মঙ্গলবার, ০১ এপ্রিল, ২০২৫

রমজানেও স্পা সেন্টারে চলে অনৈতিক কর্মকাণ্ড

মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: মার্চ ২৬, ২০২৫, ০১:৪৮ এএম

রমজানেও স্পা সেন্টারে চলে অনৈতিক কর্মকাণ্ড

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ঢাকায় স্পা সেন্টার বা ম্যাসাজ পার্লারের আড়ালে চলে অনৈতিক কর্মকাণ্ড। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা এখানকার পণ্য ও গ্রাহক। তাদের দিয়েই চলে মূলত এই ব্যবসা। মাদক ব্যবসার প্রসার ও নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে সব অপরাধের কেন্দ্র এই সেন্টারগুলো। মাহে রমজানে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান চলমান থাকলেও তাদের ব্যবসা থেমে নেই।

ঢাকার গুলশান, বনানী, নিকেতন ও উত্তরায় প্রায় ৩ শতাধিক স্পা সেন্টার বা ম্যাসাজ পার্লার রয়েছে। আয়েশি এসব সেলুন বা সৌন্দর্য বৃদ্ধির ব্যবসাকে ঘিরে চলে অনৈতিক কর্মকাণ্ড। 

বাইরে থেকে ভেতরের পরিবেশ অনুমান করা কঠিন। ভেতরে গেলে চোখে পড়বে ছিমছাম ও পরিপাটি সেলুন। কলেজ ও ভার্সিটিপড়ুয়া মেয়েদের এখানে আনাগোনা। ভেতরে রয়েছে সেবাদানের উপযোগী ছোট-ছোট কেবিন। উঠতি বয়সি ছেলেসহ যুবসমাজের একটি বড় অংশ তাদের খদ্দের। ভেতরে চলে মাদক কেনাবেচা ও নিয়ন্ত্রণ বাণিজ্যও।  

ঢাকার গুলশান, বনানী, নিকেতন ও উত্তরার একাধিক স্পা সেন্টার ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন রঙের আলোয় ঝলমল করছে স্পা সেন্টার বা ম্যাসাজ পার্লারগুলো। চকচকে রূপে ভেতরের পরিবেশ অনুমান করা মুশকিল।

এদিকে, দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, যেসব স্পা সেন্টারে পুলিশ অভিযান চালিয়েছে, সেখানে তারা জানতে পারেন, আত্মগোপনে থেকে এসবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। মূলত তারাই এসব স্পার মালিক; দূর থেকে কর্মচারী দিয়ে এসব নিয়ন্ত্রণ করছেন। 

তবে ৫ আগস্টের পর ছাত্র-জনতার নামে তারা এসব অবৈধ ব্যবসা করে যাচ্ছেন। তবে সেন্টারগুলোর অনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করতে মাঠে নেমেছেন সরকারের যৌথ বাহিনীর সদস্যরা। 

ঢাকার গুলশান, বনানী, নিকেতন ও উত্তরায় গত এক মাসে স্পা সেন্টারে অভিযান চালিয়ে ১৩৩ জনকে আটক করা হয়েছে। রমজানের আগে থেকে পুলিশ ও র‌্যাব অভিযান চালিয়ে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করে যাচ্ছে বলে জানান গোয়েন্দারা। 

২৩ মার্চ র‌্যাব-১ এর একটি দল মধ্যরাতে গুলশান-১ এর আরএম সেন্টারের চতুর্থ তলায় অভিযান চালিয়ে ৫৪ জনকে আটক করে। পরে তাদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এক সপ্তাহের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তার আগে ১ মার্চ বনানীর ৯ নম্বর রোডে বিশেষ অভিযান চালিয়ে ৯ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। 

ডিএমপির গুলশান ও উত্তরা বিভাগের একটি সূত্র জানায়, রাজধানীর গুলশান, বনানী, নিকেতন ও উত্তরায় প্রায় ৩ শতাধিক স্পা সেন্টার রয়েছে। যেগুলোর নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী সরকারের রাজনৈতিক সমর্থকরা। মূলত তারাই ৫ আগস্টের পর আত্মগোপনে থেকে এসব অনৈতিক অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।  

এ বিষয়ে জানতে চাইলে র‌্যাবের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, গুলশান, বনানী, নিকেতন ও উত্তরার যেসব স্থাপনায় স্পার আড়ালে অনৈতিক কর্মকাণ্ড চলছে, সেগুলো নজরদারিতে রয়েছে। 

তা ছাড়া গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সব ইউনিট ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করছে। তবে এসব স্পা সম্পর্কে তথ্য দিতে সাধারণ মানুষকে অনুরোধ করেন তিনি।

আশিকুর রহমান বলেন, ২৩ মার্চ র‌্যাব-১ এর অভিযানে নারী কর্মীসহ ৫৪ জনকে আটক করা হয়। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন আলামত জব্দ এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। 

জানা গেছে, বাবুল সেলুন স্পা, ম্যাঙ্গো স্পা, লাইভ স্টাইল, হেল্থ ক্লাব অ্যান্ড স্পা, সেলুন স্পা, রেডিডেন্স সেলুন-১, সেলুন-২, অ্যান্ড স্পাসহ-৩ শতাধিক স্পা সেন্টার গোয়েন্দা নজরদারিতে রয়েছে। 

বিশেষ করে গুলশান, বনানী, নিকেতন, উত্তরার অভিজাত এলাকা টার্গেট করেই চলে এসব স্পার অনৈতিক কর্মকাণ্ড। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে দেওয়া হচ্ছে লোভনীয় বিজ্ঞাপন। যা দেখে আরাম আয়েশ করতে আসছেন বিভিন্ন শ্রেণির লোকজন। 

স্থানীয় অনেকে অভিযোগ করেন, অভিজাত ও কূটনৈতিক এলাকায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাট নিয়ে এমন অসামাজিক কার্যকলাপ হতবাক করেছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চাইলেই এটি বন্ধ করা সম্ভব। এই ব্যবসাকে ঘিরে ঘটছে নানা প্রতারণার ঘটনা।
জানা যায়, বনানী রোডের একটি বাড়িতে রাজ ও বাবুল নামে দুজন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাদের সঙ্গে আছেন ছদ্মনামে রোজি ও মাহি। ৫ আগস্টের আগেও তাদের আটক করেছিল পুলিশ। জামিনে বেরিয়ে আবারও একই ব্যবসা শুরু করেন তারা। বর্তমানে স্পার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ হয় গুলশান, বনানী, উত্তরা এবং নিকেতন এলাকা থেকে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, ‘অবৈধ স্পা বা ম্যাসাজ পার্লারের নাম যারা অসামাজিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন, তাদের ছাড় দেওয়া হবে না। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পুলিশ বারবারই এর বিরুদ্ধে অভিযানে রয়েছে, আগামীতেও পরিচালনা করবে।’ 

উত্তরা বিভাগের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, ‘উত্তরায় বেশ কয়েকবার অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। আবারও পুলিশ অভিযান পরিচালনা করবে।’ 

ফেসবুকে বিজ্ঞাপন: ঢাকা শহরে প্রায় শতাধিক স্পা সেন্টার দিচ্ছে এই বিজ্ঞাপন। সুন্দরী তরুণীদের দেখিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন তারা। তাদের অধিকাংশের নেই বৈধ কাগজ কিংবা ট্রেড লাইসেন্স। সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে হোটেল, বিউটি পার্লার, সেলুন আর ব্যায়ামাগারের ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে চলছে এমন ব্যবসা। 

গুলশান বিভাগের ডিবি পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, ‘যদি কেউ প্রতারিত বা ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হন, আমাদের অভিযোগ দিন। অনেকে অভিযোগ দিতে চান না। সেই ক্ষেত্রে আমাদেরও কিছু করার থাকে না।’ 

তিনি বলেন, ‘অনেককে আটক করা হচ্ছে, তারা জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবারও স্থান পাল্টিয়ে ওই একই ব্যবসা শুরু করছে। আমরা নজরদারি বাড়িয়েছি ও অভিযানের কথা চিন্তা করছি।’
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!