ঢাকা শনিবার, ১১ জানুয়ারি, ২০২৫

পাঁচ মাসেও কাঙ্ক্ষিত সেবা মিলছে না পুলিশে

রুবেল রহমান

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১১, ২০২৫, ০৯:০০ এএম

পাঁচ মাসেও কাঙ্ক্ষিত  সেবা মিলছে না পুলিশে

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলন দমাতে শুরু থেকেই মারমুখী ছিল পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক দমন-পীড়ন আর ধরপাকড়ে ছাত্রদের আন্দোলন রূপ নেয় গণ-আন্দোলনে। কোটার আন্দোলন শেষে গিয়ে ঠেকে এক দফার সরকার পতনের আন্দোলনে। গণআন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের শোচনীয় পতন হয়। পতিত সরকারি দলের নেতাদের পাশাপাশি জনরোষে পড়ে পুলিশ বাহিনী। ভেঙে পড়ে পুলিশের চেইন অব কমান্ড। পুলিশের অধিকাংশ সুবিধাবাদী ও সরকার বা আওয়ামীঘেঁষা কর্মকর্তারা আত্মগোপনে চলে যান। কেউ কেউ এখন আছেন নজরদারিতে। 

সেবাগ্রহীতাদের অভিযোগ, ফ্যাসিবাদ পতনের ৫ মাস পার হলেও কাক্সিক্ষত সেবা মিলছে না পুলিশের কাছ থেকে। যদিও ক্ষত কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে পুলিশ। জনবল, অস্ত্র ও যানবাহনের ঘাটতি থাকলেও সাধারণ মানুষকে সেবা দেওয়ার চেষ্টায় বাহিনীর সদস্যরা। রাজধানীর বেশির ভাগ থানায় নতুন সদস্য যুক্ত হওয়ায় পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে বেগ পেতে হচ্ছে তাদের। একই সাথে সোর্স তৈরি কিংবা অপরিচিত পরিবেশে নতুন নতুন সমস্যার সম্মুখীন পুলিশ। এ ছাড়া ঢাকার পথঘাট না চেনায় আসামি ধরতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তাদের।

আন্দোলন চলাকালীর পুলিশের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের আগে-পরে জনরোষের শিকার হয় পুলিশ। সারা দেশে পুলিশের পাঁচশর বেশি স্থাপনায় হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। যদিও এর মাধ্যমে প্রমাণ হয় জনগণের বন্ধু হিসেবে পরিচিত পুলিশের ওপর সাধারণ মানুষের ক্ষোভ কতটা। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনগণের বন্ধু মুখে বললেও নিজেদের বন্ধু প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ। জুলাই অভ্যুত্থানে প্রাণ হারান অন্তত ৪৪ পুলিশ সদস্য। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রাজধানীর ভাটারা থানার মূল ফটকের পাশে এখনো পোড়া গাড়ির স্তূপ। পাঁচ মাসে পোড়া গন্ধ দূর হলেও দগদগে ক্ষত এখনো স্পষ্ট। বোঝা যায়, ৫ আগস্ট বিক্ষুব্ধ জনতার হামলায় অবশিষ্ট ছিল না কিছুই। পাঁচ মাসে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে থানাটি। যদিও লুট হওয়া ৫২টি অস্ত্রের খোঁজ মেলেনি এখনো। 

সাধারণের ক্ষোভের আগুনে পুড়েছে যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, শাহবাগ, মিরপুরসহ রাজধানীর বেশির ভাগ থানা। আলামত ও পুলিশের গাড়িসহ যাত্রাবাড়ীতেই পোড়ানো হয় প্রায় অর্ধশত যানবাহন। যে ক্ষত এখনো পূরণ হয়নি। থানায় এসেছেন নতুন পুলিশ কর্তারা। তবে ক্ষোভের বিস্ফোরণের চিহ্ন দেখে পিলে চমকে যাওয়ার অবস্থা কারো কারো। থানায় সেবা নিতে আসা শিখা চৌধুরী বলেন, আগে থানায় এলে পুলিশের যে আচরণ ছিল, তাদের সাথে কথা বলাই কঠিন ছিল। তবে এখন সেবার মান বদলেছে। আমার একটি মোবাইল চুরি হয়েছে, তার জন্য পুলিশের কাছে সহযোগিতা চাইতে এসেছি। আশা করি, সহযোগিতা পাব। 

যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. ফারুক আহম্মদ বলেন, পুলিশ এখন মানুষের অভিযোগ শোনে, কিন্তু চাপ সৃষ্টি করতে পারে না। জনগণ এগ্রেসিভ মুডে থাকে, তাদের বোঝাতে সক্ষম হই না যে আমাদেরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। স্থানীয়রা সেবা নিতে থানায় আসছেন, তবে পুলিশ সদস্যদের অস্বস্তি পুরোপুরি কাটেনি এখনো। অপরাধ দমনে নিয়মিত টহল শুরু হয়েছে। 

যত চাপই আসুক পেশাদারি বজায় রাখতে অতীতের মতো অন্যায়ের সাথে আপোষ না করার পরামর্শ নিরাপত্তা বিশ্লেষক জগলুল আহসানের। রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, দায়িত্ববোধ এবং কর্তব্য পালন থেকে পুলিশ বিচ্যুত হয়ে গিয়েছিল। রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার হলে কী হয় সেটি হয়তো পুলিশ আগে বুঝতে চায়নি। ৫ আগস্টের পর তারা এবার বুঝতে পারছে কী পরিণতি হয়। মানুষের ক্ষোভ কতটা। এখন পুলিশের প্রয়োজন জনগণের আস্থা অর্জন।

এদিকে খুন, ছিনতাই, ডাকাতি আর দখলবাজির অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে রাজধানীর মোহাম্মদপুর। ৫ আগস্টের পর অপরাধের মাত্রা বেড়েছে কয়েক গুণ। ছিনতাইকারীর দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী। আতঙ্কের জনপদ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে মোহাম্মদপুর। দিন আর রাতের আলাদা কোনো ভাগ নেই অপরাধীদের কাছে, একা পেলে দিনদুপুরেই অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ছিনতাইকারীর দল। একটি সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, শুধু ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়েই সন্তুষ্ট নয় তারা, ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানোর চেষ্টা করছে এক তরুণীকে। 

মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা রাবেয়া খাতুন বলেন, রাতের বেলা নয়, শুধু দিনের বেলাতেও বের হতে আতঙ্কে থাকে এই এলাকার লোকজন। ঘরেও আতঙ্কে থাকতে হয় কখন ডাকাত চলে আসে। বাইরে কিছু রাখা যায় না, নিয়ে যায়। মোহাম্মদপুরের আরেক বাসিন্দা মো. রাজু বলেন, এসব চোর-ডাকাত আর ছিনতাইকারীদের রাজনৈতিক নেতারা শেল্টার দিয়ে আসছেন। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অপরাধ করে চলছে তারা। আওয়ামী লীগ চলে গেছে, এখন যারা এলাকায় আছে তাদের হয়ে কাজ করছে এরা।

সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা য়ায়, অপরাধীদের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছর। শুধু ছিনতাই না, খুন, অপহরণ, দখল, চাঁদাবাজিসহ হেন অপকর্ম নেই যা তারা করছে না। সম্প্রতি মোহাম্মদপুর এলাকায় খুন হন কয়েকজন, প্রতি মাসে বিভিন্ন অপরাধে মামলা হচ্ছে ৮০টির বেশি। প্রতিদিন এত চুরি-ছিনতাই হলেও সন্ত্রাসীদের ভয়ে মামলা হয় কম। আর পুলিশ কেবল মামলা হলেই ব্যবস্থা নেয়। এ ছাড়া পুলিশের রয়েছে সক্ষমতার ঘাটতি। 

৫ আগস্টের পর যুক্ত হয়েছে নতুন সদস্য। খোয়া যাওয়া বেশির ভাগ অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি, যানবাহনও প্রয়োজনের তুলনায় কম। নতুন জনবল আর অপ্রতুল যানবাহনের কারণে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ। চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও অপরাধীর বিরুদ্ধে অভিযান চলমান আছে বলে জানান ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। 

মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলী ইফতেখান হাসান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমরা গোপনে তথ্য সংগ্রহ করছি, অভিযান চালাচ্ছি, ধরছি। ভুক্তভোগীরা খবর দিলে আমরা যাচ্ছি, আসামি ধরে নিয়ে আসছি। নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি, মোহাম্মদপুরের সীমানা বেড়েছে। নতুন বসতি বেড়েছে, এদের নিরাপত্তা দিতে হলে যে পরিমাণ গাড়ি দরকার, তা আমাদের নেই। তা ছাড়া ঘাটতি আছে জনবলেও। এসব সাপোর্ট বাড়াতে পারলে নিরাপত্তা ঘাটতি হবে না। পূর্বের ক্ষমতাসীনদের মদদেই মোহাম্মদপুরের অপরাধীরা এমন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। 

এলাকার যারা নেতা, এদের মাসল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এদের গানম্যান হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এদের দিয়ে দখল করিয়েছেন। চাঁদাবাজির কাজে ব্যবহার করেছেন। ব্যবহার হতে হতে তারা এমন জায়গায় গেছে, তারা এখন আর স্বাধীনভাবে কাজ করার চিন্তাও করতে পারছে না। দীর্ঘদিনের অভ্যাস তো, এত তারাতারি ছাড়তেও পারে না। তারা এখন নতুন গডফাদার খুঁজতেছে। যারা এখন ক্ষমতাশালী হয়ে উঠবে, অপরাধীরা আবার তাদের ছত্রছায়ায় চলে যাচ্ছে। শেল্টার পাচ্ছে বলেই তারা টিকে আছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক জগলুল আহসান রূপালী বাংলাদেশকে  বলেন, মোহাম্মদপুরের অপরাধ প্রবণতা দমনে যৌথ বাহিনী ও এলাকাবাসীর সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। তারা কী কারণে অপরাধে জড়াচ্ছে তার একটা বিশ্লেষণ প্রয়োজন। তারা যদি অর্থনৈতিক কারণে অপরাধে জড়ায়, তবে তাদের পজিটিভ কাজের সাথে সম্পৃক্ততার ব্যবস্থা করলে হয়তো এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। 

ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটিস নির্মূল করতে সময় লাগবে, তবে সেটা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। ভেঙে পড়া মনোবল ফেরাতে শুরু করেছে পুলিশ সদস্যরা। জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আগের মতো তৎপর হওয়ার চেষ্টায় বাহিনীটি। তবে লুট হওয়া ৫ হাজার ৭৫০টি অস্ত্রের মধ্যে ২৫ শতাংশ এখনো উদ্ধার না হওয়ায় চ্যালেঞ্জ থেকেই যাচ্ছে। পুলিশকে কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর নয়, বরং জনগণের হয়ে কাজ করার পরামর্শ এই বিশেষজ্ঞের। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে না জড়ালে বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফেরানো সহজ হবে, বলছেন এই বিশেষজ্ঞ। দলীয় স্বার্থে নয়, পুলিশকে জনগণের জন্য কাজ করার পরামর্শ দেন এই বিশেষজ্ঞ।

বিক্ষুব্ধদের হামলায় জুলাই-আগস্টে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পুলিশের ৪৬০টি স্থাপনা। ১ হাজার ৭৪টি গাড়িতে আগুন দেয় বিক্ষুব্ধরা। পাঁচ আগস্টের পর দেশের প্রায় সব থানাই পুলিশ শূন্য আর পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। তবে পাঁচ মাসের চেষ্টায় আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে পুলিশ। বিভিন্ন থানা থেকে লুট হওয়া প্রায় ৫ হাজার ৭৫০টি অস্ত্রের মধ্যে এ পর্যন্ত ৪ হাজার ৩৫১টি উদ্ধার করা হয়েছে। 

এসব অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারলে ঝুঁকি থাকে- অপরাধীদের হাতে চলে গেলে দেশে বাড়তে পারে অপরাধ তৎপরতা। অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে দ্রুত আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণই এখন পুলিশের বড় চ্যালেঞ্জÑ বলছেন বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তিনি বলেন, পুলিশের মনোবল ফেরাতে ঊর্ধ্বতনরা কল্যাণসভা, সেমিনার করছেন, অভিযানের আগে ব্রিফ করা হচ্ছে। 

পুলিশ সদর দপ্তরে এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স) ইনামুল হক সাগর বলেন, আমাদের যে ইউনিট রয়েছে, ৫ তারিখের পর আমরা সীমিত সাপোর্ট নিয়েও প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমাদের অনেক সংকট রয়েছে এটা সত্যি, তবে আমরা চেষ্টা করছি তা দিয়েই সেবা দিতে। এমনিতেই আমাদের গাড়ি সংকট, তার ওপর অনেক গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। নতুন সদস্য দিয়ে কাজ করাতে বেগ পেতে হচ্ছে, তারপরও আমাদের চেষ্টার কোনো কমতি নেই। লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে তথ্য দিয়ে পুলিশকে সহযোগিতার আহ্বান জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!