের নাম ঠিকানা পাসপোর্টে যেমন আছে, তেমন থাকবে।

এছাড়াও জানা যায়, ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে নানা ধাপে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি পাসপোর্টে সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়েছিল।

 

উল্লেখ্য যে, কিছু পোস্টে দাবি করা হয়েছে, পাসপোর্ট দেওয়ার কারণে কিছুদিন পরই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ফিরে এসে ভূখন্ড দখল করবে। তবে, প্রকৃতপক্ষে উল্লিখিত রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট প্রায় চার যুগ আগে থেকেই নানা ধাপে দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া, উল্লিখিত রোহিঙ্গাদের সৌদি আরবের ফেরত দেওয়ার বিষয়ে বা বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে চলে আসার বিষয়েও কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং, মূলধারার গণমাধ্যম প্রথম আলো’র ওয়েবসাইটে গত ০৫ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ঢাকায় নিযুক্ত সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত ইসা ইউসুফ ইসা আলদুহাইলানের বরাতে জানানো হয়, বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি আরবে যাওয়া ৬৯ হাজার রোহিঙ্গা নাগরিকের পাসপোর্ট নবায়নের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। পাসপোর্ট নবায়ন হলেও তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে না সৌদি আরব।

সুতরাং, প্রায় চার যুগ আগে রোহিঙ্গাদেরকে দেওয়া বাংলাদেশি পাসপোর্টগুলো বর্তমান সময়ে নবায়নের সিদ্ধান্তকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট দিতে যাচ্ছেন দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা বিভ্রান্তিকর।