ঢাকা শনিবার, ১১ জানুয়ারি, ২০২৫

ব্যয়ের চাপ আরও বাড়াল এনবিআর

শাহীনুর ইসলাম শানু

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১১, ২০২৫, ০৮:৫৩ এএম

ব্যয়ের চাপ আরও বাড়াল এনবিআর

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমেছে। একই সঙ্গে ১৩ বছরের শীর্ষে রয়েছে মূল্যস্ফীতি ও বাণিজ্য ঘাটতি। সেই সময়ে খরচের খাতে পিষ্ট হওয়া মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে আরও ব্যয় বাড়ল। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মাঝপথে এসে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার।

ভঙ্গুর অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় অধ্যাদেশ জারি করেছে সরকারের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আইএমএফের শর্ত মানতে গিয়ে নুতন করে খরচের খাত বাড়ায় মূল্যস্ফীতি বাড়বে এবং ভোক্তাদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

অন্যদিকে, নুতন অর্থবছরে রপ্তানি বাড়লেও আমদানি কমায় বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। চলতি অর্থবছরের পাঁচ মাসে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে কমেছে ১ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার বা ২০ শতাংশ। সেই সময়ে নতুন করে প্রায় ১০০টি পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। এতে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে এবং ভোক্তাদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রজ্ঞাপন জারি করার পরে আজ শনিবার থেকে প্রায় ১০০ পণ্যের ওপর নতুন ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্কহার কার্যকর হবে। 

তবে সরকারের এমন সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই), বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি ও টেলিকনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টিক্যাব)। আইএমএফের সিদ্ধান্তকে আমলে নিলেও মূল্যবৃদ্ধির নেতিবাচক বিষয়গুলো আমলে নেয়নি সরকার। এমন সময়ে সরকারের এমন সিদ্ধান্তকে বিপজ্জনক বলেছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)।

প্রতিষ্ঠানটি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানায়, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে ব্যবসার ব্যয় কয়েক গুণ বাড়বে। বর্তমান পরিস্থিতিতে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে সামগ্রিক বিনিয়োগের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে যেমন নতুন শিল্প স্থাপনের সম্ভাবনা কমবে, তেমনি বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের ব্যবসা পরিচালনা বিঘ্নিত হবে। দুর্বল হবে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা; কমবে স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ। 

খরচ বাড়ল ১০০ পণ্যে: প্রায় ১০০ পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। আজ শনিবার থেকে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারে আরও ৩ শতাংশ শুল্কহার যুক্ত হচ্ছে। এছাড়া টিস্যু, আঙুর, আপেল, তরমুজ, তৈরি পোশাক, রেস্তোরাঁ, মিষ্টি, এলপি গ্যাস, হোটেল ভাড়া ও চশমার মতো পণ্যের ওপর নতুন ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্কহার কার্যকর হবে।

রেস্তোরাঁ ও হোটেলগুলো ৫ শতাংশ শুল্ক দিলেও এখন থেকে ১৫ শতাংদ দিতে হবে। তার সঙ্গে বিস্কুট ও কেক, আচার ও টমেটো সস, কাপড়, দর্জির দোকান, টয়লেট টিস্যু, ন্যাপকিন ও টাওয়েল, মিষ্টি, ড্রাইভিং লাইসেন্স, নন-এসি হোটেল, চশমা, সানগ্লাস, মোটর ওয়ার্কশপ ও লুব্রিকেন্ট তেলের ওপর ৫ শতাংশের পরিবর্তে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ভ্যাট দিতে হবে। 

এনবিআর জানায়, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, বৈদ্যুতিক খুঁটি, স্টিলের কোল্ড রোল্ড কয়েল, চুনাপাথর ও ডলোমাইটের মতো কয়েকটি শিল্পপণ্যের ভ্যাটও ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। বাণিজ্যিক পর্যায়ে ওষুধের ওপর ভ্যাট বাড়ানোর কারণে ওষুধের দামও বাড়বে। এ ক্ষেত্রে ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে। ১০ শতাংশ থেকে ভ্যাট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার কারণে মুদ্রণ, সিনেমার টিকিট, মেরামত ও সার্ভিসিং এবং পরিচ্ছন্নতা সেবার খরচও বাড়বে। উড়োজাহাজের টিকিটের ওপর আবগারি শুল্ক বাড়ানোয় আকাশপথে যাত্রার খরচও বাড়বে। 

সেই সঙ্গে বাড়বে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট সেবার খরচ। মোবাইল ফোন ব্যবহারের ওপর সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৩ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে এখন থেকে মোবাইল ফোন ব্যবহারের খরচে সম্পূরক শুল্ক, ভ্যাট ও সারচার্জ ৩৯ শতাংশের পরিবর্তে ৪২ দশমিক ৪৫ শতাংশের বেশি দিতে হবে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ওপর ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করায় ইন্টারনেট বিলও বাড়তে পারে। 

শুল্কহার বৃদ্ধির বিষয়ে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সভাপতি এমদাদুল হক বলেন, ‘এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে আমরা কীভাবে টিকে থাকব, সে ব্যাপারে সন্দিহান। আইএসপি সেবার মান আরও খারাপ হবে। আমরা সরকারকে এ ধরনের পদক্ষেপ পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানাই। 

কারণ, এতে শুধু ব্যবসার ক্ষতি হবে না, সেবার মান কমবে এবং গ্রাহকদের খরচও বাড়বে।’ কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানো নজিরবিহীন। এর আগে এমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, এই বর্ধিত ভ্যাট ও শুল্ক কম প্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর প্রভাব ফেলবে। কিন্তু এর প্রভাব আখেরে ভোক্তাদের ওপরই পড়বে।

জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি কমেছে: রাজনৈতিক অস্থিরতার বড় প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিতে। গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সময়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে ১ দশমিক ৮১ শতাংশে নেমেছে। এর আগের বছর, অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে একই প্রান্তিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ভঙ্গুর দশাকে তুলে ধরেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে, গত বছর জানুয়ারি মাস থেকে টানা তিন প্রান্তিক ধরেই জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমেছে। 

বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে ২০ শতাংশ: রপ্তানি বাড়লেও আমদানি কমায় বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। চলতি অর্থবছরে পাঁচ মাসে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে কমেছে ১ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার বা ২০ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক লেনদেনে ভারসাম্যের (বিওপি-ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রথম পাঁচ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ৯ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার। এই হিসাবে ঘাটতি কমে (উন্নতির দিকে) ২০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ঘাটতি কমে আসার এই চিত্র অর্থনীতির জন্য স্বস্তির। আমদানির এলসি খুলতেও বাংলাদেশ ব্যাংক কড়াকড়ি কমিয়েছে। কারণ ডলারের সংকট আগের চেয়ে অনেক কমেছে। মূলত ডলারের দর ও দেশের ওপর আস্থা বাড়ার কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলার আসছে বেশি। তাতে বিওপিতেও একধরনের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তিনি বলেন, ডলারের ব্যয় যতটুকু হওয়ার কথা, হিসাব বলছে এর চাইতে বেশি হয়েছে। অর্থাৎ, দেশ থেকে হিসাবের চাইতে বেশি ডলার বাইরে চলে গেছে। সেই ডলার কোথায় গেছে তা সুনির্দিষ্ট নয়।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!