বাংলাদেশ অন্য যেকোনো গন্তব্যের তুলনায় সৌদি আরবে বেশি কর্মী পাঠাচ্ছে। স্বাধীনতার পর উপসাগরীয় দেশটিতে জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে ৬৪ লাখ ৮১ হাজার ৯০২ জন। এরমধ্যে করোনা মহামারির পর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কর্মী গেছে সৌদি আরবে। বছর বছর কর্মী পাঠানো বাড়লেও সৌদি থেকে আসছে না আগের মতো রেমিট্যান্স।
অর্থাৎ কর্মী যাওয়ার সংখ্যা বাড়লেও কমছে রেমিট্যান্স আয়। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কর্মী গেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। দেশটি এখন পর্যন্ত রেমিট্যান্স আয়ের শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। কিন্তু এখানেও একটি গোলকধাঁধা রয়েছে। খোদ গভর্নর গত জানুয়ারি মাসে একটি অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন, বাংলাদেশে এখন সৌদি আরব থেকে সব রেমিট্যান্স সরাসরি আসে না। দুবাই হয়ে তারপর আসছে। তৃতীয় সর্বোচ্চ জনশক্তি রপ্তানির দেশ ওমান।
রেমিট্যান্স আয়ের দিক থেকে ৮ নম্বরে অবস্থান দেশটির। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স আসা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে। জনশক্তি রপ্তানি বাড়লেও রেমিট্যান্স আয় কমার বেশকিছু কারণ উল্লেখ করেন বিশেষজ্ঞরা।
যার মধ্যে প্রথমেই আছে সৌদিতে অনিবন্ধিত বাংলাদেশি কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি। দেশটির অনেক নিয়োগকর্তাই ইকামা বা বিদেশি কর্মীর বসবাসের পারমিটের উচ্চ মূল্য দিতে নারাজ, যে কারণে আইনি বৈধতা ছাড়াই অবস্থান করতে হয় অনেক শ্রমিককে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সৌদি থেকে দুবাই হয়ে রেমিট্যান্স আসছে দেশে। মোটাদাগে হুন্ডিতে অর্থ পাঠানো থেকে বের হতে পারছে না মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো।
বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ থেকে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশ থেকে কাজের উদ্দেশ্যে মোট ১ কোটি ৭১ লাখ ৫২ হাজার ৫৬২ জন বাংলাদেশি বিদেশ গেছেন। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবে অভিবাসী হয়েছেন ৬৪ লাখ ৮১ হাজার ৯০২ জন বাংলাদেশি।
অর্থাৎ দেশের মোট অভিবাসী শ্রমিকের ৩৭ দশমিক ৭৮ শতাংশই গেছেন সৌদি আরবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ বিভিন্ন সময়ে দেশে ফিরেও এসেছেন। তবে এ মুহূর্তে ঠিক কী পরিমাণ বাংলাদেশি সৌদি আরবে বসবাস করছেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান বিএমইটি’র কাছেও নেই।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কর্মী গেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। দেশটিতে এ পর্যন্ত জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে ২৬ লাখ ৫০ হাজার ৩৪২ জন। দেশটি থেকেও রেমিট্যান্স আয়ের পরিমাণ কমে আসছে। তৃতীয় সর্বোচ্চ জনশক্তি রপ্তানির দেশ ওমান। দেশটিতে জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে ১৮ লাখ ৮৪ হাজার ৮২৭ জন।
কিন্তু রেমিট্যান্স আয়ের দিক থেকে ৮ নম্বরে অবস্থান দেশটির। চতুর্থ সর্বোচ্চ জনশক্তি রপ্তানির দেশ মালয়েশিয়া। দেশটিতে এ পর্যন্ত জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ২১৯ জন। পঞ্চম সর্বোচ্চ জনশক্তি রপ্তানির দেশ সিঙ্গাপুর। দেশটিতে এ পর্যন্ত জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে ১০ লাখ ৩ হাজার ৮২৫ জন।
১৫৮টি দেশে বাংলাদেশের কর্মী গেলেও দক্ষ জনবলের অভাবে বাংলাদেশের বাজার ৭ থেকে ৮টি দেশেই সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ (বায়রা) সূত্রে জানা গেছে, সৌদি আরবে ৬০-৭০ শতাংশ বাংলাদেশি কর্মী গত তিন বছরে তাদের ইকামা পাননি।
তাই আইনিভাবে স্বীকৃতি ছাড়া, এই শ্রমিকরা কম উপার্জন করে এবং আনুষ্ঠানিক বা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠাতে পারেন না। এর পরিবর্তে, তারা হুন্ডির দিকে ঝোঁকে, অর্থ প্রেরণের এই অবৈধ বা অনানুষ্ঠানিক ব্যবস্থাই এসব প্রবাসী আয়কে আনুষ্ঠানিক হিসাবের রাইরে রাখছে।
গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলভুক্ত দেশগুলো বা জিসিসিভিত্তিক একটি অধিকার গোষ্ঠী মাইগ্রেন্ট-রাইটস.অর্গ এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হুন্ডি ব্যবহার করে বেশিরভাগ শ্রমিক অনিবন্ধিত। কিছু পরিবারও ব্যাংকের চেয়ে হুন্ডিতে টাকা পেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, কারণ তারা এই প্রক্রিয়াকে সহজ মনে করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা এবং বিশ্লেষকরা বলছেন, সৌদি আরব থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে অর্থ পাচারের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা এবং এরপরে তা রেমিট্যান্স হিসাবে বাংলাদেশে আসার বিষয়টি রেমিট্যান্সের এই অসামঞ্জস্যের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয় গত ১১ জানুয়ারি।
ওইদিন প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, একটি প্রতারক সিন্ডিকেট রেমিট্যান্সে কারচুপি করছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন সৌদি আরব থেকে সব রেমিট্যান্স সরাসরি আসে না। দুবাই হয়ে তারপর আসছে।
তিনি বলেন, একটা গোষ্ঠী আগে সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স কিনে মজুত করছে, এরপর বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর কাছে চড়া দরে বিক্রি করছে। এতে দেশের ডলার বাজারকে বাইরে থেকে অস্থিতিশীল করা হচ্ছে। এদিকে বৈদেশিক লেনদেনের দায় পরিশোধের জন্য অনেক সময় ব্যাংকগুলোও ডলারের জন্য প্রিমিয়াম মূল্য দিতে রাজি হচ্ছে, যে কারণে দেশে ডলারের দরও বেড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাইয়ে সৌদি থেকে রেমিট্যান্স এসেছিল ৩৩ কোটি ১২ লাখ ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছরে সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ৫০৭ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে সৌদি আরব থেকে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ৪৫৪ কোটি ডলার।
২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশটি থেকে এসেছে ২৯৬ কোটি ডলার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সৌদি থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ২৭৪ কোটি ডলার। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে সৌদি আরব থেকে রেমিট্যান্স এসেছে ২৩১ কোটি ডলার। সৌদি আরব থেকে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে আসা রেমিট্যান্সে পতনের সঙ্গে শুধু অনিবন্ধিত শ্রমিক বা অবৈধ অর্থ স্থানান্তর জড়িত নয়।
এর সঙ্গে অন্যান্য বিষয়ও কাজ করছে বলে জানান খাত সংশ্লিষ্টরা। যেমন বাংলাদেশে ডলারের সংকট থাকায় কিছু বড় প্রতিষ্ঠান বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহের জন্য হুন্ডি নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হতে বাধ্য হয়েছে। হজ এবং ওমরাহ’র জন্য বিপুল অর্থ প্রেরণও হুন্ডি চ্যানেলের ব্যবহার বাড়াতে ভূমিকা রাখে।
সবমিলিয়ে এসব সংখ্যা রেমিট্যান্সে যোগ হচ্ছে না, কিন্তু বাস্তবে তার প্রভাব পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি নিয়ন্ত্রণ না করা হয়, তবে এই প্রবণতা বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুতকে আরও সংকুচিত করতে পারে, যা ব্যবসা পরিচালনা এবং আমদানিকে আরও কঠিন করে তুলবে।
বায়রার প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট নোমান চৌধুরী বলেন, গত তিন থেকে চার বছরে সৌদি আরবে যাওয়া ৬০-৭০ শতাংশ বাংলাদেশি ইকামা পেতে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। আমি নামি সৌদি সংস্থাগুলোতে কর্মী পাঠাই, কিন্তু তারপরেও এদের মধ্যে কমপক্ষে ১০ শতাংশ ইকামা নিয়ে সমস্যায় পড়েন।
এ কারণে তারা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাতে বাধ্য হয়। প্রতি বছর নবায়ন করতে হয় ইকামা, যার ফি দিতে হয় নিয়োগকারীকেই। সাধারণত, কর্মসংস্থান ভিসায় সৌদি আরবে যাওয়া কর্মীরা তিন মাসের অস্থায়ী অনুমতি পান। নির্মাণ, ক্লিনিং এবং কৃষির মতো অ-শিল্প, স্বল্প মজুরি খাতে কর্মীদের জন্য ১১ হাজার রিয়াল ইকামা ফি দিয়ে নিয়োগকর্তাদের এই সময়ের মধ্যে তাদের কর্মীদের ওয়ার্ক পারমিট সুরক্ষিত করতে হয়।
কিন্তু এটি করা নাহলে শ্রমিকরা অনিবন্ধিত হয়ে পড়ে। নিয়োগকর্তারা বর্তমানে প্রতি শ্রমিকের ইকামার জন্য সৌদি শ্রম মন্ত্রণালয়কে বার্ষিক ৮,৬০০ রিয়াল দেন। একইসঙ্গে বিমা ও অন্যান্য হিসাবে তাদের আরও ৬০০ রিয়াল দিতে হয় সৌদি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। যে কারণে শ্রমিক প্রতি ইকামা বাবদ বছরে তাদের খরচ দাঁড়ায় ১১ হাজার রিয়াল।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যমতে, বিভিন্ন গন্তব্যে গিয়ে চাকরির ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়া বাংলাদেশি অভিবাসীরা গত এক বছরে প্রায় ৬ হাজার ৭৫৫টি অভিযোগ জমা দিয়েছেন, আগের বছরের চেয়ে যা ১৮৪ শতাংশ বেড়েছে। খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, এসব অভিযোগের প্রায় ৮০ শতাংশই করেছেন সৌদিতে কর্মরতরা।
সৌদি আরবে যাওয়া বাংলাদেশি শ্রমিকরা ওয়ার্ক পারমিট, চাকরির নিরাপত্তা, বিলম্বিত বেতন এবং মজুরি চুরি নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। বিএমইটি সূত্রগুলি বলছে, ৫০ শতাংশ অভিযোগই ইকামা সমস্যা সম্পর্কিত, কারণ অনেক নিয়োগকারী দেশটিতে তাদের কর্মীদের বৈধভাবে অবস্থানের জন্য অনুমতি নিচ্ছেন না।
এর প্রতিক্রিয়ায়, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রতারণামূলক আচরণের জন্য ২৪টি সৌদি কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করে এবং বাংলাদেশি সংস্থার মাধ্যমে তাদের কর্মী নিয়োগ নিষিদ্ধ করে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ও সৌদি আরব ইকামা নবায়নের ফি, এবং নবায়ন না হওয়ার কারণে চাকরি হারানোর বিষয়ে আলোচনা করেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, গত ৩০ জানুয়ারি সৌদি উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আবু নাইন এবং বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা আসিফ নজরুল রিয়াদে এটি সমাধানের জন্য বৈঠক করেছেন।
সৌদি আরবে কর্মরত বাংলাদেশি, এক্সচেঞ্জ হাউস, ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছে রূপালী বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষই বলছে, সৌদি আরবে রেকর্ডসংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিক অভিবাসী হলেও তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ এখন বেকার। অনেকে চাকরি পেলেও বেতন-ভাতা প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম।
জীবনধারণের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে মাস শেষে অনেক বাংলাদেশি শ্রমিকের হাতে দেশে পাঠানোর মতো উদ্বৃত্ত অর্থ থাকছে না। আবার সৌদি আরবে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের একটি বড় অংশের আয় এখন হুন্ডি কারবারিদের হাতে চলে যাচ্ছে। ব্যাংকিং চ্যানেলের তুলনায় হুন্ডিতে ডলারের দর বেশি পাওয়ায় প্রবাসীরা হুন্ডিতে টাকা পাঠাতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
বাংলাদেশি কিছু প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সৌদি আরবে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের ঘিরে হুন্ডির জমজমাট ব্যবসা গড়ে তুলেছেন বলেও জানা গেছে।
সৌদি আরবে ওমরাহ করার ভিসার জন্য দেশটির হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয়কে পরিবহন খরচসহ ফি দিতে হয় আবেদনকারীকে। বাংলাদেশের একটি হজ ও ওমরাহ এজেন্সির মালিক নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, রিয়ালের রেট কম থাকলে আমি ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠাই, কিন্তু ব্যাংক রেট উচ্চ থাকলে তখন অন্যান্য চ্যানেলে পাঠাই।
প্রতিবছর সাড়ে ৪ থেকে ৫ লাখ বাংলাদেশি প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে ওমরাহ হজ পালন করেন। এর মধ্যে অর্ধেক ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠানো হলেও বাকিটা যায় হুন্ডির মাধ্যমে। হজের ব্যয় পরিশোধের বিষয়টি এখন ব্যাংকের মাধ্যমে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হলেও ওমরাহের অর্থ প্রেরণে হুন্ডির ব্যাপক প্রচলন এখনো রয়ে গেছে।
এদিকে ডলার জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বাংলাদেশের বৃহৎ রপ্তানিকারকদের। এজন্য তারাও অনানুষ্ঠানিকভাবে ডলার সংগ্রহের জন্য যেসব দেশ থেকে বেশি রেমিট্যান্স আসে সেখানে অফিস খুলছে।
আপনার মতামত লিখুন :