ঢাকা: রাজধানীর মিরপুরের ‘ডন’ যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা-১৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাইনুল হোসেন খান নিখিল। পুরো ঢাকা মহানগরীর চাঁদাবাজির মূলহোতা ছিলেন স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দোসর এই নেতা। যুবলীগের পদ ব্যবহার করে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের গডফাদার বনে যান বিতর্কিত নিখিল।
ঢাকার ফুটপাতের প্রতিদিনের চাঁদার কোটি কোটি টাকা জমা হতো তার কাছে। যুবলীগ নেতা থেকে এমপি বনে যাওয়া নিখিলের বিরুদ্ধে নগরীর বিভিন্ন স্থানে জোরপূর্বক জমি-বাড়ি দখল করতেন। নিখিল সিন্ডিকেটের অস্ত্রধারী সদস্যদের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ ছিল পুরো রাজধানীবাসী।
চাঁদা না দিলে হামলা-নির্যাতন চলত ফিল্মি স্টাইলে। সবশেষ জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনেও নিখিলের নির্দেশনায় ও অর্থায়নে যুবলীগের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী নেতাকর্মীরা প্রকাশ্য গুলি, হামলা-নির্যাতনে অংশ নেয়। ঢাকা মহানগরীর অবৈধ অস্ত্রের মজুত সিংহভাগ যুবলীগের নেতাকর্মীদের হাতে বলে অভিযোগ রয়েছে।
তবে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন মিরপুরের ‘ডন’খ্যাত নিখিল। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে হত্যাযজ্ঞে সরাসরি জড়িত এবং গুলি করার অন্যতম নির্দেশদাতা নিখিলের বিরুদ্ধে সারা দেশে অগণিত মামলা হয়েছে। তবুও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার হদিস করতে পারেনি।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাতিজা যুবলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি শেখ ফজলে শামস পরশ ও একই কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাঈনুল হোসেন খান নিখিলের নেতৃত্বে রাজধানীতে গড়ে উঠে চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট। চাঁদাবাজির সিংহভাগ অংশ প্রতি মাসে চলে যেত পরশের গোপন আস্তানায়। মূলত বসে বসে চাঁদাবাজির কোটি কোটি টাকার ভাগ নিতেন পরশ। কমিটির বাণিজ্য থেকে শুরু করে যুবলীগের নাম ভাঙিয়ে হওয়া সমস্ত অবৈধ লেনদেন দেখাশোনা করত নিখিল সিন্ডিকেট।
পরশের চাহিদামতো নির্দিষ্ট একটি অংশ পাঠিয়ে দিতেন নিখিল। আর পরশের স্ত্রী সুপ্রিম কোর্টের বিতর্কিত আইনজীবী নাহিদ সুলতানা যুথি টাকাগুলো বুঝে নিতেন বলে দলের মধ্যেই গুঞ্জন ছিল। যুবলীগে মানিকজোড় বলে পরিচিত ছিল পরশ-নিখিল। মূলত পরশের হয়ে নানা অপকর্ম করতেন নিখিল। পরশ শেখ হাসিনার ভাতিজা এবং একই কমিটির সাধারণ সম্পাদক হয়ে নিখিল বলে বেড়াতেন আমি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের হয়ে কাজ করি।
গত দেড় দশক ধরে যুবলীগের নিখিল চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের অত্যাচারে দিশেহারা মিরপুরসহ রাজধানীর ফুটপাতের হকার-ব্যবসায়ীরা। মহানগরীতে বিশেষ করে বৃহত্তর মিরপুর ও তেজগাঁও এলাকায় নিখিলকে চাঁদা না দিয়ে ব্যবসায়ীরা টিকে থাকতে পারত না। বাড়ি নির্মাণ করতে হলেও মোটা অংকের টাকা দিতে হতো তাদের। ব্যক্তি মালিকাধীন বা সরকারি খাসজমি-বাড়ি নিখিল এবং তার অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের নজর পড়লে তা মুহূর্তে দখল হয়ে যেত। দখলের পর থানায় অভিযোগ দিলেও কাজ হয়নি গত সরকারের আমলে।
বরং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলে উল্টো হয়রানি করা হতো জমি-বাড়ির মালিকদের। দেড় দশকে হাসিনা সরকার আমলে প্রভাবশালী নিখিলের সম্পদ বেড়েছে বহুগুণ। ওয়ার্ড নেতা থেকে এমপি বনে যাওয়া নিখিলের এসব সম্পদের অধিকাংশ অবৈধভাবে অর্জিত।
দুদক বা অন্য সংস্থা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সাহস দেখাতে পারেনি। রাজধানীর ফুটপাতকেন্দ্রিক যত ব্যবসা তার সবই যুবলীগের নেতাকর্মীদের দ্বারা চাঁদা তুলত নিখিল সিন্ডিকেট। মিরপুর এবং তেজগাঁওয়ের বিভিন্ন মার্কেটে পজিশন নিতে হলে নিখিলকে দিতে হতো মোটা অংকের টাকা। তার চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দিতে পারত না ভুক্তভোগীরা। রাজনৈতিক কারণে তখনকার পুলিশ কোনো ব্যবস্থাও নিত না।
পতিত আওয়ামী লীগ আমলে নিখিলের প্রত্যক্ষ মদদে চাঙ্গা থাকত ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড। আড়ালে আবডালে মিরপুরসহ ঢাকায় সক্রিয় ছিল শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। বিদেশে পলাতক একাধিক শীর্ষ সন্ত্রাসীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল বলে সূত্রে জানা গেছে। নিখিলের মদদেই সে সময়টা ছিল অস্ত্রের ঝনঝনানি-চাঁদাবাজি নিত্যদিনের ঘটনা। নিখিলের নাম ভাঙিয়ে প্রকাশ্য আধিপত্য বিস্তার করত তাদের অনুসারীরা।
চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি, প্রকাশ্য গোলাগুলি, আধিপত্য বিস্তার, দখলবাজি, মাদক ব্যবসা, টেন্ডারবাজি সবকিছুতেই জড়িত ছিল নিখিল অনুসারী সন্ত্রাসীরা। ফুটপাতের চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে পোশাক কারখানা, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এমনকি ব্যক্তিকেন্দ্রিক চাঁদাবাজি চলত অহরহ। প্রাণের ভয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে না জানিয়ে অনেকেই চাঁদা তুলে দিত নিখিলের পালিত সন্ত্রাসীদের হাতে।
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিখিলের নির্দেশনায় এবং অর্থায়নে যুবলীগের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী নেতাকর্মীরা প্রকাশ্য গুলি, হামলা-নির্যাতনে অংশ নেয়। ঢাকা মহানগরীর অবৈধ অস্ত্রের মজুত সিংহভাগ যুবলীগের নেতাকর্মীদের হাতে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যুবলীগের অস্ত্রধারী নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে ঢাকার একাধিক থানা ও ওয়ার্ড নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছে।
গ্রেপ্তার অধিকাংশ অস্ত্রধারীরা নিখিল সিন্ডিকেটের সদস্য। তারাই চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং সর্বশেষ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ঢাকার বিভিন্ন স্পটে হামলা-নির্যাতন ও গুলি চালিয়েছে। মূলত যুবলীগের অস্ত্রধারী নেতাকর্মীদের হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়েছে। আহত হয়েছে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার যুবলীগের নেতাকর্মীরা রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিলের নির্দেশে অস্ত্র হাতে হামলায় অংশ নেন। তাদের অর্থায়নও করেছেন নিখিল। রাজধানীতে চাঁদাবাজির টাকা আন্দোলন দমাতে ব্যবহার করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যুবলীগের অস্ত্রধারী নেতাকর্মীদের ধরতে চিরুনি অভিযান চালাচ্ছে নিয়মিত।
মূলত ঢাকার রাস্তার পাশে ব্যবসা করতে গেলে কয়েকটি ধাপে চাঁদা ও ঘুষ দিয়েই ব্যবসা করতে হয়। এটা আওয়ামী লীগের আমলে নিয়মে পরিণত হয়েছিল। বিশেষ করে ফুটপাতে চাঁদাবাজিতে জড়িত ছিল যুবলীগের নেতাকর্মীরা। আর এর নেতৃত্ব দিত দলটির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নিখিল। কোনো কারণে ব্যবসা বন্ধ থাকলেও নিখিল সিন্ডিকেটকে চাঁদা দিতে হতো।
সে সময় থানা, পুলিশ, লাইনম্যান, ঝাড়ুদার, সোর্স এবং এলাকার বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের আলাদা আলাদা করে টাকা দিতে হতো। কেউ দিন হিসেবে আবার কেউ সপ্তাহ হিসেবে এসব টাকা আদায় করত। কিছু কিশোর ও উঠতি বয়সী যুবকদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিটি দোকানে চাঁদাবাজি করত নিখিলের যুবলীগের নেতাকর্মীরা। তাদের চাঁদা না দিলে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হতো। এরা প্রত্যেকে এলাকা ভাগ করে চাঁদা আদায় করত। কেউ দিতে না চাইলে সবাই একসঙ্গে গিয়ে হামলা চালাত। তাদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করলেও পুলিশ কোনো পদক্ষেপ নিত না। ফলে সন্ত্রাসীরা আরও বেপরোয়া হয়ে যেত।
মিরপুর, কারওয়ান বাজার এলাকায় আগের মতোই ফুটপাতের দোকান থেকে লাইনম্যানই চাঁদা তুলছে। শুধু আগের সরকারের প্রভাবশালী নিখিলের নাম ব্যবহার হচ্ছে না। তার অনুসারীরা ভোল পাল্টে আগের সরকারের বিরোধীপক্ষের নেতাদের পরিচয় দিচ্ছে। রাজধানীর ব্যস্ততম তেজগাঁও এলাকার ট্রাকস্ট্যান্ড ঘিরে মাসে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতেন পলাতক সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং মাইনুল হোসেন খান নিখিলের যুবলীগের অনুসারী নেতাকর্মীদের সিন্ডিকেট সদস্যরা।
কামাল-নিখিলের অনুসারীরা দোকান দখল, গাড়িপ্রতি চাঁদা আদায়, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করা হতো এই ট্রাকস্ট্যান্ড ঘিরে। আগে কামাল-নিখিলের মদদে ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মগবুল হোসেন, ট্রাক ড্রাইভার্স ইউনিয়নের সভাপতি মনির তালুকদার ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাশেম গংয়ের নেতৃত্বে চাঁদাবাজি হতো। বর্তমানে চাঁদাবাজদের মুখ বদল হয়েছে। তবে প্রকাশ্যে না হলেও তারা নীরবে চাঁদা তুলছে।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে এখন ট্রাকস্ট্যান্ডের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের শীর্ষ এক নেতা। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরও বন্ধ হয়নি চাঁদাবাজি। শুধু পরিবর্তন হয়েছে মূলহোতা। তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডের মতোই অবস্থা দেশের সব স্থানে। চাঁদা নেওয়ার লাইনম্যান অব্দি একই রয়েছে। পরিবর্তন হয়েছে কেবল চাঁদা গ্রহীতা বা মূলহোতা। ফুটপাত, গার্মেন্ট, দোকান, স্ট্যান্ডসহ কোথাও বন্ধ নেই চাঁদাবাজি। অভিযোগ রয়েছে, চাঁদার একটি অংশ এখনো কামাল-নিখিলের কাছে চলে যায়।
পরশ-নিখিল যুবলীগের নেতৃত্বে আসার পর ঢাকা মহানগর বা জেলা-উপজেলায় নতুন কমিটি দেওয়ার নামে অধিকাংশ পদ বিক্রি হতো। পদ বিক্রির টাকা সংগ্রহ করত নিখিল সিন্ডিকেট। আর ভাগাভাগি হতো পরশের সঙ্গে। ঘুষ ছাড়া বহু জেলায় বহু বছর যুবলীগের সম্মেলন বা নতুন কমিটি না হওয়ায় সংগঠনটির শীর্ষ পদে থাকা অনেক নেতা আওয়ামী লীগের কমিটিতে চলে গেছেন।
কেউ দেশের বাইরে চলে গেছেন এবং কেউ মারা গেছেন। দীর্ঘ সময়ে নতুন কমিটি গঠিত না হওয়ায় নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। নতুন কমিটি না হওয়ায় দলীয় কার্যক্রমেও স্থবিরতা ছিল। মাইনুল হোসেন খান নিখিলের উত্থান ও পতন, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের এক নজিরবিহীন ঘটনা। তার বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ড দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক কালো দাগ হয়ে থাকবে।
কে এই নিখিল?
নিখিলের জন্ম চাঁদপুরে হলেও ঢাকায় দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে সক্রিয়। তৃণমূল থেকে উঠে আসা ৬০ বছর বয়সী এই রাজনীতিক বৃহত্তর লালবাগ থানা ছাত্রলীগের সক্রিয় সদস্য হিসেবে রাজনীতিতে জড়ান। ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে ১৯৮৭ সালে তিনি যুবলীগে যোগ দেন। তৎকালীন ৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের একটি আহ্বায়ক কমিটিতে যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন।
১৯৯৩ সালে তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। সেই সময় যুবলীগের চেয়ারম্যান ছিলেন শেখ ফজলুল করিম সেলিম। ২০০১ সালের দিকে তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হন। ২০১২ সালে ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
২০১৯ সালের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। সর্বশেষ তিনি ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ঢাকা-১৪ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
আপনার মতামত লিখুন :