স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও পূর্ণতা পায়নি মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। সরকার এসেছে, সরকার গেছে- তালিকা শুধুই কাটাছেঁড়া হয়েছে। সব সরকারের আমলেই দীর্ঘতর হয়েছে তালিকা। কিন্তু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নিরূপণ করে একটি সম্পূর্ণ তালিকা প্রণয়নের কাজ বরাবরই উপেক্ষিত রয়ে গেছে।
ফলে একটি অসম্পূর্ণ তালিকা ধরে বছরের পর বছর বৈষয়িক এবং রাষ্ট্রীয় সুবিধাই ভোগ করে গেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। বারবার দাবি উচ্চারিত হলেও পৃথকীকরণের মাধ্যমে তালিকা থেকে সুবিধাভোগীদের ছেঁটে ফেলার কাজটি কখনো হাতে নেওয়া হয়নি। এর নেপথ্যের কারণ হিসেবে সবসময় অনৈতিক লেনদেনের বিষয়টি সামনে চলে এলেও কর্ণপাত করা হয়নি। এতে করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা লজ্জিত হয়েছেন, সমালোচিত হয়েছেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময় ৯৩ হাজার মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় সমানে নামধারীদের সমাবেশ ঘটেছে। সে সময় তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে খোলামেলা বাণিজ্য হয়েছে বলে বহুবার অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে।
কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী থেকে শুরু করে কেউই বিষয়গুলো কানে তুলেননি। ওই সরকারের পতনের মাঝামাঝি এসে খোদ মন্ত্রণালয়ের সচিবের পিতাকেও অনৈতিকভাবে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে গেজেটটি বাতিল হয়ে যায়।
এমনি করে তৎকালীন মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রী শ. ম রেজাউল করিম রাতারাতি মুক্তিযোদ্ধা বনে যান। তালিকায় তার অন্তর্ভুক্তি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিলে হিসাব করে দেখা যায়, ১৯৬২ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তার জন্ম তারিখ। সে হিসাবে যুদ্ধকালীন সময়ে তার বয়স দাঁড়ায় ১০ বছর।
অথচ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে বয়স নির্ধারিত ছিল ন্যূনতম ১২ বছর। একইভাবে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) ৭২ সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ নেতা লে. কর্নেল ফারুক খানকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে গেজেট প্রকাশিত হয়। এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিলে মন্ত্রণালয়ের তরফে সেনাসদরের মতামতের জন্য পাঠানো হয়।
তখন তল্লাশি করে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানের ২৩ পাঞ্জাবের ব্যাটালিয়ন ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমপর্ণের সময় ফারুক খানের নাম ওই ব্যাটালিয়নে ছিল।
ফারুক খান সে সময় বাঙালি কর্মকর্তা পরিচয়ে ক্ষমাপ্রাপ্ত হন। ২৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হলে তাকে কলকাতা বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনে হোসেন আলীর কাছে পাঠানো হয়।
পরে ১৪ জানুয়ারি বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে আসেন। তাহলে তিনি মুক্তিযুদ্ধ করার সুযোগ পেলেন কোথায়! এমনি করে আরও বহু নেতাকে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর পাঁয়তারা করা হয়েছিল। এমনি করে এই সময়ে এসে সে সময়কার খোদ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের মুক্তিযোদ্ধার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়।
শুধু আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েই নয়, ২০০১-০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলেও মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্তি নিয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠেছিল। কিন্তু তালিকায় খুব একটা সংশোধনী আনা হয়নি।
যতবার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা: যতবার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা হয়েছে, ততবারই নয়ছয় হয়েছে। বারবার শুধু সংযোজন হয়েছে। তালিকায় বিয়োজন কখনো হয়নি।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট প্রথম মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়ন করে ১৯৮৮ সালে। তখন তালিকায় স্থান পান ৭০ হাজার ৮৯২ জন মুক্তিযোদ্ধা। তবে এর আগে ১৯৮৬ সালে প্রথম জাতীয় কমিটির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় ১ লাখ ৪৫৮ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম।
মূলত এরশাদ সরকারের সময়ে ১৯৮৪ সালে প্রথম মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। এ লক্ষ্যে একটি জাতীয় কমিটি গঠিত হয়। এর আওতায় শেখ মুজিব সরকারের সময় গঠিত মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট সংগৃহীত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা, চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের (ইবিআরসি) তালিকা এবং ভারত থেকে প্রাপ্ত তালিকা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা তালিকা তৈরির কাজ হাতে নেওয়া হয়। তবে এই তালিকা গেজেটে স্থান পায়নি।
২০০১-০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব সাদত হুসাইনকে আহ্বায়ক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মমতাজউদ্দিনকে সদস্যসচিব করে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি ২ লাখ ১০ হাজার ৫৮১ জন মুক্তিযোদ্ধাকে তালিকাভুক্ত করে।
চতুর্থ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় ১ লাখ ৫৪ হাজার ৪৫২ জন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৯৮-২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদের মুখপত্র ‘মুক্তিবার্তা’য় এ তালিকা স্থান পায়।
২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের সময় প্রকাশিত গেজেট অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৯৮ হাজার। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ২০২৩ সালে সর্বশেষ তালিকা, যেটি সমন্বিত তালিকা হিসেবে পরিচিত-তাতে স্থান পায় ২ লাখ ৮ হাজার ৮৫১ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম। এর মধ্যে খেতাবপ্রাপ্ত, শহিদ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১২ হাজার ৫৭৯। বর্তমানে এই ২ লাখ ৮ হাজার ৮৫১ জন মুক্তিযোদ্ধা প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা হারে সম্মানি ভাতা পাচ্ছেন। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ৯৩ হাজার মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীরপ্রতীক জানিয়েছেন, এদের নাম ডাটা এন্ট্রিভুক্ত করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ৪০ হাজার ডাটা এন্ট্রি সম্পন্ন হয়েছে। বাকি ৫০ হাজার চলমান। এরপর জানা যাবে এরা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা কি না।
এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই চলমান। তবে প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে বিস্তারিত আমার জানা নেই। এ কাজটি করছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)।
আপনার মতামত লিখুন :