ঢাকা শুক্রবার, ১০ জানুয়ারি, ২০২৫

শুল্কহার বৃদ্ধিতে মূল্যস্ফীতি ও কর্মহীনতার আশঙ্কা

শাহীনুর ইসলাম শানু

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১০, ২০২৫, ০১:০৩ এএম

শুল্কহার বৃদ্ধিতে মূল্যস্ফীতি ও কর্মহীনতার আশঙ্কা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

শিল্প খাতে গ্যাসের দ্বিগুণ মূল্য বাড়ানো হবে। নতুনভাবে ইন্টারনেট ও মুঠোফোন সেবায় করের আওতা বাড়ছে। একই সঙ্গে হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলোতে ভ্যাটের হার বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অন্যদিকে ১৩ বছরের মধ্যে শীর্ষে থাকা দেশের মূল্যস্ফীতির সময়ে ব্যয় সামাল দিতে পারছে না নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। এই সময়ে এনবিআর ৪৪টি পণ্যের শুল্কহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আইএমএফের শর্ত মানতে গিয়ে সরকারের এমন সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই), বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি ও টেলিকনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টিক্যাব)। এমন সিদ্ধান্তে মানুষ আরো নিষ্পেষিত হবে। নিত্যপণ্য ও সেবার মূল্য বৃদ্ধির কারণে নতুন করে কর্মহীনতার আশঙ্কা করেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। 
এদিকে, পরিকল্পনা কমিশন চত্বরে এনইসি সম্মেলন কক্ষে গত বুধবার পরিকল্পনা কমিশনের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি এখনো অনেক বেশি। যারা মজুরি করে তাদের কষ্ট বাড়ছে। দেশে ৯ শতাংশ বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি হলেও কষ্টকর।’


তিনি আরো বলেন, ‘অন্যদিকে রাজনীতিক চর্চা ভালো অবস্থানের দিকে যাচ্ছে। এতে অর্থনীতি কিছুটা চাঙ্গা হবে। আমাদের জন্মহার যেভাবে হচ্ছে, সেভাবে কর্মক্ষমতাও বাড়ছে। তবে করোনাকালের পর থেকে অনেকে কর্মসংস্থান পাচ্ছেন না। ডেমোগ্রাফি ডেভিডেন্ড কাজে লাগছে না।’


১৩ বছরের শীর্ষে থাকা দেশের মূল্যস্ফীতি সামাল দিচ্ছে বাংলাদেশ। এমন সময়ে শিল্পে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে বড় মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা করছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)। নতুন করে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি করা হলে পণ্যের দাম বাড়বে। এসব পণ্যের মান সঙ্কুচিত হওয়ার পাশাপাশি বাণিজ্যের পরিবেশ স্থিতিশীলতা হারাবে। যার ফলে বাণিজ্য ও বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে জানিয়েছে ডিসিসিআই।


পেট্রোবাংলার প্রস্তাব: অন্তর্বর্তী সরকারের পরিচালন ফি সামাল দিতে বিভিন্ন করারোপনীতি আরোপ করছে এনবিআর। একই সঙ্গে বর্ধিত আকারে গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ হচ্ছে। সরকারের শিল্প খাতে ব্যবহারযোগ্য প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৩০ টাকা ও ৩১ টাকা ৫০ পয়সা। সেই গ্যাসের মূল্য দ্বিগুণের বেশি ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব দিয়েছে পেট্রোবাংলা। 


এমন সিদ্ধান্তের জেরে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে পণ্যের মূল্য বাড়বে। পরিণামে মূল্যস্ফীতি বাড়বে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারণে দীর্ঘমেয়াদি কর সুবিধার পাশাপাশি নীতি ধারাবাহিকতার প্রতিশ্রুতি রক্ষার মাধ্যমে স্থিতিশীল ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ বজায় রাখা আবশ্যক বলে মনে করছে তারা।


ঢাকা চেম্বার বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গতকাল জানিয়েছে, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত না করেই দাম দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধির প্রস্তাব নিঃসন্দেহে দেশের শিল্প খাতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে ব্যবসার ব্যয় কয়েক গুণ বাড়বে। বর্তমান পরিস্থিতিতে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে সামগ্রিক বিনিয়োগের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে যেমন নতুন শিল্প স্থাপনের সম্ভাবনা কমবে, তেমনি বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের ব্যবসা পরিচালনা বিঘ্নিত হবে। দুর্বল হবে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা; কমবে স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ।

এনবিআরের শুল্ককর বাড়ানোর প্রস্তাব: মূল্যস্ফীতির কারণে গ্রামে বা শহরে পণ্যের ব্যয় সামাল দিতে পারছে না নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। সেই সময়ে এনবিআর ৪৪টি পণ্যের শুল্কহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া আরো ৪৩টি পণ্যের ভ্যাট ও শুল্ককর দ্বিগুণ করার উদ্যোগের পাশাপাশি মোটরসাইকেল, রেফ্রিজারেটর, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) ও কম্প্রেসর শিল্পের আয়কর ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।
এ ছাড়া দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিদ্যমান নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে মোটরসাইকেল, রেফ্রিজারেটর, এয়ারকন্ডিশনার ও কম্প্রেসর নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের করহার দ্বিগুণ করার সিদ্ধান্ত উদ্বেগজনক বলে মনে করছে ডিসিসিআই। এসব খাতের প্রতিশ্রুত কর-সুবিধা ২০৩২ সাল পর্যন্ত বহাল থাকার কথা থাকলেও তা হঠাৎ করে পরিবর্তন করা হলে তা বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।


মুঠোফোনে বাড়ছে শুল্ক: মুঠোফোন সেবার ওপর নতুন করে ৩ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করতে যাচ্ছে সরকার। আওয়ামী লীগ সরকার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মুঠোফোন সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণ করে। 
ফলে মোবাইল ইন্টারনেট ও টকটাইমের ওপর মোট ৩৯ শতাংশ কর দিচ্ছে মানুষ। আরও ৩ শতাংশ বৃদ্ধি করা হলে ৪২ শতাংশে উন্নীত হবে। একজন গ্রাহক ১০০ টাকা মোবাইল রিচার্জের বিপরীতে ৩৯ টাকা পরোক্ষ কর দিয়ে কার্যকরভাবে ৬১ টাকার সেবা গ্রহণ করেন। কর বৃদ্ধির পর, গ্রাহক ১০০ টাকা রিচার্জের বিপরীতে ৫৮ টাকার সেবা পাবেন বলে জানিয়েছে টেলিকনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টিক্যাব)।

 
রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির আহ্বান: হোটেল-রেস্তোরাঁয় ভ্যাটের হার বাড়ানোর পরিকল্পনা এনবিআরের। বর্তমানে সাধারণ মানের এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) রেস্তোরাঁয় খাওয়ার জন্য ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। এটি বেড়ে সাড়ে ৭ শতাংশ হতে পারে। এ ছাড়া নন-এসি হোটেলের ভ্যাট ৭.৫ শতাংশ থেকে দ্বিগুণ করে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।


নতুন ভ্যাটের হার বাড়ানোর পরিকল্পনা থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি। একই সঙ্গে ভ্যাট বাড়ানোর পরিকল্পনা থেকে সরে না এলে অনির্দিষ্টকালের জন্য রেস্তোরাঁ বন্ধের হুমকি দিয়েছে সংগঠনটি। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে এই আহ্বান জানায় সংগঠনটি। 


সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, দুই বছরের বেশি সময় ধরে যেখানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। সেখানে অন্তর্বর্তী সরকার করের আওতা না বাড়িয়ে বা কর ফাঁকি রোধ করার ব্যবস্থা না করে অর্থবছরের মাঝামাঝি হঠাৎ তিন গুণ ভ্যাট বাড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর।


৭০ শতাংশ রেস্তোরাঁ এখনো ভ্যাটের আওতার বাইরে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রশাসনের ব্যয় কমিয়ে ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিয়ে সরকার ঘাটতি মেটাতে পারে। আইএমএফ-এর শর্ত মানতে গিয়ে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির মতো দেশের জনগণের ওপর ইচ্ছামতো করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া কোনো পূর্ণাঙ্গ সমাধান হতে পারে না।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!