চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগে শহর রেঞ্জ কর্মকর্তা বাচ্চু মিয়া। বন বিভাগে এখন সবাই তার নাম দিয়েছে বন বিভাগের ‘জল্লাদ’ বাচ্চু। বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের উত্তর বন বিভাগের শহর রেঞ্জ কর্মকর্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের দায়িত্বে রয়েছেন এই বাচ্চু। অফিসের দাপ্তরিক কাজ এবং হিসাব খাতও রয়েছে তার নিয়ন্ত্রণে।
বন বিভাগের গঠিত বিশেষ টহল দলের ওসির দায়িত্বেও তিনি। যোগদানের পর থেকে বন সংরক্ষক (চট্টগ্রাম অঞ্চল) মোল্লা রেজাউল করিমের আশকারায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। একাধিক দায়িত্বশীল সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের শহর রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. বাচ্চু মিয়া গত জানুয়ারি মাসে যোগদান করেন। প্রায় ৩০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে লোভনীয় এই পোস্টিং বাগিয়ে নিয়েছেন।
ওই স্থানে পোস্টিংয়ের জন্য বিনিয়োগ করা টাকার ভাগবাটোয়ারা করেছেন চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কায়সার, সহকারী বন সংরক্ষক জয়নাল আবেদীন ও বন সংরক্ষক মোল্লা রেজাউল করিম।
একাধিক সূত্রে আরও জানা গেছে, শহর রেঞ্জ কর্মকর্তা ও বিশেষ টহল দলের ওসির দায়িত্ব নিতে বিনিয়োগকৃত বিশাল অঙ্কের টাকা উত্তোলন করতে জল্লাদের ভূমিকা পালন করছেন বাচ্চু মিয়া।
ঘুষ দিয়ে পোস্টিংয়ের জন্য খরচ করা বিপুল অঙ্কের এই টাকা উত্তোলনের জন্য বেপরোয়া চাঁদাবাজি শুরু করেছেন ধূর্ত এই শহর রেঞ্জ কর্মকর্তা। বেপরোয়া চাঁদাবাজির জন্য শহর রেঞ্জে একটি নিজস্ব সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। এই সিন্ডিকেট সদস্যদের নামও উন্মোচন করা হয়েছে। তারা হলেন ফরেস্টার পিংকি, ফরেস্ট গার্ড জসিম, চুন্নু হাওলাদার, জাকির, রাজু ও কায়ছার।
সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ের একাধিক সূত্র বলছে, শহর রেঞ্জের আওতাভুক্ত এলাকা শুধু চট্টগ্রাম শহর। কিন্তু চাঁদাবাজি বিস্তৃত পুরো চট্টগ্রাম শহরে। বন বিশেষ টহল দলের নামে মিরসরাই, ফটিকছড়ি, ভূজপুর, সীতাকুণ্ড, হাটহাজারী, বোয়ালখালীসহ আশপাশ এলাকায় স্পেশাল বাহিনীর নাম করে ঘুরে বেড়ান।
অবৈধ হাইস মাইক্রোবাস ভাড়া করে ইউনিফর্ম ছাড়া, বন বিভাগের অনুমতি না নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতো এফডি (ঋউ) লেখা শর্ট পোশাক পরে সরকারি অস্ত্রসহ রাতব্যাপী চাঁদাবাজি করে আসছে।
এছাড়া চাঁদাবাজির জন্য লোকজনও নিয়োগ দিয়েছে বিভিন্ন পয়েন্টে। এর মধ্যে মধুনাঘাট ব্রিজের গোড়ায় রাসেল ও সুমন নামে এক ব্যক্তি বিভিন্ন কাঠ ও ফার্নিচার গাড়ি থেকে প্রতিদিন ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করেন।
কিছুদিন আগে কাঠের গাড়ি থেকে চাঁদা আদায়কালে র্যাবের হাতে আটক হন রাসেল। দুই মাস জেল খেটে জামিনে বের হয়ে আসেন। এরপর রেঞ্জ কর্মকর্তা বাচ্চু মিয়ার চেষ্টায় জামিনে বের হয়ে আবার সুমনকে সঙ্গে নিয়ে চাঁদা ওঠানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ।
অনুসন্ধানে প্রাপ্ত অভিযোগে প্রকাশ, চট্টগ্রাম হেয়াকো, ভুজপুর ও কয়লা এলাকায় চাঁদাবাজি করেন হেয়াকো এলাকার শহিদ। তারা প্রতিদিন ৫০ হাজার টাকার মতো চাঁদা আদায় করেন। মিরসরাই উপজেলার স্বেতছড়া এলাকার সংরক্ষিত বনভূমির গাছ পাচারের সময় আদায়কারী হিসেবে থাকেন হাশেম। প্রতিদিন ৩০ হাজার টাকার অধিক আদায় করে থাকেন।
ফটিকছড়ি ও নাজিরহাট এলাকায় চাঁদা উত্তোলনের দায়িত্বে থাকেন গুরা মিয়া, হাশেম (দাঁতমাড়া), জসিম (নাজিরহাট), আলাউদ্দিন। তারা ওই সব এলাকা থেকে প্রতিদিন লক্ষাধিক টাকা আদায় করেন।
এছাড়া হাটহাজারী চেক স্টেশন থেকে রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. বাচ্চু মিয়ার নামে টিপি এবং টিপি-বহির্ভূত অবৈধ কাঠের গাড়ির চাঁদা প্রায় ৫০ হাজার টাকা স্লিপ আকারে বাচ্চু মিয়ার কাছে পৌঁছে যায়। ফৌজদারহাট চেক স্টেশন থেকে একইভাবে টিপি এবং টিপি-বহির্ভূত অবৈধ কাঠের গাড়ির চাঁদা প্রায় ৭০ হাজার টাকা স্লিপ আকারে প্রতিদিন এই বাচ্চুর কাছে পৌঁছানো হয়।
অভিযোগ উঠেছে, চট্টগ্রাম শহর এলাকায় বাচ্চু মিয়ার রয়েছে একটি মোটরসাইকেল বাহিনী, যার দায়িত্বে রয়েছেন ফরেস্ট গার্ড রাজু ও ফরেস্ট গার্ড জাকির। তারা পুরো শহর চষে বেড়িয়ে মানুষের ব্যবহৃত ফার্নিচার, অতিপ্রয়োজনীয় অল্প চেরাই কাঠ পেলেও তারা এগুলো ধরে টাকা আদায় করেন। এছাড়া বাচ্চুর রয়েছে ব্যক্তিগত মাসিক চাঁদা নির্ধারণ।
তিনি বলিরহাট কাঠ, ফার্নিচার ও স মিল ব্যবসায়ী সমিতি থেকে মাসিক ১ লাখ টাকা নেন। এই টাকার বিনিময়ে ওই এলাকায় কোনো অভিযান করেন না। চট্টগ্রাম এক কিলোমিটার, বহদ্দার হাট, হালিশহর ও ফিরিঙ্গিবাজারের কাঠ ব্যবসায়ী মালিক সমিতি প্রতিটি থেকে প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা আদায় করে থাকেন।
চট্টগ্রাম শহর এলাকায় শতাধিক লাইসেন্সবিহীন স মিল রয়েছে। তাদের কাছ থেকে প্রতি মাসে প্রতিটি স মিল থেকে ২০ হাজার টাকা আদায়সহ লাইসেন্সধারী স মিল মালিকদের কাছ থেকে বিভিন্ন কাজের অজুহাতে মাসিক ১০ হাজার টাকা করে নেন রেঞ্জ কর্মকর্তা বাচ্চু।
ফার্নিচার দোকান রয়েছে শহর এলাকায় শহস্রাধিক, যার প্রতিটি থেকে মাসিক ২ হাজার টাকা উত্তোলন করেন তিনি। এসব অপকর্মের কারণে স্থানীয়রা এই বাচ্চুকে ‘জল্লাদ’ আখ্যা দিয়েছে।
এছাড়া বিশেষ টহল দলের নামে শহরের নতুন ব্রিজ এলাকায় সরকারি পিকআপ নিয়ে বসে থাকে। তারা বান্দরবান ও কক্সবাজার থেকে আসা বৈধ-অবৈধ কাঠবাহী গাড়ি থেকে চাঁদা উত্তোলন করে যাচ্ছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, বিভাগীয় বন কর্মকর্তার অফিসে রয়েছে রেঞ্জ কর্মকর্তা বাচ্চুর টাকা উপার্জনের নতুন নতুন কৌশল। সরকারি যত উন্নয়নকাজ হয়, তা কোনো ঠিকাদারকে করতে দিচ্ছে না।
কোটেশন বা টেন্ডার যা-ই হোক না কেন, সব কাজের টাকা তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে এবং কোনো কাজ না করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে ওই টাকা তিনি একাই আত্মসাৎ করার নজিরও সৃষ্টি করেছেন।
সূত্রমতে, চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের আওতায় পাঁচটি চেক স্টেশন রয়েছে, যার প্রতিটি স্টেশন থেকে মাসিক ৫০ হাজার টাকা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কথা বলে আদায় করেন। মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন স্টাফের কাছ থেকে বিভাগীয় বদলির কথা বলে টাকা দাবি ও আদায় করার অভিযোগও রয়েছে।
এ ব্যাপারে শহর রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. বাচ্চু মিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ভালো পোস্টিং পেতে গেলে সবকিছু ম্যানেজ করতে হয়। বেশির ভাগ অভিযোগ অস্বীকার করলেও উত্তোলিত ঘুষের টাকা ডিএফও এস এম কায়ছার এবং সি এফ মোল্লা রেজাউল করিমকে সিংহভাগ দেওয়ার কথা স্বীকার করেন।
আপনার মতামত লিখুন :