সাধারণ মানুষের কাছে আতঙ্কের অপর নাম পুলিশের অতিরিক্ত উপ-মহাপুলিশ পরিদর্শক (ডেভেলপমেন্ট) গাজী মোজাম্মেল হক। পুলিশ সদর দপ্তরে কর্মরত এই অতিরিক্ত ডিআইজির শতকোটি টাকা পাচার, দেশে ও বিদেশে স্ত্রী-সন্তানের নামে গাড়ি-বাড়িসহ নামে-বেনামে রয়েছে নানা সম্পদ।
এ ছাড়া রিমান্ডে নিয়ে মারধর, ক্রসফায়ার ও গুমের ভয় দেখিয়ে শত শত কোটি টাকার জমি, বসতভিটা, মাছের ঘের রেজিস্ট্রি করে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আবার দখল করা জমিতে পুলিশের নাম ব্যবহার করে তিনি গড়ে তুলেছেন ‘আনন্দ পুলিশ হাউজিং সোসাইটি’। অথচ পুলিশ বলছে, তাদের এমন কোনো আবাসন প্রকল্প নেই। আবাসন প্রকল্পটির বর্তমান বিক্রয়যোগ্য সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৬ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। এ ছাড়া, নামে-বেনামে রয়েছে তার আয়বহির্ভূত পাহাড়সমান সম্পদ।
এই জিআইজির ‘আয়নাঘরের’ মতো একটি নির্যাতন সেলও ছিল, যেখানে অন্ধকার ঘরে মানুষকে আটকে রেখে দিনের পর দিন হাত-পা বেঁধে অমানসিক নির্যাতন চালানো হতো। ভুক্তভোগীদের কাছে আতঙ্কের নাম ছিল ‘ডিআইজি মোজাম্মেল-ঘর’।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল দুবাই, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও তুরস্কে অর্থ পাচার করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। একই সঙ্গে রিমান্ডে নিয়ে ৬২ বিঘা জমি রেজিস্ট্রি করেছেন। ২০১৯ সালের ৩ এপ্রিল রাজধানীর ডেমরার সারুলিয়া এলাকার বড়ভাঙ্গা পশ্চিম টেংরার বাসিন্দা আব্দুল মতিনের স্ত্রী আফরোজা আক্তার আঁখি ৬২ বিঘা জমি লিখে নেওয়ার অভিযোগ তুলে অতিরিক্ত ডিআইজির বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে মামলা করেন। ওই সময় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের রমনা জোনাল টিমের সদস্য ইন্সপেক্টর দীপক কুমার দাসকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হয়।
আরেক ভুক্তভোগী বৃদ্ধ জাহের আলী (৭০) চোখে-মুখে আতঙ্ক নিয়ে ডিআইজি মোজাম্মেলের নির্যাতনের বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, ‘আমি জিয়াউল আহসানের আয়নাঘর দেখিনি। তবে মোজাম্মেলের গোপন ঘর দেখেছি। আমাকে ১৩ দিন অন্ধকার ঘরে আটকে রেখে হাত-পা বেঁধে নির্যাতন করা হয়েছে। একই সঙ্গে নির্যাতনের শিকার হয়েছে আমার ছেলে ও মেয়ের জামাই। নির্যাতন করে ব্যক্তি মালিকানাধীন ৬২ বিঘা জমি লিখে নিয়েছেন তিনি, যার মূল্য প্রায় শত কোটি টাকা। এ ছাড়াও নিয়েছেন নিজ বাড়ির গ্যারেজে থাকা তিনটি প্রাইভেট কার। এ ঘটনায় তিনি ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে অভিযোগ দায়ের করেন।’
এদিকে ঢাকা মহানগর হাকিম দেবব্রত বিশ্বাস বাদী আফরোজা আক্তার আঁখির জবানবন্দি গ্রহণ করে অভিযোগের বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী সাক্ষীদের জবানবন্দি নিতে বিচারক নির্ধারণের জন্য মামলার নথি ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম মো. জাহিদুল কবিরের কাছে পাঠানো হয়।
আরজিতে অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল ও তার স্ত্রী ফারজানা মোজাম্মেল, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের রমনা জোনের সদস্য ইন্সপেক্টর দীপক কুমার দাস, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুজ্জামান মনির, ডেমরার সাব-রেজিস্ট্রার আফছানা বেগম, সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের অফিস সহকারী হানিফ আলী শেখ, ইউনাইটেড কর্মাশিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের ঢাকার নয়াবাজার শাখার এক্সিকিউটিভ অফিসার সাজ্জাদুর রহমান মজুমদার, দলিল লেখক মো. জাকির হোসেন, জসিমদ্দিন, ইমরান হোসেন, আনন্দ হাউজিংয়ের পরিচালক চৌধুরী মো. জাবের সাদেক, নজরুল ইসলাম, এ বি এম সিদ্দিকুর রহমান, খোরশেদ আলম, আব্দুর রহিম, তারিকুল মাস্টার, সিদ্ধার্থ, গণেশ, পলাশ ও সৈকতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, ঘটনা সাজিয়ে রাজধানীর শাহবাগ থানায় ৪৩ (৭) ১৮ নম্বর মামলা করা হয়। পরে বাদীর স্বামী আব্দুল মতিন, শ্বশুর আলহাজ্ব মো. জাহের আলী ও ননদের জামাই আবু তাহেরকে গ্রেপ্তার করে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম অদালতে হাজির করে ১০ দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে পুলিশ।
বিচারক ২০১৮ সালের ২৫ জুলাই জাহের আলীকে পাঁচ দিন এবং মতিন ও তাহেরকে তিন দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দেন। ওই দিনই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দীপক কুমার দাস তাদের আদালত থেকে রিমান্ডে নেন। পরে ২৬ জুলাই, অর্থাৎ এক দিন পরে মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে সম্পত্তি আত্মসাতের জন্য বাদীর শ্বশুরকে রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় নিয়ে দুটি দলিল রেজিস্ট্রি করে নেয়, যার নম্বর ৫৩৬৭, তারিখ ২৬/০৭/২০১৮ এবং নম্বর ৯২২৬, তারিখ ২৬/০৭/২০১৮।
এ ছাড়া ব্যাংকে বন্ধক রাখা পাওয়ার বাতিল করার জন্য নতুন পাওয়ার দলিল তৈরি করেন, যার নম্বর ৫৩৬৬, তারিখ ২৬/০৭/২০১৮।
এর আগে ২০১৮ সালের ১৫ জুলাই বাদীর স্বামীকে ডিবি পরিচয় দিয়ে কুড়িল বিশ্বরোড এলাকা থেকে জোর করে তুলে নিয়ে চারটি দলিল রোজিস্ট্রি করে নেন। এ ছাড়া ২০১৮ সালের ১১ জুলাই পুলিশ হেডকোয়ার্টারে মিটিংয়ের কথা বলে নিয়ে বাদীর শ্বশুর ও স্বামীকে চোখ বেঁধে নির্জন স্থানে আটকে রেখে পাঁচটি দলিল সম্পাদন করে নেয় আসামিরা।
২০১৮ সালের ৩১ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের বক্তবাড়ী এলাকায় তাদের বসতবাড়ি থেকে বের করে দিয়ে গ্যারেজে রাখা তিনটি গাড়ি নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করা হয়েছে। ওই গাড়ি তিনটি হলো ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৩-৯২৫১, ঢাকা মেট্রো-ঘ-১৫-২৫২৮ ও ঢাকা মেট্রো-ঘ-৩৩-৪৬৫২।
আসামিরা বিভিন্ন সাজানো মামলা দিয়ে বাদীর স্বামী, শ্বশুর ও ননদের স্বামীকে হয়রানির ঘটনায় আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে লিখিত অভিযোগ করা হয় বলে দাবি করা হয়েছে। মামলাটি এখন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ১৫-এর আদালতে বিচারাধীন। ১৫ নম্বর আদালতের পেশকার তানভির মামুন তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি গাজী মোজাম্মেল হক জবরদখল করে গড়ে তুলেছেন ‘আনন্দ পুলিশ হাউজিং সোসাইটি’ নামের আবাসন প্রকল্প। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানার কায়েতপাড়া ইউনিয়নে পূর্বাচলের ৩ নম্বর সেক্টরের পাশে ‘আনন্দ পুলিশ হাউজিং সোসাইটি’। প্রায় ৩ হাজার বিঘা জমি ভরাট করে প্লট আকারে বিক্রি করা হচ্ছে। কয়েকটি প্লটে দাঁড়িয়ে গেছে বহুতল ভবনও।
রূপগঞ্জের বাসিন্দা ভুক্তভোগী হাজি সোলেমান বলেন, রূপগঞ্জে গড়ে ওঠা ‘আনন্দ পুলিশ হাউজিং সোসাইটি’র জায়গায় আমার বসতভিটা এবং মাছের খামার ছিল। হত্যার হুমকি ও নির্যাতন করে সেই জমি দখল করে নিয়েছেন অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল।
তিনি আরও বলেন, জমি রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসন থেকে পুলিশের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত অভিযোগ করেও কোনো সুফল মেলেনি।
সরেজমিনে গিয়ে ও স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু হাজি সোলেমান, জাহের আলী ও তার পরিবারই নয়, এমন নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তির তালিকা অনেক লম্বা।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ ধরনের কোনো সমবায় সমিতির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এমন কোনো আবাসন প্রকল্প পুলিশের নেই।
পুলিশের আরেকটি সূত্র বলছে, ‘এই বিপুল সম্পদের মালিকানা ধরে রাখতে হয়তো পুলিশের নাম ভাঙিয়েছে। আমাদের ধারণা, এই সম্পদের মালিক মোজাম্মেল হক নিজেই।’
জানা যায়, ১৭তম বিসিএসে পুলিশের সহকারী কমিশনার পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ১৯৯৭ সালে চাকরিজীবন শুরু করেন গাজী মোজাম্মেল হক। বর্তমানে তিনি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে অতিরিক্ত ডিআইজি পদে কর্মরত। পাশাপাশি নিযুক্ত রয়েছেন একটি আবাসন প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে। ‘আনন্দ পুলিশ হাউজিং সোসাইটি’ নাম প্রচার করে গড়ে তোলা আবাসন প্রকল্পটির বর্তমান বিক্রয়যোগ্য সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৬ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে অতিরিক্ত ডিআইজি গাজী মোজাম্মেল হকের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এ কারণে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
আপনার মতামত লিখুন :