ঢাকা শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪

ভোল পাল্টেও রক্ষা হলো না আরিফের

রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৮, ২০২৪, ০১:০৬ এএম

ভোল পাল্টেও রক্ষা  হলো না আরিফের

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদলের পর ভোল পাল্টেও শেষরক্ষা হলো না বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ‘দেশ টিভির’ ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আরিফ হাসানের। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকার আমলের সুবিধাভোগী আরিফ হাসানের হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তারের পর আদালত তাকে দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। এর আগে গত শনিবার রাতে দেশ ছেড়ে বিদেশে পালানোর সময় বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশ তাকে আটকে দেয়। বিমানবন্দর থানা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়। গত দেড় দশকে আওয়ামী আমলে আঙুল ফুলে বটগাছ বনে যাওয়া তার মালিকানাধীন টেলিভিশনকে অর্থ রোজগারের মেশিনে পরিণত করেছিলেন। 

সংবাদ প্রচারের ভয় দেখিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এমনকি কানাডা-সিঙ্গাপুরসহ বিদেশে হাজার কোটি টাকা পাচারের দুদকের মামলা ধামাচাপা দিতে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বান্ধবীকে অ্যাডভোকেট তৌফিকা করিমকে দেশ টিভির এমডি বানান মিডিয়া মাফিয়া আরিফ হাসান। 

বিগত সরকারের দোসর হয়েও গত ৫ আগস্টের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ পরিবার, আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি, দলটির নেতা-কর্মী ও প্রভাবশালী আমলাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক নেগেটিভ সংবাদ প্রচার করে নিজের অপকর্ম আড়াল করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। তবুও শেষ রক্ষা হলো না, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে আরিফ এখন পুলিশি রিমান্ডে। 

রোববার দুপুরের আগেই আরিফ হাসানকে বিমানবন্দর থানা-পুলিশ মো. সজিব নামের এক যুবককে হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বিমানবন্দর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আবু সাঈদ তাকে তিন দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন। বিকেল ৩টার দিকে শুনানি হয়। অপরদিকে আরিফ হাসানের পক্ষে জামিনের আবেদন করেন অ্যাডভোকেট সৈয়দ জয়নাল আবেদীন মেজবাহ। রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিনের আবেদন করেন তিনি। রাষ্ট্রপক্ষ জামিনের বিরোধিতা করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শাহিন রেজা তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

মামলার কাগজপত্রের তথ্য অনুযায়ী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই বাদীর ছেলে উত্তরার মাইলস্টোন কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্র মো. সজিব বাসা থেকে বের হন। বিকেল ৫টায় তিনি খবর পান, উত্তরা ১ নম্বর সেক্টরের স্কলাস্টিকা স্কুলের সামনে সজীব গুলিবিদ্ধ হয়েছে। সেখানে থাকা তার বন্ধুরা তাকে উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গুরুতর আহত অবস্থায় নিয়ে যায়। সজীব পায়ে ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলিবিদ্ধ হয়। মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, আন্দোলন কমানোর উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ সম্মিলিতভাবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও জনতার ওপর গুলি ছোড়ে। ওই গুলিতেই তার ছেলে গুরুতর আহত হন। গুরুতর আহত ছেলের চিকিৎসা চলতে থাকায় মামলা দায়েরে এত দিন বিলম্ব হয়েছে।

বিমানবন্দর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোস্তাফিজুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, গত ১৯ জুলাই উত্তরা-১ নম্বর সেক্টরের স্কলাস্টিকা স্কুলের সামনে মাইলস্টোনের দশম শ্রেণির ছাত্র মো. সজিব আহমেদকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় তার বাবা মো. সুমন বাদী হয়ে শনিবার দিবাগত রাত ১২টা ৫ মিনিটে হত্যা মামলা করেন। ওই মামলায় ১৫ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও ১৫-২০ জনকে আসামি করা হয়। মামলার আসামি হলেন দেশ টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ হাসান। তিনি দেশত্যাগের চেষ্টাকালে ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে আটক হন। পরে ইমিগ্রেশন পুলিশ বিমানবন্দর থানা-পুলিশের কাছে তাকে হস্তান্তর করে।

জানা গেছে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে কানাডা-সিঙ্গাপুরে হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে দুদক মামলা করলে আরিফ হাসানের ১৫টি ব্যাংক হিসাবে থাকা মোট ৩৪১ কোটি এক লাখ ২১ হাজার ৭৪২ টাকা জব্দের আদেশ দেন সুপ্রিম কোর্ট। এর পরই দেনদরবার করে তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে মোটা অঙ্কের অর্থ ঘুষ লেনদেন করে তদন্ত কার্যক্রম স্থগিত করে রাখেন। আর এসবের মধ্যস্থতা করেন আনিসুল হকের বান্ধবী ও ব্যক্তিগত ক্যাশিয়ার তৌফিকা করিম। বিনিময়ে সাবেক আইনমন্ত্রীর কথিত বান্ধবীকে দেশ টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে বসান আরিফ হাসান।

গত বছরের জুলাইয়ে আরিফ হাসানের ১৫টি ব্যাংক হিসাবে থাকা মোট ৩৪১ কোটি এক লাখ ২১ হাজার ৭৪২ টাকা জব্দের আদেশ দেন সুপ্রিম কোর্ট। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুনানি নিয়ে গত বছরের ১২ জুলাই ওই আদেশ দেওয়া হয়। জানা গেছে, ২০২০ সালে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করার নির্দেশ দেন মহানগর বিশেষ জজ আদালত। ওই আদেশ চ্যালেঞ্জ করে আরিফ হাসান হাইকোর্টে আসেন। সূত্র জানায়, সিঙ্গাপুর-কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে শত শত কোটি টাকা পাচার ও ঋণ জালিয়াতি করেও ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন দেশ টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ হাসান। এই মিডিয়া মাফিয়ার বিরুদ্ধে টাকা পাচার, ঋণ জালিয়াতি আর অবৈধ আয়ের বিষয়টি তদন্ত করে দুদক এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। 

দুদকের সহকারী পরিচালক শফি উল্লাহ তার অবৈধ আয়, ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ পাচারের অনুসন্ধান করেন। অনুসন্ধানে বলা হয়, অভিযুক্ত আরিফ হাসান সংবাদমাধ্যমের পরিচালকের আড়ালে অবৈধ উপায়ে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করে সিঙ্গাপুর, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে পাচারের মাধ্যমে বিনিয়োগ করেছেন। এর মধ্যে শুধু কানাডায়ই ৫০০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। পাচার করা টাকায় কানাডায় গড়ে তুলেছেন বাড়ি। বাড়ি নম্বর ৮২, হলিউড অ্যাভিনিউ। এটি কানাডার এমটুএনথ্রিকেওয়ান নর্থইউয়র্ক, অনটারিওতে অবস্থিত। দুদকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, অভিযুক্ত আরিফ হাসান ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সন্দেহজনকভাবে ছয়বার তার পাসপোর্ট পরিবর্তন করেছেন। এ পর্যন্ত তিনি ১২৮ কোটি সাত লাখ ১৭ হাজার ৯৮৮ টাকার সম্পদ অর্জন করেছেন, যা তার আয়ের সঙ্গে মিল নেই। দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে ঢাকার মহাখালী ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে হাসান টেলিকমের নামে ৩৩৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধান করা হয়।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বান্ধবী তৌফিকা করিমের ছেলে ও মেয়েকে কানাডায় বাড়ি করে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। এখানেই শেষ নয়, দেশ টিভিতে ৪০ ভাগ শেয়ার আছে তার। টিভির বর্তমান এমডি আরিফ হাসান তৌফিকার সঙ্গে যোগসাজশে বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন এবং দুদকে হওয়া মামলাও ধামাচাপা দিয়ে রাখতে সক্ষম হন। যদিও পটপরিবর্তনে ভোল পাল্টে আওয়ামী সরকারের প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে একের পর এক নেগেটিভ সংবাদ প্রচার করে নিজের দোষ ও অপরাধ লুকাতে চেষ্টায় ছিলেন। 

স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার আমলে বিচারাঙ্গনের অঘোষিত ‘নিয়ন্ত্রক’ ছিলেন তৌফিকা। আনিসুল হকের ছোঁয়ায় অনেক অসাধ্য সাধন করেছেন তিনি। উচ্চ আদালত থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিচারিক আদালতেও ছিল তার একচ্ছত্র আধিপত্য। গড়ে তুলেছিলেন বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণের নিজস্ব সিন্ডিকেট। গুরুত্বপূর্ণ মামলায় প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের ইচ্ছামতো রায় ও জামিন করিয়েছেন তৌফিকা করিম। বিনিময়ে লুটে নিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। টাকার বিনিময়ে অনেক চাঞ্চল্যকর মামলার দুর্ধর্ষ আসামিদেরও জামিন করিয়ে দিতেন এই ক্ষমতাধর নারী। অনেক ক্ষেত্রেই ন্যায়বিচার পাননি ভুক্তভোগীরা। তৌফিকার এসব কর্মকাণ্ডে বিচারের বাণী যেন নীরবেই কেঁদেছে এক দশকের বেশি সময়।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!