ঢাকা শুক্রবার, ১০ জানুয়ারি, ২০২৫

আমদানিকারকের সিন্ডিকেটে সারের কৃত্তিম সংকট

মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১০, ২০২৫, ০১:১৭ এএম

আমদানিকারকের সিন্ডিকেটে সারের কৃত্তিম সংকট

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

দেশের প্রায় সব অঞ্চলে সারের সংকট দেখা দিয়েছে। আসছে বেরো মৌসুমে আরও ব্যাপকভাবে এই সংকট সৃষ্টি হতে পারে। একই সঙ্গে বাড়ানো হয়েছে সব ধরনের সারের দামের। এতে কৃষি উৎপাদন হ্রাস এবং ব্যয় বাড়ায় কৃষকের নাভিশ্বাস অবস্থা। 


আমদানিকারকের সিন্ডিকেটে ডিলারদের কাছে সারের সরবরাহ কমেছে। আগে ডিলাররা ৩-৪ দিনে সার পেতেন, এখন ১৫ থেকে ২৫ দিন সময় লাগছে। ফলে কৃষক পর্যায়ে সার সরবরাহে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন ডিলার ও সাধারণ ব্যবসায়ীরা। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিন্ডিকেট করে সারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে বলে দাবি করেন ডিলার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।


তাদের অভিযোগ, যশোরের নওয়াপাড়ার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নওয়াপাড়া ট্রেডার্স ডিলারদের সার সরবরাহে গড়িমসি করছে। এতে মারাত্মকভাবে ব্যবসায়িক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষক ও সার বিক্রেতা। ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে গড়ে উঠা সিন্ডিকেট বর্তমানে বহাল থাকায় এই সংকটের সৃষ্টি বলে তাদের অভিমত। 


সিন্ডিকেটের মূলহোতা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নওয়াপাড়া গ্রুপ। তারা বিভিন্ন নামে সরকারের ভর্তুকির সার আমদানি করছে। যেসব প্রতিষ্ঠানের নামে এলসি করে তার মধ্যে রয়েছে- সাইফুল্লাহ পাকোয়া, সাইফুল্লাহ গাল্ফ, ফায়াজ ট্রেডিং, দীপা এন্টারপ্রাইজ, সুফলা ট্রেডিং করপোরেশন। 


আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ডিলারদের কোনো প্রতিনিধির মাধ্যমে বর্তমানে সার সরবরহ করছে না। তারা বলছে, সার নিতে হলে ডিলারকে অবশ্যই নওয়াপাড়ায় এসে কাগজপত্র দিয়ে মাল তুলে নিয়ে যেতে হবে। এতে করে ডিলাররা বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অন্যদিকে কৃষি কর্মকর্তা ডিলারকে দ্রুত মাল উত্তোলনে চাপ দিচ্ছে। এতে ডিলাররা খুব চাপে থাকছে।


এদিকে, ডিলারদের সার উত্তোলনে দেরি হওয়ার বিষয়টি জানাজানি হলে হয়রানির নতুন নাটক সাজিয়েছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। তারা ১২টি প্রতিষ্ঠানকে নির্ধারণ করে দিয়েছে। প্রতিনিধি ও ট্রান্সপোর্টে শুধু ১২টি প্রতিষ্ঠান মাল উত্তোলন করতে পারবে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো-মেসার্স এ এম ট্রেডার্স, মেসার্স মান্নান অ্যান্ড ব্রাদার্স, মেসার্স মনির এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স বি কে ট্রেডার্স, মেসার্স জামান ব্রাদার্স, মেসার্স রাশেদ ট্রেডিং, মেসার্স নওগাঁ ট্রেনিং, মেসার্স বান্ধব ট্রেডার্স, মেসার্স নেওয়াজ ট্রেডার্স, মেসার্স দিশা ইন্টারন্যাশনাল, মেসার্স রহমাহ ট্রান্সপোর্ট, মেসার্স মাহিন এন্টারপ্রাইজ। এতে করে বাকি সব ব্যবসায়ীরা পড়েছেন বিপাকে। 


সরকারি (জি-টু-জি) ও বেসরকারি দুভাবেই সার আমদানি করেন নওয়াপাড়া ট্রেডার্স। সে কারণে একচ্ছত্র আধিপত্য বা সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে বাংলাদেশ রাসায়নিক শিল্প করপোরেশন বা বিসিআইসি ইউরিয়া সার সরবরাহ করে থাকে। একই সঙ্গে এমওপি, ডিএপি ও টিএসপি সার সরবরাহ করে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন বা বিএডিসি।


কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে সরকারি (জি-টু-জি) চুক্তির আওতায় ৫৮২ কোটি ২৪ লাখ ১২ হাজার টাকা ব্যয়ে কাতার, সৌদি আরব ও মরক্কো থেকে তিন ক্যাটাগরির মোট ১ লাখ টন সার আমদানির অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে ৩০ হাজার টন বাল্ক গ্র্যানুলার ইউরিয়া সার, ৪০ হাজার টন ডিএপি সার ও ৩০ হাজার টন টিএসপি সার রয়েছে। 


অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে গত ২ জানুয়ারি সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত ক্রয় কমিটির সভায় এ অনুমোদন দেওয়া হয়। সভায় শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে কাতার এনার্জি মার্কেটিং থেকে প্রতি টন ৩৫৪ দশমিক ৬৭ ডলার দরে ৩০ হাজার টন বাল্ক গ্র্যানুলার ইউরিয়া সার আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে মোট ১২৭ কোটি ৬৮ লাখ ১২ হাজার টাকা। 
এ ছাড়া সৌদি আরব এবং বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির আওতায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবের আলোকে সৌদি আরবের মা’ডেন থেকে প্রতি টন ৬১৭ ডলার দরে ৪০ হাজার টন ডিএপি সার আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৯৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা এবং মরক্কোর ওসিপি নিউটিক্রপস এসএ থেকে প্রতি টন ৪৪০ ডলার দরে ৩০ হাজার টন টিএসপি সার আমদানিতে ১৫৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয় হবে। 


বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) রাজশাহী, নাটোর ও কুষ্টিয়া অঞ্চলের ডিলারদের সঙ্গে কথা বলে সারের সংকটের বিষয়ে একাধিক ডিলার জানান, সরকারি ভর্তুকির সার আমরা আমদানিকারকের মাধ্যমে নিজস্ব মোকামে নিয়ে আসি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বরাদ্দকৃত উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার সত্যায়িত কাগজের মাধ্যমে প্রতিনিধির মাধ্যমে দেশের অন্যতম বৃহত্তম মোকাম নওয়াপাড়া থেকে আমরা এই ভর্তুকির মাল উত্তোলন করে থাকি। তবে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নোয়াপাড়া ট্রেডার্সের নিজস্ব সিন্ডিকেটের কারণে মাল পেতে মাস পেরিয়ে যায়। টাকা জমা দেওয়ার ১৫-২০ দিন পরে সার হাতে পৌঁছায়। অথচ আগে প্রতিনিধির মাধ্যমে দুই-তিন দিনের মধ্যে সার উত্তোলন করেছি। 


এ বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মো. মনিরুজ্জামান বলেন, আমদানিকারকদের সিন্ডিকেটের কারণে ডিলারদের সার পেতে দেরি হচ্ছে- এ ধরনের অভিযোগ আগে আসেনি। তবে লিখিত অভিযোগ বা মৌখিকভাবেও পেলে অবশ্যই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের সভাপতি কৃষিবিদ হাসান জাফিদ তুহিন বলেন, পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা সরকারের সিন্ডিকেট এখনো সর্বত্র বহাল। যে কারণে কৃত্রিম সংকটের সৃষ্টি করা হচ্ছে। নতুন করে অরাজকতা করতে চায় তারা।


সারের কৃত্রিম সংকটের বিষয়ে দেশের বৃহত্তর সার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নওয়াপাড়া ট্রোডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. ফাইজুর রহমান বকুল বলেন, আমি দেশের বাইরে আছি। এখন কিছু বলতে পারব না। যা বলার রিয়াজ সাহেব (বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সচিব) বলবেন।


ডিলারদের হয়রানি ও আমদানিকারকদের সিন্ডিকেটের বিষয়ে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী সচিব রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকারের বিপণন পদ্ধতিতে বলা আছে, যেকোনো জেলা থেকে ডিলার বা ডিলারের প্রতিনিধি বা প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মচারী এলে সার দিতে হবে। এর আগে যে প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপোর্ট করত তাকেই সার উত্তোলনে নির্ধারণ করা হয়। মূল বিষয় হলো আরও বেশি আস্থাশীল ও ট্রান্সপারেন্ট হওয়ার জন্য এটা করা হয়েছে। 


তিনি বলেন, আমদানিকারক যদি কোনো ট্রান্সপোর্টকে নির্ধারণ করে দেন, তাহলে এটা অন্যায়। এটা করার কোনো সুযোগ নেই। ডিলার যাকে ইচ্ছা তাকে দিয়ে ট্রান্সপোর্ট করাতে পারবে, এতে কোনো অসুবিধা নেই। যথাযথভাবে টাকা জমা দেওয়ার দুই দিনের মধ্যে ডিলাররা সার পেতে বাধ্য।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভাইস চেয়ারম্যান ও কৃষক দলের সাবেক সভাপতি শামসুজ্জামান দুদু বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সার নিয়ে যতটা সতর্ক হওয়া দরকার ছিল, ততটা হন নাই। মৌসুম শুরু হওয়ার অন্তত তিন চার মাস আগে সার্বিক প্রস্তুতি থাকা উচিত ছিল। 


তিনি বলেন, পতিত আওয়ামী স্বৈরাচারী সরকারের আমল থেকেই কৃষি ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট চলে আসছে। যা এখনো বিদ্যমান। এই সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে যত দ্রুত সম্ভব একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হতে হবে। তাহলে স্বৈরশাসকের সিন্ডিকেট দ্রুত সময়ের মধ্যে দমন করা সম্ভব হবে।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!