বাঁচানো গেল না ধর্ষণের শিকার মাগুরার সেই শিশুটিকে। সপ্তাহখানেকেরও বেশি সময় ধরে ঠিকানা ছিল হাসপাতালের বিছানা। শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কাছে হেরে গেল শিশুটি। চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে মেয়েটি চলে গেল চিরতরে।
বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে গত ৬ মার্চ ধর্ষণের শিকার হয় শিশুটি। শুধু তাই নয়, ধর্ষণের পর শিশুটিকে গলা টিপে হত্যার চেষ্টা করা হয়। এ ঘটনার এক সপ্তাহেরও কম সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে একই বয়সের কাছাকাছি অন্তত তিনটি শিশুর ধর্ষণের খবর গণমাধ্যমে এসেছে, যেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কেউ ধর্ষণের শিকার শিশুর প্রতিবেশী, আবার কেউ নিকটাত্মীয়।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের শিকার হয় পরিচিতদের দ্বারাই। শতকরা প্রায় ৮৫ ভাগ ক্ষেত্রেই নির্যাতনকারীরা ভুক্তভোগী শিশুর পরিচিত। সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনায় ভাবিয়ে তুলছে সচেতন সমাজকে।
অব্যাহত ধর্ষণের প্রতিবাদে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে সারা দেশে। প্রতিবাদে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চলছে বিক্ষোভ। বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও সমাজবিজ্ঞানী এবং নারী-শিশু অধিকার নিয়ে কর্মরত ব্যক্তিরা বলছেন, বিচারহীনতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া, নৈতিক অবক্ষয়, সাইবার দুনিয়ার প্রতি নিয়ন্ত্রণহীন আসক্তির কারণে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিচারব্যবস্থা ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া নির্যাতন না কমার বড় কারণ। আবার অনেকে বলছেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথেষ্ট সক্রিয় না হওয়ায় সেই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অপরাধী চক্র।
নারী ও শিশু এখানে বড় টার্গেটে পরিণত হয়েছে। বড়দের লালসার কাছে হেরে যায় কোমলমতি শিশুর সুন্দর পৃথিবী। তবে সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, আগামী রোববারের মধ্যে ধর্ষণ প্রতিরোধে নতুন আইন হচ্ছে। এ ছাড়া আলাদা ট্রাইব্যুনালও গঠন করা হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির ২৮ দিনে ধর্ষণের অভিযোগে দিনে গড়ে ১২টি মামলা হয়েছে। আগের বছরের ফেব্রুয়ারির ২৯ দিনে এই সংখ্যা একই ছিল।
গত বছর সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ১৭ হাজার ৫৭১টি মামলা হয়েছে। এই আইনে এ বছরের জানুয়ারি মাসে মামলা হয়েছে ১ হাজার ৪৪০টি। গত বছরের জানুয়ারিতে এই সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪৩।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিস কেন্দ্র (আসক) তথ্য মতে, গত মাসে শুধু শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩০টি। এর মধ্যে ৬ বছরের নিচে শিশুর ওপর অবিচারের ঘটনা ঘটেছে ৭টি। এর আগের মাসে জানুয়ারিতে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৫টি।
সংস্থাটির এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে ধর্ষণের শিকার ৪০১ জন নারী-শিশু। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২৩৪ জন শিশু, ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ২০২ জন শিশু এবং বলাৎকারের শিকার হয়েছে ৩৬ ছেলে শিশু।
শিশু ধর্ষণের মধ্যে ১৬৫ জনের বয়স ১৮ বছরের মধ্যে। বাকি ৪৫ জনের বয়স ১৮ বছরের বেশি। আর ১৯১ জনের বয়স নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সেই হিসাবে ধর্ষণের শিকার ৭৯ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের মধ্যে অর্থাৎ শিশু। গত বছর ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৪ জনকে। আর ধর্ষণের লজ্জা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে সাতজন।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, সামাজিক ও আইনি কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ায় অপরাধের ওপর নিয়ন্ত্রণ কমে যাচ্ছে। ফলে নারী ও শিশু নির্যাতন বাড়ছে। নির্যাতনের চিত্র আগের ধারাতেই রয়েছে।
২০২০ সালের গবেষণায় দেখা গেছে, নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে হওয়া মামলায় বিচারের হার শূন্য দশমিক ৪২ শতাংশ। এটা খুব উদ্বেগজনক চিত্র। এমন বিচারব্যবস্থা ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া নির্যাতন না কমার বড় কারণ।
আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘ধর্ষণ প্রতিরোধে নতুন আইন প্রাথমিক ধাপে আছে। রোববারের মধ্যে নতুন আইন হয়ে যাবে। আইনে শিশু ধর্ষণ এবং বলাৎকারের জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে।’
বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে দেশে অন্তত ৬ হাজার ৩০৫ জন নারী-শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে তিন হাজার ৪৭১ জন ১৮ বছরের কম বয়সি শিশু রয়েছে।
চলতি বছরের গত দুই মাসে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে কমপক্ষে ১০৭ জন। যাদের মধ্যে ৬৬ জন ১৮ বছরের কম বয়সি শিশু রয়েছে। এ সময় ২২৪ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
নারী-শিশু অধিকার নিয়ে কর্মরত ব্যক্তিরা বলছেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতিই কুরে কুরে খাচ্ছে মনুষ্যত্ব। নারী কখনো বাইরে, কখনো ঘরে-কর্মস্থলে আবার কখনো নিজ পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনেরই লোলুপ দৃষ্টির শিকার। কুৎসিত থাবায় পাল্টে যাচ্ছে পুরো জীবনটাই।
সরকারের প্ল্যানিং কমিশনের সাবেক ডিভিশন চিফ ও নারী অধিকার আন্দোলনের সভানেত্রী মমতাজ মান্নান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বিচারহীনতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ার কারণে ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজগুলো দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুত হয় ও দণ্ড দ্রুত কার্যকর করা হয়Ñ সেই ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আমরা জোরালো দাবি জানাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের নির্যাতনের শিকার না হতে হয়, নির্যাতন কমে আসে এবং নারী ও কন্যাশিশু সুস্থ ও নিরাপদ ভ্রমণ করতে পারে সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম সাংবাদিকদের বলেন, যেকোনো রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রাকৃতিক অস্থিরতার সময় নারী ও শিশুর প্রতি যৌন-সন্ত্রাস বাড়ে। এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক।
৫ আগস্টের পর অনেক কয়েদি পালিয়েছেন। এখন নারীবিদ্বেষী প্রচারও বাড়ছে। আর বিচার না হওয়ার দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি তো এ দেশে রয়েছেই। এ সুযোগগুলো নিচ্ছে অপরাধীরা। শুধু নারী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ অপরাধ প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে না। সবাইকে সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ করতে হবে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক নিবন্ধে উঠে এসেছে, ‘শতকরা প্রায় ৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই যৌন নির্যাতনকারীরা শিশুর পরিচিত। হয় তার আত্মীয়, বন্ধু বা বিশ্বস্ত কেউ।’ শিশুদের ওপর হওয়া যৌন নিপীড়ন নিয়ে ২০২০ সালে প্রকাশিত ‘চাইল্ড সেক্সুয়াল এবিউজ ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের গবেষণায়ও বলা হয়েছে, দুর্বৃত্তরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীর পরিচিত কেউ থাকেন।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে শিশুদের নির্যাতনের শিকার হওয়ার বিষয়টি নতুন কিছু না। এটা সব সময় শিশুদের জীবনের বাস্তবতা।
তিনি বলেন, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলেও তা কার্যকরের নজির কম। শিশুদের প্রতিবাদ করার সক্ষমতা ও সাহস থাকে না, ফলে সহজ টার্গেট হয় তারা। যারা ধর্ষণের শিকার হয়, তারা ব্যক্তিগত সুরক্ষা, আইনি সুরক্ষা পান না। আইনের কঠোর প্রয়োগ ছাড়া এসব ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। সামাজিক অনুশাসন ও আইন প্রয়োগের পাশাপাশি দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচার করতে হবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পুলিশের কাছে গিয়ে প্রতিকার না পেলে সংশ্লিষ্ট পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলেন, ধর্ষণের ও যৌন নির্যাতনের বেশির ভাগ ঘটে পরিচিতজন ও স্বজনদের দ্বারা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী অভিযোগ করে না। আবার অভিযোগ করলেও মামলার আলামত ও সাক্ষী থাকে না। ধর্ষণের ঘটনার একটি বড় অংশের আসামি পার পেয়ে যায়।
লোকলজ্জা ও ভয়ে অধিকাংশ ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষিতাকেই দায়ী করা হয়। ধর্ষক প্রভাবশালী হলে পার পেয়ে যায়। টাকা দিয়েও মীমাংসা করা হয়। গত ২ মার্চ মুন্সীগঞ্জে ৮ ও ১০ বছর বয়সি দুই শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে ৬৫ বছর বয়সি সেকান্দোর আলী চোকদারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
পুলিশ জানায়, সেকান্দোর ২ মার্চ বিকেলে ওই দুই শিশুকে খাবার ও বেলুন কিনে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে নির্জন স্থানে নিয়ে ধর্ষণ করে। গত শনিবার শেরপুরের নকলায় বিস্কুট দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ৬ বছরের এক শিশুকে ভুট্টা খেতে নিয়ে ধর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায় ধর্ষক চান মিয়া ওরফে লছাকে (৬০) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
গত ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের দিনেই শ্রীপুরে একটি শিশুকে জঙ্গলে টেনে নিয়ে ধর্ষণ করে আবার ধর্ষণের দৃশ্য মোবাইল ফোনে ভিডিও করে তা বন্ধুদের সরবরাহ করে এক লম্পট।
একই দিনে ঠাকুরগাঁওয়ে পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তার হন তারই শিক্ষক মোজাম্মেল হক। ওই রাতেই ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জে চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক নারী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন।
মাগুরায় শিশু ধর্ষণের প্রতিবাদে সারা দেশে যখন আন্দোলন হচ্ছে, এরই সপ্তাহেরও কম সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে একই বয়সের কাছাকাছি অন্তত তিনটি শিশু প্রতিবেশী, নিকটাত্মীয় কিংবা পরিচিতজনদের হাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। গত মঙ্গলবারও স্কুল ভ্যানে খেলারত ৭ বছরের দুই শিশুকে গণধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগে দিনাজপুরের বিরামপুরে মামলা হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :