ঢাকা: ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি, কমিটি বাণিজ্য ও দুর্নীতির অভিযোগে ওমর ফারুক চৌধুরী-হারুনুর রশীদকে সরিয়ে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার ভাতিজা শেখ ফজলে শামস পরশকে যুবলীগের চেয়ারম্যান করা হয় ২০১৯ সালে। এত দিন রাজনীতি থেকে দূরে থাকা পরশ একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। যদিও আগে থেকেই পরশের ছোট ভাই তাপস ঢাকা দক্ষিণের দাপুটে মেয়র ছিলেন।
যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকেই পরশের স্ত্রী সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নাহিদা সুলতানা যূথী ক্ষমতার দাপট দেখানো শুরু করেন। আদালতপাড়ায় ক্ষমতা প্রদর্শনের পাশাপাশি যুবলীগের রাজনীতির প্রধান নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন।
যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আলাদা কক্ষ দখল করে ঢাকাসহ সারা দেশের জেলা-উপজেলা কমিটি গঠনের নামে পদ বিক্রি, কমিটি বাতিল, দখলবাজি-চাঁদাবাজির সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। বিত্তশালীদের টার্গেট করে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে যুবলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের পদ দেওয়ার প্রলোভন দিতেন।
কেউ কেউ প্রত্যাশিত পদ পেলেও অনেকে পদ পেতেন না, পদ না পেলেও টাকা ফেরত পেতেন না তারা। টাকা ফেরত চাইতে গেলে মামলা-নির্যাতন ও হুমকির শিকার হতেন। শেখ পরিবারের বউ হওয়ার সুবাধে বিতর্কিত আইনজীবী নাহিদা সুলতানা যূথী আদালতপাড়ায় জামিন বাণিজ্য করে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
এমনকি যুবলীগের ক্ষমতার অপব্যবহার করে জোর করে হতে চেয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সেক্রেটারি। ইতিমধ্যে যূথীর জামিন বাণিজ্য ও পদ বিক্রির মাধ্যমে গড়ে তোলা সম্পদ এবং বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগে দুদক অনুসন্ধান শুরু করেছে। যদিও স্বামী-স্ত্রী দুজনই গত জুলাইয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।
‘ম্যাডাম যুবলীগ’ নামে পরিচিত যূথী আদালতপাড়ায় নিজের অনুসারীদের নিয়ে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। পরশ যুবলীগের চেয়ারম্যান থাকাকালীন কার্যত যুবলীগের অঘোষিত চেয়ারম্যান ছিলেন যূথী। তিনি নিজেকে রাজরানি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
যুবলীগের যেকোনো কাজ যূথীর অনুমতি ছাড়া হতো না। স্ত্রীর নানান অনিয়মের বিরুদ্ধে শেখ ফজলে শামস পরশও প্রতিবাদ করার সাহস পেতেন না। চেয়ারম্যানের স্ত্রী হওয়ার সুবাদে যুবলীগের নেতাকর্মীরা তাকে সমীহ করলেও তিনি তাদের সঙ্গে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করতেন।
যুবলীগের প্রভাব খাটিয়ে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থ হাসিল করতেন তিনি। যুবলীগের নেতাকর্মীরা যূথীর কথার বাইরে যেতে পারতেন না। তাদের দিয়ে নানান অপকর্ম করাতেন তিনি। গত পাঁচ বছরে চাঁদাবাজি-দখলবাজিতে ব্যবহার করেছেন যুবলীগকে।
রাজনীতিতে আসার আগে ক্লিন ইমেজের শেখ পরশ তারই কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল এবং স্ত্রী যূথীর দুর্নীতি ও দাপটের কাছে ছিলেন অসহায়। পরশের চেয়ে বেশি বয়সি যূথী তার স্বামীর পদমর্যাদাকে শোষণ করেছেন, রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে নস্যাৎ করেছেন।
ঢাকা মহানগরীর ফুটপাতের চাঁদাবাজিসহ বিভিন্নভাবে অবৈধ অর্থ নিখিল সিন্ডিকেটের কাছ থেকে সপ্তাহে বা মাসে বুঝে নিতেন যূথী। তার এজেন্ট হিসেবে কাজ করত বেশ কয়েকজন। বিভিন্ন জেলা-উপজেলার যুবলীগের নেতাকর্মীদের ঢাকায় এনে ডোনেশন নেওয়ার ব্যবস্থা করাই ছিল এজেন্টদের কাজ। যুবলীগের কমিটিতে নাম রাখার আশ্বাস দিয়ে অনেকের কাছে থেকেই ঘুষ নিতেন তিনি। টাকা নিয়ে কাক্সিক্ষত পদ না দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। কোনো পদের জন্য যে বেশি টাকা দিতেন, তিনিই পেতেন কাক্সিক্ষত পদ। টাকা দিয়ে কাক্সিক্ষত পদ না পেলেও ‘টুঁ-শব্দ’ করার সাহস ছিল না কারও। প্রশ্ন করলেও গালি-হুমকি দিতেন যুবলীগের চেয়ারম্যানের স্ত্রী।
নাহিদ সুলতানা যূথীর উত্থান মূলত গত পাঁচ বছর স্থায়ী ছিল। দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে কানাডা-যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ পাচার করেছেন। পরশ যুবলীগের চেয়ারম্যান হওয়ার আগে সুপ্রিম কোটের আইনজীবী হিসেবে তেমন নামডাক ছিল না।
২০১৯ সালের পর থেকে নজিরবিহীনভাবে তার উত্থান ঘটে। পতন হয়েছে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে স্বৈরাচার হাসিনার পতন এবং ভারতে পলায়নের মধ্য দিয়ে। গত জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে যূথী কানাডায় যান, পরে যুক্তরাষ্ট্রে।
অন্যদিকে, তার স্বামী শেখ পরশ বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। ৫ আগস্ট সরকারের পতনের আগে বা পরে কোনো এক সময় গোপনে ভারতে চলে যান বলে গোয়েন্দা সূত্র জানায়। পরশ ভারত থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত যূথীর কাছে চলে যাওয়ার কথা রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা শেখ ফজলে শামস পরশ একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। ২০১৯ সালে যুবলীগের চেয়ারম্যান হওয়ার আগে তাকে কখনো রাজনীতির মাঠে দেখা যায়নি। তার বাবা শেখ ফজলুল হক মনি যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা বলে পরশকে এই সংগঠনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
অবৈধ ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান শুরুর পর ভিত কেঁপে ওঠে যুবলীগের। যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটসহ কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করার পর একপর্যায়ে সংগঠনের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় শেখ সেলিমের ভগ্নিপতি ওমর ফারুক চৌধুরীকে।
চেয়ারম্যান হওয়ার আগে পরশ ক্লিন ইমেজের হলেও স্ত্রী নাহিদা যূথী এবং পলাতক সাবেক এমপি মাইনুল হোসেন নিখিলের চাঁদাবাজি, দুর্নীতি এবং কমিটি বাণিজ্যকে সমর্থন দিয়ে নিজেও অপকর্ম-অপরাধে শামিল হন।
জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হত্যাযজ্ঞের উস্কানিদাতার অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে সারা দেশে। বিভিন্ন সময়ে সভা-সমাবেশে বা গণমাধ্যমে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। পরশ-নিখিলের সরাসরি নির্দেশ-অর্থায়নে যুবলীগের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী নেতাকর্মীরা প্রকাশ্য হত্যাযজ্ঞ চালান।
সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে ‘কলঙ্কজনক অধ্যায়’ রচনা করেন অঘোষিত যুবলীগ চেয়ারম্যান নাহিদ সুলতানা যূথী। গত মার্চে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ২০২৪-২৫ সালের নির্বাচনে স্বামীর প্রভাব খাটিয়ে, ভয়ভীতি দেখিয়ে এবং গায়ের জোরে সাধারণ সম্পাদক হতে চেয়েছিলেন। প্রথমে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের প্যানেল থেকে মনোনয়ন চান, না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন।
নির্বাচনে ভোটে পরাজিত হলেও অস্ত্র প্রদর্শন, মারধর, ভয়ভীতি দেখিয়ে আইনজীবীদের মতো ইউনিফর্ম পরিয়ে যুবলীগ নেতাকর্মীদের ব্যবহার করে নিজেকে জয়ী ঘোষণা করান। একপর্যায়ে যুথী নিজে অস্ত্রের মুখে নির্বাচন সাব-কমিটির প্রধান বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আবুল খায়েরকে ভোট গণনা ছাড়াই সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত ঘোষণা করার জন্য বাধ্য করেন। পরে গত ৮ মার্চ রাতে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির দুই দিনব্যাপী নির্বাচনে ভোট গণনাকে কেন্দ্র করে হট্টগোল, হাতাহাতি ও মারামারির ঘটনায় রাজধানীর শাহবাগ থানায় মামলা দায়ের করা হয়।
সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সাইফুর রহমান চৌধুরী সাইফ বাদী হয়ে তাকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে এ মামলা করেন। ওই দিন রাতেই যূথীর গুলশানের বাসায় অভিযান চালায় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। সেখান থেকে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও যূথীকে বাসায় পাওয়া যায়নি বলে ডিবি জানায়।
তৎকালীন ডিবিপ্রধান হারুন-অর-রশিদের সহায়তায় তিনি বাসায় থেকেও গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হন। অবশ্য সে সময় ডিবি জানায়, অভিযানের সময় পালিয়ে গিয়েছিলেন যূথী। গত ১২ মে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আত্মসমর্পণ করে মুচলেকায় জামিন পান তিনি।
পাবনার মেয়ে অ্যাডভোকেট যূথীর বাবা অধ্যাপক আবু সাঈদ। যূথীর বাবা এবং পরিবারের সদস্যদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই। পাবনায় জন্ম হলেও যূথী বড় হন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় তার নানাবাড়িতে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে যূথী রাজধানীতে বসবাস শুরু করেন। উল্লাপাড়ায় নানাবাড়ির প্রতিবেশীদের জমি দখল করে বিলাসবহুল বাড়ি তৈরি করেন। অবশ্য শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর উত্তেজিত জনতা ভাঙচুর করে ও আগুন দেয় বাড়িটিতে।
আপনার মতামত লিখুন :